মলিনার কপালকে কুর্নিশ, সাহসকে বাহবা দিচ্ছেন প্রাক্তন কোচেরা

কেউ বলছেন, অ্যাডভেঞ্চার। ফাটকা। কারও মতে, সাহসী সিদ্ধান্ত। কারও কথায়, ফাটকা। কেউ আবার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, বিপক্ষকে ঘেঁটে দিতে অঙ্ক কষেই এমন বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল। বাহাত্তর ঘণ্টা আগের সেমিফাইনালের জোড়া গোলের মহানায়ক ইয়ান হিউম বাদ!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৫
Share:

বিশাল ফাটকা খেলে ফাইনালে।

কেউ বলছেন, অ্যাডভেঞ্চার। ফাটকা। কারও মতে, সাহসী সিদ্ধান্ত। কারও কথায়, ফাটকা। কেউ আবার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, বিপক্ষকে ঘেঁটে দিতে অঙ্ক কষেই এমন বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল। বাহাত্তর ঘণ্টা আগের সেমিফাইনালের জোড়া গোলের মহানায়ক ইয়ান হিউম বাদ! দলের মার্কি ফুটবলার হেল্ডার পস্টিগা রিজার্ভ বেঞ্চে বসে। সামিঘ দ্যুতির মতো ধারাবাহিক পিভট প্রথম এগারোয় নেই। লালরিন্দিকার একই হাল। প্রবীর দাস, জুয়েল রাজার মতো ফর্মে থাকা ভারতীয়ও জার্সি পাননি!

Advertisement

প্রথম সেমিফাইনালে আটলেট্কো কলকাতাকে উত্তেজক জয় এনে দেওয়া টিমের ন’জনকে মঙ্গলবার ফিরতি যুদ্ধে প্রথম একাদশে না দেখে বিস্মিত দেশের সফলতম কোচেরাও। সকলেই স্বীকার করছেন, তাঁরা কোনও দলকে কোচিং করাতে গিয়েই এ রকম ঝুঁকি নিতে পারেননি কখনও। জোসে মলিনা বিদেশি কোচ বলেই এটা করতে পারলেন।

ভারতের সর্বকালের সফল ক্লাব কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এ দিন টিভিতে ম্যাচ দেখে উঠে বলে দিলেন, ‘‘আমার কোচিং জীবনে কখনও এই ঝুঁকি নিতে পারিনি। মলিনার সিদ্ধান্তকে ওর অদ্ভুত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে আমার। এটাকে কলকাতার কোচের অ্যাডভেঞ্চার বলা যায়। এমনকী ফাটকাও। এই সিদ্ধান্ত।’’

Advertisement

পাঁচ বার আই লিগ জয়ী কোচ আর্মান্দো কোলাসো-ও বিস্মিত মলিনার দল নির্বাচনে! মারগাও থেকে ফোনে প্রাক্তন ডেম্পো কোচ বলেন, ‘‘আমি বিস্মিত হলেও বলব মলিনার সিদ্ধান্তটা কিন্তু সাহসী সিদ্ধান্ত। এটাই মুম্বইকে আজ পুরো ঘেঁটে দিয়েছিল। পস্টিগা নেই, হিউম নেই, দ্যুতি নেই এটা ভাবতেই পারেনি বিপক্ষ। ফলে ওদের প্ল্যান ‘বি’ ভাবতে হয়েছে মাঠে নেমেই। আর মলিনার অঙ্কটা কাজে লেগে গিয়েছে। ওকে একশোয় একশো দশ দেব আমি। এটিকে ছিটকে গেলে তো সবাই গালাগাল দিত কোচকেই।’’ মোহনবাগানকে দু’বার আই লিগ জেতানো কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের সাফ কথা, ‘‘নিঃসন্দেহে সাহসী সিদ্ধান্ত মলিনার। এ রকম সচরাচর দেখা যায় না। তবে বিদেশি কোচ বলেই এটা ও করতে পেরেছে। ওদের তো আইএসএলে কোচিং করাতে এসে হারানোর কিছু নেই। এই তো পুণে হেরে যেতে হাবাস স্পেনের বাড়িতে চলে গেল। কেউ গালাগালি দিয়েছে তাতে ওকে? আমি মোহনবাগান কোচ থাকার সময় এক বার টালিগঞ্জ ম্যাচে নিয়মিত ফুটবলারদের থেকে গোটা তিনেক বদল ঘটিয়েছিলাম। ম্যাচটা ড্র হয়ে গিয়েছিল। তার পর কী গালাগাল খেয়েছিলাম!’’

কলকাতায় মুম্বইয়ে হারানোর পর মলিনা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ফিরতি সেমিফাইনালে টিমে কিছু বদল ঘটাবেন। বলে রেখেছিলেন ‘‘আমার টিমে চব্বিশ জন ফুটবলার আছে। যে নামবে সেই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা রাখে। প্রথম এগারোর সঙ্গে রিজার্ভ বেঞ্চের পার্থক্য নেই।’’ তখন শুনে মনে হয়েছিল, এ রকম কথা তো নিয়মিত ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান বা ভারতীয় কোচেদের মুখ থেকে শোনা যায়! কিন্তু সত্যি সত্যিই তা করে দেখাবেন এ দিন মুম্বইয়ের মাঠে মলিনা, কেউ আন্দাজ করেননি। মুম্বইতে এটিকে শিবিরে ফোন করে জানা যাচ্ছে, টিম মিটিংয়ে মলিনার মুখে মঙ্গলবারের প্রথম একাদশের নাম শুনে প্লেয়াররা নাকি সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন। কিছু পরে এটিকে কর্তারা কোচের সিদ্ধান্ত শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। টিমের সঙ্গে যাওয়া এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল লোকটা কেন এমন পাগলামি করতে যাচ্ছে!’’ যে ম্যাচে এক গোল খেলেই ফাইনালে ওঠা ঝুঁকির হয়ে যাবে, ম্যাচ চলে যাবে অতিরিক্ত সময় বা পেনাল্টি শ্যুট আউটে, সেখানে কেন এ রকম অ্যাডভেঞ্চার? এ সব আলোচনায় এ দিন গ্যালারি ছিল মত্ত। বিরতির ঠিক আগে রেফারির লাল কার্ডে এটিকে দশজন হয়ে যাওয়ায় যে আলোচনার মাত্রা আরও বাড়ে। ‘‘আমরা বলি, ফুটবলের ঈশ্বর সাহসী কোচদের সহায় হন। সেটা আর একবার প্রমাণিত। না হলে, সুনীল ছেত্রী যে দুটো গোল আজ মিস করেছে তা পাড়া ফুটবলেও কেউ করে না। ভাগ্য মলিনার সহায় হয়েছে। তবে বাপের ব্যাটা বটে ছেলেটা,’’ সল্টলেকের বাড়িতে গভীর রাতেও ফোনে কথা বলার সময় রীতিমতো উত্তেজিত প্রবীণ পিকে। তাঁর কোচিং জমানায় দেশের সব বড় ট্রফি একাধিক বার জেতা কোচ বললেন, ‘‘আমি ডার্বিতেও ফ্রেস লেগ নামিয়েছি। তবে বড়জোর দু’টো কী তিনটে। মলিনা যা করেছে সেটা বিশ্ব ফুটবলে তো বটেই পাড়ার ফুটবলেও দেখা যায় না।’’

পিকে-র পরে ভারতীয় ফুটবলের সফলতম কোচ আর্মান্দোর গলায় আবার অঙ্কের কথা। ‘‘আমি তো ফাইনালে এটিকের জন্য গলা ফাটাব। ওরাই ফেভারিট। অ্যাওয়েতে দশ জনে অর্ধেকেরও বেশি সময় খেলে ড্র রেখে ফাইনালে ওঠা! দারুণ ব্যাপার।’’ বলার পর কোলাসোর সংযোজন, ‘‘আমি কোচ হলে মলিনার মতো মারাত্মক ঝুঁকি নিতে পারতাম না। তবে এটাও ঘটনা, ফুটবলারদের উপর মলিনার আস্থা ছিল যে, যাঁকে নামাব সে-ই ভাল খেলে দেবে। এটা কিন্তু বড় ব্যাপার।’’ আর সুব্রত বলে দিলেন, ‘‘মলিনা সাহস দেখালেও বলব, ওর কপালও ভাল। যে সব সহজ গোল মিস করেছে মুম্বই, ভাবা যায় না!’’

সাহস ছাড়া মজা কোথায়

আনন্দবাজারকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়


তারকা গ্যালারি। মঙ্গলবার মুম্বইয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, নীতা অম্বানী, অভিষেক বচ্চন ও রণবীর কপূর।

ফুটবল মানেই আগ্রাসন। এটা না থাকলে বড় ফুটবলার বা কোচ হওয়া যায় নাকি! মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের কোচ মলিনা ন’জন ফুটবলার পরিবর্তন করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে বলছি, এই সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। কোচ, খেলোয়াড়রা সাহসী না হলে তো খেলার কোনও মজাই থাকে না। আমরা এক গোলে এগিয়ে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিলাম। পাশাপাশি এটিকে প্রথমার্ধেই দশ জন হয়ে গিয়েছিল, সে জন্যই হয়তো বিরতির পর কিছুটা ডিফেন্সিভ ফুটবলের স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়েছিল কোচকে। আর এটাই তো স্বাভাবিক ছিল। তবে ইনজুরি টাইম ধরে প্রায় ৫৩-৫৪ মিনিট দশ জনের এটিকে যে ভাবে লড়াই করেছে, সেটা অসাধারণ। ফুটবলাররা দারুণ পারফরম্যান্স করেছে। তিন বছরের মধ্যে দু’বারই ফাইনালে উঠলাম। এক বার সেমিফাইনালে। এটাও কিন্তু কলকাতার কাছে বড় প্রাপ্তি। তবে ট্রফি না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। দ্বিতীয় বার আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অপেক্ষায় থাকব আমি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন