সান দিয়েগো থেকে রড লেভারের সাক্ষাৎকার

হঠাৎ আবিষ্কার করি প্রেমজিৎ নিজেই নার্ভাস

বুধবার সকাল ছটায় তাঁকে ফোনে ধরা গেল! ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো-তে তখন সময় মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা। বহু বছর হল প্রিয় অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আমেরিকার বাসিন্দা। থাকেন সান দিয়েগো থেকে কাছে পুঁচকে একটা শহর কার্লসবাড-এ। যেখানে মহাসমুদ্রের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ে বালির ওপর। যেখানে মেঘের রং গাঢ় নীল। যেখানে আপাত নিস্তব্ধতাই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে সবচেয়ে বড় রিল্যাক্সেশন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন তাঁরই নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে। সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ার হিসাবে তাঁর স্বীকৃতি পৃথিবী জুড়ে। তবু তিনি রডনি জর্জ লেভার মিডিয়া এবং প্রচার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁর যেন টেনিস রেকর্ডেই সব বলা হয়ে গিয়েছে যে, চল্লিশ বছর হতে চলল আমার দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যামের রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারল না...বুধবার সকাল ছটায় তাঁকে ফোনে ধরা গেল! ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো-তে তখন সময় মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা। বহু বছর হল প্রিয় অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আমেরিকার বাসিন্দা।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:৪৮
Share:

এই প্রজন্মের দুই মহাতারকার সঙ্গে।

বুধবার সকাল ছটায় তাঁকে ফোনে ধরা গেল! ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো-তে তখন সময় মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা। বহু বছর হল প্রিয় অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আমেরিকার বাসিন্দা। থাকেন সান দিয়েগো থেকে কাছে পুঁচকে একটা শহর কার্লসবাড-এ। যেখানে মহাসমুদ্রের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ে বালির ওপর। যেখানে মেঘের রং গাঢ় নীল। যেখানে আপাত নিস্তব্ধতাই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে সবচেয়ে বড় রিল্যাক্সেশন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন তাঁরই নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে। সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ার হিসাবে তাঁর স্বীকৃতি পৃথিবী জুড়ে। তবু তিনি রডনি জর্জ লেভার মিডিয়া এবং প্রচার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁর যেন টেনিস রেকর্ডেই সব বলা হয়ে গিয়েছে যে, চল্লিশ বছর হতে চলল আমার দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যামের রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারল না...

Advertisement

প্রশ্ন: ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান। ফুটবলে পেলে। টেনিসে আপনি! এমন সব কীর্তি আপনারা গড়ে রেখেছেন যে, আজও কারেন্ট প্লেয়ারদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

লেভার: ব্র্যাডম্যানকে খেলতে দেখিনি। উনি তিরিশ-চল্লিশ দশকে খেলতেন। পেলেকে মাঠে বসে দেখেছি। দারুণ! আমার মনে হয় একটা জিনিস আমাদের তিন জনের মধ্যে কমন যে, আমরা পেশাদারি শর্তগুলো পূরণ করার পাশাপাশি মনের ফূর্তিকেও অসম্ভব গুরুত্ব দিয়েছি।

Advertisement

প্র: সে তো অনেকেই দেয়। কিন্তু কোথায় গিয়ে চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে বাকিদের তফাত হয়ে যায়?

লেভার: আমি বলব চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে ঠিক সময় সেরা খেলাটা বার করে আনার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। যত চাপ বাড়ে ততই যেন তাদের মধ্যে থেকে আরও সেরা খেলা ঠিকরে বার হয়।

প্র: সেটার রহস্য কী?

লেভার: এটা জন্মদত্ত। আমার মনে হয় না একে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে।

প্র: আপনার সম্পর্কে বলা হত, পাঁচ সেটের ম্যাচ কখনও হারেন না। আর পাঁচ সেট মানে তো অসম্ভব চাপ?

লেভার: ইয়েস, ফিফ্থ সেটে আমি নিজেকে ভেতর থেকে বলতাম, এতক্ষণ সময় যখন কোর্টে নষ্ট করলে তখন জিতে বার হওয়া ছাড়া তোমার কোনও গতি নেই। ইট ইজ নন নেগোশিয়েবল।

প্র: এটা বলা সহজ। করে দেখানো কি ততটাই কঠিন নয়?

লেভার: কঠিন নয় যদি মেন্টাল স্ট্রেংথের সঙ্গে ফিটনেসও থাকে। ফিটনেস খুব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যারি হপম্যান বলতেন, তোমার ফার্স্ট সেট খেলার সময় ফিটনেস যে অবস্থায় সেটা যদি ফিফ্থ সেটে ধরে রাখতে পারো, তা হলে তোমার মোটামুটি বেসিক খেলাটা ধরে রাখলেই জিতবে।

প্র: আধুনিক টেনিস তারকাদের সঙ্গে ফিটনেস ট্রেনার ঘোরে। ফিজিও থাকে। আপনাদের সময় সে সবের প্রশ্ন ছিল না। তা হলে আপনার ফিটনেস কী করে তৈরি হয়েছিল? জিম যেতেন?

লেভার: না, না। জিম-টিম কোথায়? টিপিক্যাল কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ রয়েছে। স্ট্রেচিং। পুশ আপস। টার্নিং। জাম্পিং। এগুলো করতাম মিনিট কুড়ি। তার পর প্র্যাকটিস শুরু করতাম বিপক্ষে দু’জনকে রেখে। এক জন বেসলাইনে থাকত। একজন নেটে। এর পর একজন লোক বাড়াতাম ও দিকে। সো কখনও খেলতাম ওয়ান ভার্সাস টু! কখনও ওয়ান ভার্সাস থ্রি। ফিটনেস ট্রেনিং বলতে এ-ই।

প্র: লেভার এবং পাঁচ সেট হলেই কলকাতা টেনিস মহল আজও হা-হুতাশ করে। বলে কলকাতার ছেলের ইতিহাস তৈরির সুযোগ আপনার কারণে অল্পের জন্য পিছলে গেল।

লেভার: মানে?

প্র: মানে প্রেমজিৎ লাল! যাঁর মেমোরিয়াল আগামী সপ্তাহে কলকাতায় আয়োজন করছেন বন্ধু জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। আপনি তার ক্রোড়পত্রে লেখাও পাঠিয়েছেন।

লেভার: ইয়েস, প্রেমজিৎ আর একটু হলে ছিটকে দিচ্ছিল আমাকে উইম্বলডন থেকে (হাঃ হাঃ)।

প্র: বললাম তো আজ সাতচল্লিশ বছর পরেও টেনিস জনতার আফসোসের অন্ত নেই যে, প্রথম দু’টো সেট প্রেমজিৎ জিতেছিলেন ৬-৩, ৬-৪। তার পর থার্ড সেটে হারলেন ৩-৬। ব্যস, বাকি দু’টো সেট কিছুই করতে পারলেন না।

লেভার: প্রেমজিৎ কিন্তু ভাল খেলত। জোরালো সার্ভ ছিল ওর। ভলিতে আসত। সে দিন যে আমার কী হয়েছিল! হয়তো ম্যাচের আগে মনে মনে আমি সিওর হয়ে পড়েছিলাম যে, এতো ইজি জিতব। অবচেতনে সেটাই কাজ করে থাকবে। বেশ কয়েকটা নেগেটিভ পয়েন্ট সে দিন আমি উইনার মারতে গিয়ে দিই যা দেওয়ার কথা নয়। থার্ড সেটে তাই নিজেকে বলতে বাধ্য হই কোর্টে বল রাখো, বল রাখো। ওকে ভুল করতে দাও। ওকে র‌্যালি করাও।

প্র: কিছু মনে করবেন না। পঞ্চাশ বছর হতে চলল। অথচ আপনি এমন ভাবে বলছেন যে পঞ্চাশ মিনিট আগে খেলা শেষ করে উঠলেন।

লেভার: ম্যাচটা আজও হুবহু মনে করতে পারি। খেলা যখন শুরু হয় তখন তেমন কোনও ভিড় ছিল না। শেষ দিকটা হঠাৎ ভর্তি হয়ে গেল।

প্র: আসলে উইম্বলডনব্যাপী নাকি রটে গিয়েছিল ইন্দ্রপতন ৪ নম্বর কোর্টে। চ্যাম্পিয়নশিপ ফেভারিট হেরে যাচ্ছে।

লেভার: প্রথমে সেটা বুঝিনি (হাসি)। পরে বুঝতে পারি ব্যাটাচ্ছেলেগুলো ভিড় জমিয়েছিল আমার হারা দেখতে (হাসি)।

প্র: ভারতীয় টেনিসপ্রেমীর ওই ম্যাচ নিয়ে একটা ঐতিহাসিক প্রশ্ন রয়েছে। যার উত্তর দেওয়ার পক্ষে আপনিই সেরা লোক।

লেভার: সেটা কী?

প্র: সেটা হল থার্ড সেটে ৩-৩ হয়ে যাওয়ার পর প্রেমজিৎ নাকি টেনশনে কাঁপতে শুরু করেন। হঠাৎ মাথায় ঢোকে যে কী হতে চলেছে।

লেভার: প্রেম নার্ভাস হয়ে পড়েছিল এটা সত্যি। আমি সেটা টেরও পেয়েছিলাম।

প্র: এর পর থার্ড সেটটা নিয়ে নেওয়াই নয়। বাকি দু’টো সেট বিনা গেমে উড়িয়ে দেন প্রেমজিৎকে। মনে মনে কি বলেছিলেন, অনেক হয়েছে? এনাফ ইজ এনাফ।

লেভার: না, না। আমি শুধু ভাবছিলাম বিপদে পড়েছি, পড়েছি। যে করে হোক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে আমায় বেরোতে হবে। ম্যাচ কোনও মতেই ছেড়ে আসা যাবে না।

প্র: রামনাথন কৃষ্ণনকে অবশ্য বাষট্টির উইম্বলডন সেমিফাইনালে আপনি স্ট্রেট সেটে হারান।

লেভার: দারুণ খেলত কৃষ্ণন। ও, প্রেমজিৎ, মুখার্জি (জয়দীপ) সবার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। কৃষ্ণন ছিল ওদের মধ্যে বেস্ট প্লেয়ার। কৃষ্ণনের ছেলেটাও বেশ খেলত। আমার আশা ছিল ও অনেক দূর যাবে।

প্র: রমেশ কৃষ্ণন।

লেভার: ইয়েস, ইয়েস রমেশ কৃষ্ণন।

প্র: ভারতীয় টেনিস সার্কিটে একটা গল্প খুব প্রচলিত আছে যে, কোনও ম্যাচে রমেশকে খেলতে দেখে আপনি নাকি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কোর্টের পাশ থেকে চেঁচাতে থাকেন ডোন্ট টেক আ প্রিজনার, কিল হিম। সত্যি?

লেভার: হাঃ হাঃ। ইয়েস, বলতে বাধ্য হই। ও তো আমার ভাইপোর মতো। খুব স্নেহের। দেখি ছোঁড়াটা অপোনেন্টকে নিয়ে নাচাচ্ছে। কিন্তু নিজে শেষ করছে না। ওয়েট করছে কখন ওর অপোনেন্ট ভুল করে। তখনই ওকে মনে করিয়ে দিই এ সব প্রেম প্রীতি কোর্টে চলে না। সুযোগ পেয়েছ কী লাশ নামাও।

প্র: অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি আজও আপনি কী পরিমাণ শ্রদ্ধেয়। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের স্টেডিয়ামটাই তো রড লেভার এরিনা। তা হলে আপনি এই দূর মুলুক ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়ে রয়েছেন কেন?

লেভার: বহু বছর হল এখানেই থাকি। আমার পার্টনার এখানকার (স্ত্রী মারা গিয়েছেন)। আমার ছেলের বয়স এখন ছেচল্লিশ। সে এখানে থাকে। আমি তাই এখানে থাকি। খুব সুন্দর জায়গা কার্লসবাড। মহাসাগরের ধারে চলে যাই। রোদ পোহাই। রিল্যাক্স করি। ঝঞ্ঝাযুক্ত যুদ্ধের দিনগুলো তো বহু বছর পিছনে ফেলে এসেছি।

প্র: তার মানে টেনিসে মিস্টার অস্ট্রেলিয়া কি এখন আমেরিকান সিটিজেন?

লেভার: না, সিটিজেনশিপ নিইনি।

প্র: মানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণে আপনার কোনও ভূমিকা ছিল না?

লেভার: নাহ (হাসি)। আমি ট্রাম্পের ভাল বা খারাপ কোনও কিছুতেই ছাপ ফেলতে পারিনি।

প্র: নিজের দেশকে মিস করেন না? বিশেষ করে আজও যেখানে আপনার জন্য এত আবেগ।

লেভার: অস্ট্রেলিয়া যাই তো। জানুয়ারিতে যাই প্রত্যেক বছর। দু’মাসের জন্য।

প্র: ব্র্যাডম্যানকে চিনতেন?

দ্বিতীয় ও শেষ অংশ শুক্রবার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন