কেপ টাউনে ঝড় তোলা আজহার আশাবাদী বিরাটদের নিয়ে

কুড়ি বছর আগে ঠিক এই দিনটাতেই (৪ জানুয়ারি, ১৯৯৭) কেপ টাউনের বাইশ গজে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে ক্রিজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। নতুন অধিনায়ক হয়েছেন সচিন এবং অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন তিনি। পরবর্তী দু’ঘণ্টা ধরে ভয়ঙ্কর দক্ষিণ আফ্রিকান বোলিংকে ছিঁড়ে খেলেন তাঁরা। অ্যালান ডোনাল্ড-দের এত অসহায় কখনও দেখায়নি। ঠিক তার আগের টেস্টেই ডারবানে দুই ইনিংসে ১০০ এবং ৬৬ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল ভারত। কেপ টাউনেও ব্যাটিং ধস নেমে হয়ে গেল ৫৮-৫। সেখান থেকে দুর্ধর্ষ কাউন্টার অ্যাটাক। ২২২ রানের সেই ঝোড়ো পার্টনারশিপ আজও ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে গণ্য হয়। কেপ টাউনে বিরাট-বাহিনী পরীক্ষা দিতে নামার কুড়ি বছর আগে ১১০ বলে ১১৫ রানের ডাকাবুকো ইনিংস খেলা মহম্মদ আজহারউদ্দিন একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।কেপ টাউনে বিরাট-বাহিনী পরীক্ষা দিতে নামার কুড়ি বছর আগে ১১০ বলে ১১৫ রানের ডাকাবুকো ইনিংস খেলা মহম্মদ আজহারউদ্দিন একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কেপ টাউন শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:০৭
Share:

মহম্মদ আজহারউদ্দিন

প্রশ্ন: কেপ টাউনে আপনার সেই দুর্ধর্ষ ইনিংস। তীব্র কাউন্টার অ্যাটাকে ১১০ বলে ১১৫ রান। গ্যারি কার্স্টেন দু’ বছর আগেও ভারতে এসে বলে গিয়েছেন, এমন বিধ্বংসী টেস্ট ইনিংস তিনি আর কখনও দেখেননি। কী চলছিল সে দিন আপনার মনে?

Advertisement

মহম্মদ আজহারউদ্দিন: খুব আলাদা কিছু মানসিক পরিবর্তন এনে খেলতে নেমেছিলাম, এমন নয়। সে দিন আসলে খুব ইতিবাচক ছিলাম। আর ভাল ব্যাটে-বলে লাগছিল। ছন্দটা পেয়ে গিয়েছিলাম। আর একবার শটের ছন্দটা পেয়ে যাওয়াতে ঠিক করে নিয়েছিলাম, এটাকে নষ্ট হতে দেব না। একই ভাবে খেলে যাব।

প্র: খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল ভারত। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কি কাউন্টার অ্যাটাকের স্ট্র্যাটেজিই ঠিক হবে বলে মনে হয়েছিল?

Advertisement

আজহার: চাপ কাটানোর একটা ব্যাপার তো ছিলই। কিন্তু ওই ইনিংসটা ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন, আমি টেকনিক্যাল কিছু তারতম্যও করেছিলাম। স্টান্স বদল করেছিলাম। ক্রিজের মধ্যে থেকে খেলছিলাম। একটু লেগস্টাম্পের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম যাতে অফস্টাম্পে মারতে পারি। এমনিতে লেগস্টাম্পে আমি ভাল শট নিতে পারি বলে সবাই মনে করে। ওই ইনিংসটাতে বেশির ভাগ রান কিন্তু করেছিলাম অফের দিক থেকে। ইনিংসটা যদি আবার দেখেন ভাল করে, দেখবেন প্রায় ছ’সাত স্টাম্প দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাট করেছিলাম। খুবই অন্যরকম ব্যাটিং স্টান্সে খেলেছিলাম। যাতে অফস্টাম্পে শট খেলার বেশি জায়গা পাই। লেগস্টাম্পে সে দিন বোধ হয় দু’তিনটে স্ট্রোকই নিয়েছিলাম। ফ্লিক খুব একটা মারিইনি। যেটা আমার সবচেয়ে পছন্দের শট ছিল। অ্যালান ডোনাল্ডের একটা ফুলটস শুধু কব্জির মোচড়ে চার মেরেছিলাম। তা ছাড়া সবই ছিল অফসাইডে নেওয়া শট।

প্র: আপনার কাছে কি ওটাই জীবনের সেরা সেঞ্চুরি?

আজহার: অন্যতম সেরা বলা যেতেই পারে। কলকাতার সেঞ্চুরিটাকেও রাখতে চাইব।

প্র: কলকাতায় তো আপনার অনেক সেঞ্চুরি রয়েছে। কোনটার কথা বলছেন?

আজহার: ওই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই। নতুন দ্রুতগতির ইডেনের পিচে যেটা করেছিলাম ক্লুজনারকে পিটিয়ে। ওটার কথা বলছি। ওটাও আমার খুব প্রিয় ইনিংস। আমার কাছে সেই ইনিংসের গুরুত্ব বেশি, যা বোলারদের শাসন করে খেলা হয়েছে। সেই কারণে ইডেনে অভিষেকের সেঞ্চুরিটাকে আমি ভাল বলি না। অনেক বল নিয়েছিলাম সেঞ্চুরিটা করতে গিয়ে। দর্শকরা নিশ্চয়ই খুব ‘বোর্‌ড’ হয়েছিল।

প্র: সচিনের সঙ্গে কেপ টাউনের সেই পার্টনারশিপটার দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয়?

আজহার: আমার কেরিয়ারের অন্যতম সেরা পার্টনারশিপ। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

প্র: সচিন আপনাকে কী বলছিল? আপনি সচিনকে কী বলছিলেন?

আজহার: কথাবার্তা খুব একটা বলছিলামই না আমরা। দু’জনে শুধু ব্যাটিং উপভোগ করে যাচ্ছিলাম। দু’জনেই সে দিন ব্যাটিং করে খুব মজা পাচ্ছিলাম, এটা বোঝাই যাচ্ছিল।

প্র: সেই ইনিংসটার সেরা স্মৃতি কী? কোনও শট বা কোনও মুহূর্ত?

আজহার: বিরতিতে নেলসন ম্যান্ডেলা দেখা করেছিলেন দু’দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে। সেটাই আমার কাছে সেরা স্মৃতি। ফিরে তাকালে ওই ছবিটা এখনও এত জীবন্ত মনে হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছি, পরিচিত হচ্ছি। সারা জীবনের সেরা প্রাপ্তি ওই মুহূর্তটি।

ফ্ল্যাশব্যাক: কেপ টাউনে সেই ভয়ঙ্কর মহম্মদ আজহারউদ্দিন।

প্র: কেপ টাউনে প্রথম টেস্ট খেলতে নামছে বিরাট কোহালির ভারত। আপনার পরামর্শ কী? আপনার সেই ইনিংসের মতো কাউন্টার অ্যাটাক স্ট্র্যাটেজিই কি নেওয়া উচিত?

আজহার: আমার মনে হয় না, শুধু কাউন্টার অ্যাটাকের উপর ভরসা করতে হবে। ভারতের এই দলটা কিন্তু বেশ ভাল। আমার তো মনে হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে আমরা এ বার ভাল দল। ওদের পক্ষে মোটেও সহজ হবে না। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি, দক্ষিণ আফ্রিকা কেমন উইকেট তৈরি করে, তা দেখার জন্য। এমনিতে ওখানে ফাস্ট, বাউন্সি উইকেট হয়। বল সিম করে। এ বার কিন্তু আমাদেরও ভাল পেস বোলার আছে। তাই সিমিং উইকেট দেওয়ার আগে ওরাও দু’বার ভাববে।

প্র: আপনি বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে ভারত ভাল দল?

আজহার: হ্যাঁ, বলছি। ব্যালান্সটা দেখুন। যেমন ব্যাটিং, তেমন বোলিং। আবার বোলিংয়ে দারুণ পেস আক্রমণ যেমন আছে, তেমনই শক্তিশালী স্পিন বোলিং বিভাগ। দুর্দান্ত ফিল্ডিং ইউনিট। অলরাউন্ডার হিসেবে হার্দিক পাণ্ড্য রয়েছে। মানে সমস্ত দিক থেকেই খুব সম্পূর্ণ একটা দল। দক্ষিণ আফ্রিকার এ বি ডিভিলিয়ার্স অনেক দিন পরে টেস্ট দলে ফিরছে। ফ্যাফ ডুপ্লেসি-ও চোটের জন্য বাইরে ছিল। শুনছি, ডেল স্টেন-কে নিয়েও নাকি ওরা বিভ্রান্ত যে, খেলাবে কি খেলাবে না। স্টেন-ও প্রায় পনেরো মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে রয়েছে। একদিন ম্যাচের মধ্যে না থাকলে কিন্তু সহজ নয় ফেরাটা।

প্র: ভারতের ব্যাটিংয়ের দিক থেকে কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

আজহার: আমার মনে হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে ওপেনিং পার্টনারশিপ। যদি শুরুটা ভাল করে দিতে পারে আমাদের ওপেনাররা, তা হলে আমাদের বড় স্কোর তোলার খুব ভাল সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। বিরাট কোহালি এই দলটার ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বড় তারকা, সন্দেহ নেই। কিন্তু একা একজন ব্যাটসম্যানের উপর ভর করে বিদেশে সিরিজ জেতা সম্ভব নয়। আর সেটা হওয়ার কথাও নয়। ভারতীয় দলে আরও ভাল ব্যাটসম্যান আছে। চেতেশ্বর পূজারা আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভাল খেলে এসেছে। অজিঙ্ক রাহানে আছে। বিদেশের কঠিন পরিবেশে যার রেকর্ড খুব ভাল। দেশের মাঠের চেয়েও রাহানের বিদেশে রেকর্ড ভাল। ভারত কী প্রথম একাদশ নামায়, সেটাও দেখতে হবে।

প্র: ওপেনার কাকে খেলানো উচিত? শিখর ধবন তো ফিট হয়ে গিয়েছেন। আপনি অধিনায়ক থাকলে শিখর-কে খেলাতেন?

আজহার: শিখর যদি ফিট থাকে, অবশ্যই খেলাতাম। ওপেনিংয়ে তা হলে ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশনটাও পেয়ে যাচ্ছে দল। প্রতিপক্ষ বোলারদের ছন্দ নষ্ট করার জন্য সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, মুরলী বিজয় আর শিখর ধবনের-ই ওপেন করা উচিত।

প্র: রাহানের বিদেশের ফর্মের কথা বলছিলেন। পাঁচ নম্বরে কি তা হলে রাহানে-কেই খেলানো উচিত?

আজহার: এটা টিম ম্যানেজমেন্টের উপর নির্ভর করবে। রাহানের বিদেশে রেকর্ড ভাল কিন্তু হালফিলে ও রানের মধ্যে নেই। বিদেশে এত বড় সিরিজের প্রথম টেস্টে ক্যাপ্টেন কিন্তু আত্মবিশ্বাসী সৈন্য চাইবে। রানের মধ্যে থাকা ব্যাটসম্যান প্রাধান্য পেলে তাই অবাক হওয়ার নেই।

প্র: রোহিত শর্মা-কে কি খেলানো উচিত দক্ষিণ আফ্রিকায়?

আজহার: ইয়েস, ইয়েস। হোয়াই নট? রোহিত খুব ভাল ফর্মে রয়েছে। দেশের মাটিতে হোক না, তবু তো প্রচুর রান করে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। খেলানো যেতেই পারে। তবে আমি জানি না, পাঁচ বোলারে ওরা খেলবে নাকি চার বোলারে। আমি মনে করি, পাঁচ বোলারেই খেলা উচিত। তখন একজন ব্যাটসম্যান কমিয়ে হার্দিক পাণ্ড্য-কে খেলানো উচিত অলরাউন্ডার হিসেবে। আমার মনে হয় সেটাই সবচেয়ে ভাল কম্বিনেশন কেপ টাউনের জন্য। তবে হার্দিক-কে ব্যাটসম্যান হিসেবে খুব ভাল করতে হবে এই কম্বিনেশনকে সফল করার জন্য।

প্র: পঁচিশ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকায় কখনও সিরিজ জেতেনি ভারত। কেন এই সফরটা সবচেয়ে কঠিন?

আজহার: এক কথায় বলতে গেলে, ধারাবাহিকতার অভাব। শুধু কয়েকটি অধ্যায়ে আমরা হয়তো ভাল খেলেছি দক্ষিণ আফ্রিকায়। ঝলকই দেখা গিয়েছে, ধারাবাহিকতা কখনও ছিল না। সিরিজ জিততে গেলে টানা ভাল খেলে যেতে হবে। সেটা কখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনও ভারতীয় দল করে দেখাতে পারেনি। আর একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনটে বিভাগেই তুখোড় হতে হবে।

প্র: আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে হবে?

আজহার: আগ্রাসী হতেই পারে। কিন্তু শুধু সেটা হলেই জেতা যাবে না। অতীতের মতো কয়েকটি পর্বে ভাল ক্রিকেটের ঝলক না দেখিয়ে ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলতে হবে। ওটাই আসল। আর আমি খুব আশাবাদী এই টিমকে নিয়ে। আমি মনে করি, ওরা পারবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন