ফুটবল বিশ্বে কলঙ্কের ভোর

হোটেলে ঘুম ভাঙিয়ে পাকড়াও ফিফা-কর্তাদের

লুই ফিগো আগাম আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কি না, কে জানে। দিন কয়েক আগে পর্তুগিজ মহাতারকা যখন ফিফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে না লড়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন, ফুটবল বিশ্বের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। কারণ ফিগো প্রথমে বলেছিলেন, সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁকে দেখা যাবে দীর্ঘ দিনের দুর্নীতি থেকে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থাকে ‘জঞ্জালমুক্ত’ করতে। আচমকাই মত বদলান ফিগো। এবং পরিবর্তিত ঘোষণায় দু’টো কথা বলে যান।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

জুরিখে সাংবাদিক বৈঠকে ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার। রয়টার্সের ফাইল চিত্র।

লুই ফিগো আগাম আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কি না, কে জানে।

Advertisement

দিন কয়েক আগে পর্তুগিজ মহাতারকা যখন ফিফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে না লড়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন, ফুটবল বিশ্বের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। কারণ ফিগো প্রথমে বলেছিলেন, সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে লড়বেন। তাঁকে দেখা যাবে দীর্ঘ দিনের দুর্নীতি থেকে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থাকে ‘জঞ্জালমুক্ত’ করতে। আচমকাই মত বদলান ফিগো। এবং পরিবর্তিত ঘোষণায় দু’টো কথা বলে যান।

এক, সেপ ব্লাটার একজন ‘একনায়ক’ ছাড়া আর কিছু নন। কেউ কেউ নাকি এমন আছে, যারা আজ ফিফা মহাকর্তাকে ‘শয়তান’ বলবে, কাল বলবে ‘যিশু’! এবং দুই, ফিফার নির্বাচনী ময়দানে নেমে তিনি যে দুর্নীতি দেখেছেন, তা জনসমক্ষে বলা সম্ভব নয়। তার চেয়ে নির্বাচন না লড়াই ভাল।

Advertisement

কে জানত, ফিগোর আশঙ্কা এত দ্রুত কর্কশ বাস্তব হয়ে গোটা পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে! ফিফার দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট সহ সাত মুখ্য কর্তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাবে সুইৎজারল্যান্ড পুলিশ। পরে অভিযুক্ত তালিকায় জুড়ে যাবেন আরও দু’জন! অভিযোগ, কুড়ি বছর ধরে দুর্নীতি, অবাধে উৎকোচ নেওয়া। রিখটার স্কেলে এই ফুটবল-কম্পনের তীব্রতা এতটাই যে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে রাশিয়া এবং কাতার বিশ্বকাপের। প্রশাসনিক কলঙ্কের মানদণ্ডে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের সঙ্গে লোকে মিলিয়ে দিচ্ছে সেপ ব্লাটারকে! প্রথম জন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডের অপসারিত প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় জন, ফুটবল-পৃথিবীর বর্তমান অধীশ্বর। লোকে বলছে, দু’জনেই সমান দুর্নীতিপরায়ণ। সমান কলঙ্কিত চরিত্র।

ব্লাটারকে আবার ‘নিরো’ বলেও অভিহিত করা শুরু হয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। প্রথমত তিনি গোটা ঘটনাক্রম দেখে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। উল্টে ফিফা মুখপাত্র ওয়াল্টার ডি’গ্রেগরিও এ দিন বলে দেন, ‘‘ব্লাটার বেশ রিল্যাক্সড আছেন! আর ফিফার পক্ষে এটা ভালই হল। ঘটনাটা মেনে নেওয়া কঠিন, কিন্তু বোঝা গেল ফিফা একদম ঠিকঠাক এগোচ্ছে!’’ যার অর্থ বোধগম্য হচ্ছে না ফুটবল পৃথিবীর। তারা বুঝে পাচ্ছে না, ব্লাটার এত শান্ত থাকছেন কী ভাবে? যেখানে তাঁর ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এটাও বুঝে পাচ্ছে না, এক ঝাঁক ফিফা কর্তাকে পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়া কী করে ‘ভাল ব্যাপার’ হতে পারে?

ঘটনার সময়— বুধবার ভোর ছ’টা। স্থান— জুরিখের বিলাসবহুল হোটেল। জমায়েতের প্রেক্ষাপট— ফিফার বার্ষিক সভা। পুরো হোটেল ঘুমে ডুবে। নিঃশব্দে বেশ কিছু সাদা পোশাকের পুলিশ ঢুকে পড়ে হোটেলে। বাকি হোটেল বোর্ডাররা তো ননই, ঘুমন্ত ফিফা কর্তারাও টের পাননি। জুরিখ পুলিশ হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে রুম নম্বর নিয়ে সোজা সংশ্লিষ্ট কর্তাদের ঘরে ঢুকে তাঁদের একে একে হেফাজতে নিয়ে নেয়! এমনকী এক জনকে তাঁর লাগেজ-টাগেজ সমেত বার করে আনা হয় হোটেল থেকে।

লাভাস্রোতের মতো খবরটা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় স্রেফ কয়েক ঘণ্টা। এবং তিনটে আগুনে প্রশ্ন উঠে পড়ে।

এক, গ্রেফতার হওয়ার ফিফা কর্তাদের মধ্যে সেপ ব্লাটার নামক ভদ্রলোক আছেন কি না।

দুই, রাশিয়া এবং কাতার বিশ্বকাপের এর পর ভবিষ্যৎ কী? এই দুই দেশকে বিশ্বকাপ দেওয়ার পিছনেও কোনও দুর্নীতির কাহিনি আছে কি না।

তিন, কুড়ি বছর ধরে যদি দুর্নীতি চলে থাকে, তা হলে আজ প্রকাশ্যে এল কেন? ফিফা নির্বাচনের দু’দিন আগে কেন?

এর পরেও ফিফার ‘মুখরক্ষা’ বলে যদি আদৌ কিছু থাকে, সেটা হল অভিযুক্তের তালিকায় ব্লাটারের নামটা এখনও পর্যন্ত না ওঠা। যে সাত জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে সুইৎজারল্যান্ডের পুলিশ, তাঁদের মধ্যে ফিফা-র দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেফ্রি ওয়েব এবং ইউজিনিও ফিগুয়ের্দো আছেন। আছেন ব্রাজিল ফুটবল সংস্থার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসে মারিয়া মারিন, ফিফার এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্য এডুয়ার্ডো লি, ‘কনমেবল’-এর একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য রাফায়েল এসকুইভিল, প্রাক্তন ফিফা ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাক ওয়ার্নার এবং প্রাক্তন ‘কনমেবল’ প্রেসিডেন্ট নিকোলাস লিওজ। এঁরা ছাড়াও অভিযুক্ত করা হয়েছে ফিফা-র ডেভেলপমেন্ট অফিসার জুলিও রোখা এবং ‘কনকাকাফ’ প্রেসিডেন্টের সহকারী কোস্টাস টাক্কাস-কে। এই তালিকায় ব্লাটার এখনও নেই, কিন্তু কোনও নিশ্চয়তাও নেই যে, ভবিষ্যতে থাকবেন না।

সুইস পুলিশ তিনটে অভিযোগ তুলেছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে— অবাধে টাকা নয়ছয় করা, টাকা তোলা ও অবৈধ ব্যবসা চালানো এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা। বলা হচ্ছে, স্পোর্টস মিডিয়া এবং স্পোর্টস প্রোমোশন সংস্থাগুলোর একাংশের কাছ থেকে পনেরো কোটি ডলার ঘুষ নিয়েছে ফিফা! যার পরিবর্তে ওই সংস্থাগুলো লাতিন আমেরিকায় ফুটবল টুর্নামেন্টের মিডিয়া, মার্কেটিং এবং স্পনসরশিপের স্বত্ব পেয়েছে। জুরিখে ফিফার সদর দফতরেও তল্লাশি চালিয়ে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে প্রচুর নথিপত্র। আর বুধবার আচমকা ধরপাকড়ের কারণ, ২৯ মে-র ফিফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে একই শহরের একই হোটেলে কর্তাদের একত্রিত হওয়া। যার সুবিধে নিয়েছে পুলিশ।

এই গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম খেলার অধীশ্বর ফিফা। লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের ‘ভ্যাটিকান সিটি’। আর তারাই কি না এমন দুর্নীতিতে আক্রান্ত! চমকে যেতে হয় অভিযুক্ত কর্তাদের পুরনো কীর্তিকলাপ শুনলে। মারিন যেমন। জনশ্রুতি ধরলে, ব্রাজিলীয় ফুটবলকে ধ্বংসস্তূপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাঁর ‘বিশেষ ভূমিকা’ আছে। গত বছর ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘনিষ্ঠদের ষোলো হাজার পাউন্ডের ঘড়ি বিলিয়ে ‘নামডাক’ আরও বেড়েছিল মারিনের। প্রাক্তন কনমেবল প্রেসিডেন্ট নিকোলাস লিওজ আরও এক ধাপ উপরে বোধহয়। অভিযোগ হল, তিনি নাকি ইংল্যান্ডের সঙ্গে একটা অভিনব চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ বিশ্বকাপে তাঁর ভোট ইংল্যান্ড পাবে। শুধু এফএ কাপটা তাঁর নামে করে দিতে হবে!

যা খবর, বুধবারের পর ফিফার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দু’টো তদন্ত চলবে। প্রথমটা লাতিন আমেরিকায় ফিফার দুর্নীতি নিয়ে। দ্বিতীয়টা, ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপ কী ভাবে রাশিয়া আর কাতার পেল, তা নিয়ে। ফিফা মুখপাত্র অবশ্য তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে দিয়েছেন, ‘‘রাশিয়া আর কাতার বিশ্বকাপ যেমন হওয়ার, তেমনই হবে। ফিফার অধিবেশন এবং নির্বাচন, কোনওটাই পিছোচ্ছে না।’’ মানে, আগামী ২৯ মে ফিফার প্রেসিডেন্ট পদে ব্লাটারের ফের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা আটকাচ্ছে না। ফুটবল বিশ্ব যা শুনে অবিশ্বাসে প্রশ্ন তুলছে, ফুটবলের এমন কালো দিনে ব্লাটার নির্বাচন নিয়ে ভাবতে পারছেন কী ভাবে? বিভিন্ন দেশের ফুটবল সংস্থা যেখানে আতঙ্কিত। জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ভোলফগাং নিয়ের্সবাখ বলেছেন, ‘‘ঘটনা অবিশ্বাস্য শুধু নয়, ফুটবলের চরম ক্ষতিও করে দিল।’’ এফএ মহাকর্তা গ্রেগ ডাইক প্রশ্ন তুলেছেন, নিজের ব্যর্থতার এমন চরম নমুনা পেশ করার পর ব্লাটার নির্বাচনের কথা ভাবছেন কী করে? ? যেখানে এফবিআই তদন্ত চালাচ্ছে ফিফার বিরুদ্ধে?

ঠিক—এফবিআই।

সুইৎজারল্যান্ড পুলিশ অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র। কিন্তু ‘মস্তিষ্ক’ এফবিআই। যাদের কথাতেই এমন ধড়পাকড়। শোনা যাচ্ছে, অভিযুক্তদের এর পর এফবিআই দফতরেও নিয়ে যাওয়া হতে পারে। এমনকী রাশিয়ার ক্রীড়ামন্ত্রীকে পর্যন্ত জেরা করার কথা ভাবা হচ্ছে। আসলে রাশিয়া ও কাতারের বিশ্বকাপ প্রাপ্তির নেপথ্যকাহিনিই খুঁজতে শুরু করেছিল এফবিআই। আজ নয়, তিন বছর আগে থেকে। ওই দুই আসন্ন বিশ্বকাপ তো বটেই, সেই সঙ্গে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়াটাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়— জানিয়ে দিচ্ছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল লোরেটা লিঞ্চ। বুধবার তিনি বলেছেন, ‘‘ফুটবলকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব ছিল ওঁদের। অথচ নিজেদের আখের গোছাতে তাকেই কলঙ্কিত করে গিয়েছেন ওঁরা। বছরের পর বছর, টুর্নামেন্টের পর টুর্নামেন্ট ধরে।’’

ব্লাটার-রাজের দুর্নীতি উন্মোচনে যে ভদ্রলোকের সাহায্যে অভাবনীয় গতি নিয়েছে এফবিআই তদন্ত, তাঁর পরিচয় ও অতীত জানলেও স্তম্ভিত হয়ে যেতে হবে। একেবারে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তোলা যাকে বলে বাংলায়।

ভদ্রলোকের নাম— চাক ব্লেজার। প্রাক্তন ফিফা এগজিকিউটিভ কমিটি সদস্য। মার্কিন ফুটবলের প্রসারে যাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে বলে ধরা হয়। দু’বছর আগে এই ব্লেজারকেই নির্বাসিত করেছিল ফিফা।

অপরাধ? ব্লেজার নাকি ঘুষ নিয়েছিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন