মহারণের আগে একান্ত সাক্ষাৎকারে শাস্ত্রী

ছেলেরা তৈরি, নামবে জেতার জেদ নিয়েই

হারলেও কোনও অজুহাত দেবে না তাঁর দল। ‘পুওর ট্র্যাভেলার্স’ তকমা ছুড়ে ফেলে দিতে চান। রক্ষণাত্মক খোলসের মধ্যে গুটিয়ে না-গিয়ে জেতার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামতে চায় বিরাট-বাহিনী। চ্যালেঞ্জ উদ্বেগের কারণ নয়, একটা সুযোগ।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ০৪:১৫
Share:

হারলেও কোনও অজুহাত দেবে না তাঁর দল। ‘পুওর ট্র্যাভেলার্স’ তকমা ছুড়ে ফেলে দিতে চান। রক্ষণাত্মক খোলসের মধ্যে গুটিয়ে না-গিয়ে জেতার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামতে চায় বিরাট-বাহিনী। চ্যালেঞ্জ উদ্বেগের কারণ নয়, একটা সুযোগ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহারণের সিরিজ শুরু হওয়ার আগের দিন বার্মিংহাম থেকে ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ রকমই একগুচ্ছ শপথের কথা শোনালেন হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। বোঝা গেল, শাস্ত্রী-কোহালি যুগে কোন নতুন হাইওয়ের খোঁজে রয়েছে ভারতীয় দল!

Advertisement

প্রশ্ন: ব্লকবাস্টার সিরিজ বলা হচ্ছে এটাকে। টিম ইন্ডিয়ার লক্ষ্য কী?

রবি শাস্ত্রী: সাদা বলে আমরা সর্বত্র পারফর্ম করে দেখিয়েছি। একই জিনিস করে দেখাতে চাই লাল বলের ক্রিকেটে। টিম হিসেবে আমরা একমত যে, সেরা মানে সব পরিবেশে, সব রকম পরিস্থিতিতে সেরা হতে হবে। যেমন মুম্বইয়ে সেরা, তেমন লন্ডনে সেরা হতে হবে, তেমনই যেন জোহানেসবার্গে সেরা হই।

Advertisement

প্র: সেই কারণেই হোম-অ্যাওয়ে প্রথায় আর বিশ্বাস করছে না এই দল?

শাস্ত্রী: ইয়েস, হোম-অ্যাওয়ে ধারাণাটা ছেড়ে আমরা বেরিয়ে আসতে চাইছি। প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গিয়েছে আগেই। শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও একই মনোভাব নিয়ে আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম। ভাবিনি যে, বিদেশের মাঠে খেলতে এসেছি। ক্রিকেট বিশ্বে কেউ এখন ‘গুড ট্র্যাভেলার্স’ নেই। যে যার নিজের দেশেই ভাল খেলছে। বিদেশের এই সীমানাটা আমরা অতিক্রম করতে চাই। সব রকম পরিবেশে সেরা হতে চাই। টিমের বৃহত্তর লক্ষ্য সেটাই।

প্র: এখনও পর্যন্ত ফলাফল কী রকম?

শাস্ত্রী: আমরা ঝলক দেখিয়েছি। সমস্যা হচ্ছে, কিছু লোক দেখেও দেখতে পায় না। শ্রীলঙ্কায় আমরা দু’বার সিরিজ জিতলাম। বলা হল, দুর্বল প্রতিপক্ষ। অথচ চব্বিশ বছর দুর্বল দেশে কেউ তো সিরিজ জেতেনি ভারতের। কেউ মনে রাখেনি অস্ট্রেলিয়ার মতো দল শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কী ভাবে দুরমুশ হয়েছিল। এ বার দেখুন, দক্ষিণ আফ্রিকার কী হাল হল! সেই একই তো টিম শ্রীলঙ্কার। তার পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরা জিতিনি ঠিকই। কিন্তু সবাই মানবে, সিরিজ খুব হাড্ডাহাড্ডি ছিল। ওয়ান্ডারার্সে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের সুবিধের জন্য আগুনে পিচ বানিয়েছিল। বল লাফাচ্ছে, ছুটছে দ্রুতগতিতে। সেই পিচে উল্টে আমরাই জিতলাম।

প্র: বার্মিংহামে শুরু টেস্ট সিরিজকে কী ভাবে দেখতে চাইছে টিম?

শাস্ত্রী: বিদেশের মাঠে আরও এক বার নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ হিসেবে দেখছি আমরা। ছেলেদের মনোভাব এখন এ রকমই। প্রত্যেকটা সফর নিজেদের প্রমাণ করার একটা মঞ্চ। বিদেশ সফরে এসে কখনও আমাদের ছেলেদের বলতে শুনবেন না যে, এটা নেই, ওটা নেই। এটা পাচ্ছি না, সেটা পাচ্ছি না। ও সব দিন শেষ। বিদেশ সফরকে আমরা ‘কমপ্লেন বুথ’ করে তুলতে চাই না, উপভোগ করার জায়গা হিসেবে দেখতে চাই।

প্র: ভারতের ক্রিকেটভক্তরা ফলও চায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় লড়াই করলেও সিরিজ হারতে হয়েছে। তা নিয়ে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।

শাস্ত্রী: সমালোচনার উপরে নির্ভর করে আমাদের লক্ষ্য স্থির করব না। টিমের মনোভাব খুব পরিষ্কার— ভয়ডর না রেখে মাঠে নামা। আর আমরা জেতার জন্যই খেলতে নামব। বিদেশে এসেছি বলে খোলসে ঢুকে ম্যাচ বাঁচানোর চেষ্টা করব— এই মানসিকতা নিয়ে এই টিম খেলতে নামবে না। আমার কাছে ‘অ্যাপ্রোচ’টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফল অবশ্যই চাই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ফল পেতে গেলে সবার আগে দরকার সঠিক মানসিকতা। ২০১৪-’১৫ মরসুমের সেই অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে আমি এই এক কথা বলে আসছি।।

প্র: টেস্টের এক নম্বর দল ভারত। দেশের মাটিতে দুরন্ত ইংল্যান্ড। কত বড় চ্যালেঞ্জ? কতটা তৈরি ভারত?

শাস্ত্রী: নিঃসন্দেহে টেস্ট ক্রিকেটের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটা। কিন্তু একটা কথা বলে দিতে চাই—এই ভারতীয় দল চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসে। যত দিন এই দলটার দায়িত্বে আছি, একটা জিনিস আমাকে সব চেয়ে মুগ্ধ করেছে। চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে ওরা কেউ নেতিবাচক ভাবনায় গুটিয়ে যায় না। বরং তেতে উঠে সবাই বলতে শুরু করে যে, চলো, শৃঙ্গটা জয় করতে হবে। শুনুন, চ্যালেঞ্জকে দু’ভাবে দেখা যায়। এক) ওরে বাবা রে, কী হবে, কী হবে! এবং দুই) বিশ্বকে দেখানোর সুযোগ, আমি যোগ্য। কেন আমি আজ এই জায়গাটায় পৌঁছেছি। প্রত্যেকটা চ্যালেঞ্জ নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করার সুযোগ। এই ভারতীয় দলটা কিন্তু দ্বিতীয় পথের পথিক।

প্র: বিশ্বের নজর ভারত অধিনায়কের দিকে। গত বার ইংল্যান্ডে ব্যর্থ হওয়ায় এ বার কি আরও বেশি দায়িত্ব পড়ছে বিরাট কোহালির কাঁধে?

শাস্ত্রী: ২০১৪ অনেক পুরনো ঘটনা। চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বিরাট কোহালির পৃথিবীতেও যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই সকলে জানে। এখন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান কে, এই প্রশ্ন করলে কার নাম সবার প্রথমে মাথায় আসে? বিরাট চ্যালেঞ্জ ভালবাসে। ওকে কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে, যত বড় চ্যালেঞ্জ, তত যেন প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে বিরাট। ইংল্যান্ড কেন, পৃথিবীর সর্বত্র ও ভাল খেলতে চায়। রান করতে চায়। জিততে চায়। আমার মনে হয় না, চার বছর আগের পুরনো সিরিজের কথা ভেবে ও নিজেকে এই সিরিজের জন্য তৈরি করছে। ২০১৪-র ইংল্যান্ড নয়, বিরাটের ফোকাস ২০১৮-র ইংল্যান্ডের উপরে। বিরাট কিন্তু অতীত বা ভবিষ্যৎ নয়, এক্ষুনি হাতের সামনে থাকা মুহূর্তটাকে দেখতে ভালবাসে।

প্র: অস্ট্রেলিয়ায় চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করার সেই সিরিজে আপনি বিরাটকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে দাঁড়াও। মিচেল জনসনদের পেসটা ঠিক খেলে দিতে পারবে, কিন্তু এই পরিবর্তনটা করলে সুইং সামলাতে সুবিধে হবে। দারুণ কাজে দিয়েছিল সেই টোটকা। এ বারে অধিনায়ককে আপনার পরামর্শ কী?

শাস্ত্রী: বলেছি এটাই যে, খুব বেশি মরিয়া হয়ে ওঠার দরকার নেই। খুব জোরজার করে নিজেকে বলার দরকার নেই যে, এটা আমার টার্গেট, এটা আমার চাই-ই। যত পারো স্বাভাবিক থাকো, রিল্যাক্সড থাকো। অহেতুক বেশি ভাবতে বসে ব্যাপারটাকে খুব জটিল করে ফেলার মানে হয় না।

প্র: কারও কারও মনে সংশয় জাগছে, ভারতীয় দলের টেস্ট সিরিজের প্রস্তুতিটা ঠিক হল কি না!

শাস্ত্রী (থামিয়ে দিয়ে): আমরা খুশি। সিরিজে যা-ই ঘটুক, এই টিমের কেউ এক বারের জন্যও অভিযোগ করবে না। কখনও শুনবেন না কেউ এসে ঘ্যানঘ্যান করছে, অমুক ছিল না, তমুক ছিল না। ইংল্যান্ডে যথেষ্ট সময় কাটিয়েই আমরা টেস্ট সিরিজে খেলতে নামছি, তাই সকলেই বেশ উৎসাহী। আমরা টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর, দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান আমাদের দলে (কোহালিকেই বোঝাতে চাইলেন) রয়েছে। আমরা অভিযোগ

করতে যাবই না কেন?

প্র: বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডে আসা ভারতীয় দলগুলির মধ্যে এ বারেরটা অন্যতম সেরা। হেড কোচ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বিশ্বের সর্বত্র হয় খেলেছেন, নয় কমেন্ট্রি করেছেন, নয়তো কোচিং করাচ্ছেন। তিনি কি একমত?

শাস্ত্রী: হেড কোচের পক্ষে এখনই এই মন্তব্যটা করা ঠিক হবে না। সময় বলবে। এই দলটা ভারতের অন্যতম সেরা কি না, সেটা সিরিজ শেষ হলেই বলা সম্ভব। তবে হ্যাঁ, ভারতের সেরা হওয়ার ক্ষমতা এই দলটার আছে।

প্র: এই সিরিজটাকে বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের সুইং মাস্টারদের সঙ্গে ভারতের ব্যাটিং তারকাদের লড়াই। আপনার কী মনে হচ্ছে?

শাস্ত্রী: আমাদের ব্যাটিংয়ের উপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে। ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকতা দেখাতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। ছোট ইনিংসকে বড় ইনিংসে পরিণত করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমরা বড় ইনিংসের প্রতিশ্রুতি দেখিয়েও কম স্কোরে অলআউট হয়ে গিয়েছি। সেই ভুল করা চলবে না। ক্রিজে থিতু হতে পারলে লম্বা ইনিংস খেলে আসতে হবে। টিমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তখন তাকেই নিতে হবে। ইংল্যান্ডের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই আসল পরীক্ষা। সেটা একা বিরাট নয়, আমাদের সব ব্যাটসম্যানকেই দিতে হবে। প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে যদি দু’জনও শুরুতে ছন্দ পেয়ে যায়, আমাদের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।

প্র: দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিল তিন টেস্টের সিরিজ। এখানে পাঁচ টেস্টের। তাতে কি কোনও সুবিধে হবে?

শাস্ত্রী: তিন হোক বা পাঁচ টেস্ট, মন্ত্র তো সেই একটাই— নিজের সেরাটা দেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল থেকে ম্যাচ বার করো। আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডে শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রথম দু’টো টেস্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিরিজে প্রভাব সৃষ্টি করতে গেলে সিরিজের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে নিজেদের শক্তি আর যোগ্যতার ছাপ ফেলতেই হবে।

প্র: অনেকে বলছেন, এত ভাল পেস বোলিং আক্রমণ নিয়ে আর কোনও ভারতীয় দল কখনও ইংল্যান্ডে আসেনি। বোলিংয়ের এই বৈচিত্র কি ভারতকে এগিয়ে রাখছে?

শাস্ত্রী: শুনুন, কাগজে-কলমে এগিয়ে থাকায় আমি বিশ্বাসী নই। মাঠে নেমে পারফর্ম করে বোঝাতে হয় যে, কারা বেশি শক্তিশালী। আমাদের পেসারদের বুদ্ধি করে বল করতে হবে। ইংল্যান্ডে বল ‘মুভ’ করে, তাই সঠিক লেংথে বল করাটা এখানে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে এখানে পেসারদের জন্য আদর্শ লেংথ আলাদা। সেটা মাথায় রেখে বল করতে হবে আমাদের পেসারদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন