ইস্টবেঙ্গলকে সমতায় ফিরিয়ে বুকেনিয়া। রবিবার। -শঙ্কর নাগ দাস
বেঙ্গালুরু এফসি-১: ইস্টবেঙ্গল-২
(বিনীত) (বুকেনিয়া, রবিন)
এক সময়কার ‘দুষ্টু’ ছেলের হাতেই বধ চ্যাম্পিয়নরা! যা দেখে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন এখনকার ‘দুষ্টু’ ছেলে।
একটা সময় বিশৃঙ্খলার কারণে ক্লাবের চক্ষুশূল হয়ে যিনি ইস্টবেঙ্গল ছেড়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনে তাঁর পা-ই এনে দিল সম্মানের ম্যাচের পুরো পয়েন্ট। সুনীল ছেত্রী-বিনীতদের বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে। যারা গত আই লিগের চ্যাম্পিয়ন শুধু নয়। মাসকয়েক আগেই প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে খেলেছে এএফসি কাপ ফাইনাল।
লাল-হলুদের দিল্লিওয়ালা ত্রাতার পিছনে ম্যাচ শেষে ছুটল সংবাদমাধ্যম থেকে সমর্থকেরা। কিন্তু তিনি একটাও কথা না বলে গটগট করে গাড়িতে উঠে মিলিয়ে গেলেন বারাসতের যানজটে।
তিনি রবিন সিংহ।
চার বছর আগের এক সকাল। ইস্টবেঙ্গলে ট্রেভর মর্গ্যানের প্রথম ইনিংসের ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। বিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান। হঠাৎ-ই লাল-হলুদ কোচের চোখের বালি হয়ে ওঠেন রবিন। প্র্যাকটিসে ঢুকেছিলেন সেটা শেষ হওয়ার পরে। পরের দিন মর্গ্যান তাঁকে স্কোয়াডেই রাখেননি। এর পরই বেঙ্গালুরুতে ডেরা বেঁধেছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের প্রিয় ‘রলি’। চার বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। এমনকী লাল-হলুদে রবিনের জার্সি নম্বরও। ২৩-এর বদলে তাঁর গায়ে রবিবার ২৪ নম্বর। বদলে গিয়েছে তাঁর লাইফস্টাইল। পেশাদারিত্বও। এতটাই যে, বজবজের বিতর্কিত ইস্টবেঙ্গল মিডফিল্ডারও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। তিনি— অবিনাশ রুইদাস এ দিন সন্ধেয় বলছিলেন, ‘‘রবিন ভাই পারলে আমিও পারব।’’
এহেন ‘রবিন কাঁটা’ দিয়ে লাল-হলুদ সমর্থকদের বুকে গেঁথে থাকা বেঙ্গালুরু-কাঁটা উপড়ে ফেললেন তাঁর সেই সাহেব কোচ। বেঙ্গালুরু-কাঁটা এমনই যে ম্যাচের আগের দিন নড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালিদের। শতবর্ষের দরজায় কড়া নেড়ে ফেলা ক্লাবের বিরুদ্ধে তাদের শহরে খেলতে এসে চার বছরের পুঁচকে টিম কলকাতার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা আমন্ত্রণপত্র দিয়ে জানানো— রবিবার সিংহের গুহায় ঢুকে সিংহ শিকার করতে যাচ্ছি। তোমরা দেখতে আসছ তো?
বেঙ্গালুরু এফসি-র বিজ্ঞাপিত ‘ক্ল্যাশ অব দ্য উইক’ দেখার পর চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল লাল-হলুদ কর্তাদের। শনিবার বিকেলে ক্লাবের এক শীর্ষকর্তার কাছে ইডেনের ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের টিকিট চাইতে গিয়েছিলেন মেহতাব। তখনই তাঁকে বেঙ্গালুরুর বিজ্ঞাপন দেখিয়ে কর্তাটি বলেন, ‘‘টিকিট দিচ্ছি। কাল কিন্তু এর জবাবে তিন পয়েন্ট চাই।’’ সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে যান ইস্টবেঙ্গলের মিডফিল্ড জেনারেল।
বারাসতে কিন্তু এ দিন ম্যাচের শুরু থেকে সেই প্রতিজ্ঞার ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি। আক্রমণাত্মক পাসিং ফুটবলে ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম কুড়ি মিনিট কোণঠাসা করে ফেলেছিল সুনীল-বিনীত-লিংডো ত্রিভুজ। নিখিল পূজারি ছাড়া লাল-হলুদের কেউ উইং ধরে পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছেন না। দুই সাইড ব্যাক রাহুল ও নারায়ণ যেন ওভারল্যাপ ভুলেই গিয়েছেন। আপফ্রন্টে বিদেশি আমিরভ যেন ফুটবলার নন দর্শক। দুই ফরোয়ার্ডের পিছনে ওয়েডসন বল ছাড়ার বদলে হোল্ড করে সুযোগ নষ্ট করছেন। বেঙ্গালুরর বিনীতের গোলটা এই সময়ই। ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্স এক লাইনে দাঁড়িয়ে। মিডফিল্ডাররাও কেউ বিনীতকে মার্ক করলেন না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই অবশ্য বুকেনিয়া সমতা ফেরান। কিন্তু তার পিছনে কোনও পজিটিভ মুভ নেই। ইস্টবেঙ্গলে এ বার মর্গ্যানের আমদানি করা সেট পিস এবং কাউন্টার অ্যাটাক থিওরির সৌজন্যে গোল শোধ।
আগের দিন প্র্যাকটিস করানোর সময় মর্গ্যান সাংবাদিকদের মাঠ থেকে বের করে দিলেও গোলের পিছনে থেকে গিয়েছিলেন নামাবলী গায়ে বসিরহাট আগত এক ব্যক্তি। যাওয়ার সময় তিনি নাকি বলে যান, ‘‘কোচ স্ট্র্যাটেজি বানাক। ভাগ্যের রাস্তাটা আমি পরিষ্কার করব।’’ ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের সেই ‘ভাগ্যের রাস্তা’ ক্লিয়ার হল দ্বিতীয়ার্ধে। যার পিছনে অবশ্য কোচের স্ট্র্যাটেজি। এতক্ষণ লালরিন্দিকা উইংয়ের বদলে ভিতরে ঢুকে আসছিলেন। তাঁর দিকে বিপক্ষের উদান্তাকে ধরছিলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে যেটা করতে শুরু করলেন ডিকা। মর্গ্যানও নিষ্প্রভ আমিরভকে তুলে নামালেন রবিনকে। বেঙ্গালুরুও হঠাৎ শুরু করল লং বল খেলতে। ইস্টবেঙ্গল সেখানে ধরল পাসিং ফুটবল। হাইলাইন ডিফেন্স করে এটা আটকাতে গিয়ে মাঝমাঠের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল জন জনসনদের। আর সেই ফাঁক দিয়ে অপারেট করেই জনসনের মিস হেড থেকে বেরিয়ে আসা বলে রবিনের গোল।
তার পরেও দিনের শেষে মর্গ্যানের দল গঠন নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। রোমিও, জ্যাকিচন্দ আর কত দিন বাইরে থাকবেন?
ইস্টবেঙ্গল: রেহনেশ, রাহুল, বুকেনিয়া, গুরবিন্দর, নারায়ণ, মেহতাব (রওলিন), নিখিল, ওয়েডসন, লালরিন্দিকা, আমিরভ (রবিন), প্লাজা।