পাসিং থেকে ফিনিশ সবেতেই এগিয়ে মেসি

স্কোর আপাতত লিওনেল মেসি ৪, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ০। শনিবার গভীর রাত আর রবিবার কাক ভোরে দুই গোলার্ধে মাঠে নেমেছিলেন বিশ্ব ফুটবলের দুই কিংবদন্তি। ইউরোয় পর্তুগাল, কোপায় আর্জেন্তিনা ম্যাচে কেমন লাগল রোনাল্ডো-মেসিকে? কে কাকে কোথায় টেক্কা দিয়ে গেলেন— বিশ্লেষণে দীপেন্দু বিশ্বাসস্কোর আপাতত লিওনেল মেসি ৪, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ০। শনিবার গভীর রাত আর রবিবার কাক ভোরে দুই গোলার্ধে মাঠে নেমেছিলেন বিশ্ব ফুটবলের দুই কিংবদন্তি। ইউরোয় পর্তুগাল, কোপায় আর্জেন্তিনা ম্যাচে কেমন লাগল রোনাল্ডো-মেসিকে? কে কাকে কোথায় টেক্কা দিয়ে গেলেন— বিশ্লেষণে দীপেন্দু বিশ্বাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৯:৫৯
Share:

• ১. শক্তি প্রয়োগ
মেসি ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সেই পুরনো মেসিকেই দেখলাম। বল নিয়ে ড্রিবল করা। ছোট্ট জায়গায় ডজ করে বেরিয়ে যাওয়া। বলটা হোল্ড করে থাকা যাতে সাপোর্টিং প্লে-তে আরও লোক বাড়ে। মেসি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয় যখন বল নিয়ে ডজ করে বেরোয়। ফার্স্ট হাফের শুরুতেই দেখলাম মেসি একবার চার-পাঁচ জনকে ডজ করে এক ফ্ল্যাঙ্ক থেকে অন্য ফ্ল্যাঙ্কে আক্রমণটা নিয়ে যাচ্ছেন। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, মেসির চেঞ্জ অব পেসটা কী রকম। বল ছাড়াও মেসি দারুণ পজিশন নিচ্ছিলেন। প্রায় প্রতিটা মুভের পিছনেই ছিলেন মেসি।
রোনাল্ডো মেসি যদি শিল্প হয়, রোনাল্ডো তা হলে পাওয়ার। লং রেঞ্জ শট বা লম্বা লম্বা ডিফেন্ডারদের উপরে লাফিয়ে সঠিক টাইমিংয়ে হেড, এগুলো তো ট্রেডমার্ক রোনাল্ডো। তার উপরে নাকলবল ফ্রি-কিক। কিন্তু অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সে সব আর হল কোথায়? গোল লক্ষ্য করে দশটা শট নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু টার্গেটে তো থাকল মাত্র তিনটে। একটা শটই দারুণ ছিল, যেটা গোলকিপার বাঁচিয়ে দেয়। হেডের প্লেসমেন্টও ঠিক ছিল না, একটা বাদে। যেটা ঠিকঠাক গোলে ঢুকল, কিন্তু অফ সাইড হয়ে গেল। ফ্রি-কিকটা আবার তাড়াহুড়ো করে নিতে গেল।

• ২. ফিনিশিং
মেসি নিকোলাস গায়তানের সঙ্গে ওয়ান টু খেলে শুধু ছোট্ট একটা পাস দিয়ে বলটা জালে ঢোকালেন। বরবারের মতো বুদ্ধিদীপ্ত ফিনিশিং। সব সময় তোমায় জোরে শট মারতে হবে এমন কোনও কথা নেই। মাথাটা খাটিয়ে বল প্লেস করলে কাজটা আরও বেশি হয়। মেসির প্রতিটা ফিনিশের মধ্যেই পাওয়ারের চেয়ে টেকনিক বেশি থাকে। গোলকিপারের পায়ের মধ্যে দিয়ে বল গলানো বা লব করা, দেখতে সুন্দর লাগে। ভেনেজুয়েলার ম্যাচে ফেরার যাবতীয় সুযোগ শেষ করে দেয় মেসির গোলটা।
রোনাল্ডো পেনাল্টি নিতে দাঁড়ানো মানেই সবাই ভেবে ভেবেই নেয় গোল হচ্ছেই। রোনাল্ডো কি চাপে ছিলেন? অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ওই রকম সময় পেনাল্টি নষ্টটা দেখে তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, অতিরিক্ত চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। পেনাল্টি মিস হতেই পারে। মেসিও বহু বার করেছেন। কিন্তু টপ ফর্মের রোনাল্ডো তো পেনাল্টি মিস করলেও ওপেন প্লে থেকে গোল করতেন। রোনাল্ডো তো খুব ভাল গোল পোচারও। গোলটা চুরি করে নিতে পারেন। ঠিক সময় ঠিক জায়গায় থাকেন। কিন্তু অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সেই সুযোগসন্ধানী দৌড়গুলোই দেখা যায়নি। সোজা সোজা সুযোগও নষ্ট করেছেন। প্রথমার্ধে শুধু শটটা গোলে রাখলেই এগিয়ে যায় পর্তুগাল। কিন্তু সেটাও বাইরে।

Advertisement

• ৩. পাসিং

Advertisement

মেসি ভেনেজুয়েলা ম্যাচে আর্জেন্তিনার বেশির ভাগ আক্রমণই তৈরি হচ্ছিল মেসির পা থেকে। বারবার বল দখল করে মুভ তৈরি করছিলেন। বলের জন্য অপেক্ষা না করে বলকে তাড়া করছিলেন। এমন সমস্ত পজিশনে চলে যাচ্ছিলেন যেখান থেকে মুভ তৈরি করা যায়। ইদানীং ক্লাব ফুটবলে দেখা যাচ্ছিল, ফিনিশার মেসির থেকেও প্লে মেকার মেসি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন। বিশেষ করে জাভি বার্সেলোনা ছাড়ার পরে। কোপায় আর্জেন্তিনাকে সেমিফাইনালে তোলার ম্যাচে প্লে মেকার মেসিকেই বেশি দেখা গেল। দুর্দান্ত সব পাস বাড়িয়েছেন। প্রথম গোলের সময় হাফ লাইনের থেকে একটু উপরে উঠে এসে ইগুয়াইনের জন্য স্বপ্নের একটা পাস বাড়ালেন। ওই একটা পাসেই বোধহয় ভেনেজুয়েলা টিমটা পুরো কেঁপে যায়।

রোনাল্ডো বল বেশি না ধরলে সুযোগ কী করে তৈরি করবেন। চোট থেকে ফিরে এখনও পুরোপুরি ফিট কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল। খুব বেশি নড়াচড়া করছিলেন না। পর্তুগালে বল প্লেয়ারের অভাব নেই। কিন্তু কম্বিনেশন তৈরি করতে গেলে বলের কাছে যেতে হবে। রোনাল্ডো সেটা না করে বলের অপেক্ষায় একটা জায়গায় বেশিক্ষণ থাকছিলেন। যাঁর ফলে সহজেই মার্কড হয়ে যান। বল নিজের দখলে বেশি না রাখতে পারায় পজিটিভ মুভও তৈরি করতে পারেননি।

• ৪. সাপোর্ট

মেসি গঞ্জালো ইগুয়াইন। অ্যাঞ্জেল দি’মারিয়া। আবার দি’মারিয়ার চোট থাকলে নিকোলাস গায়তান। যেমন ভেনেজুয়েলা ম্যাচে হল। মাঝমাঠে মাসচেরানো। আবার রিজার্ভ থেকে সের্জিও আগেরো। স্বপ্নের সমস্ত সাপোর্ট আছে মেসির পাশে। আধুনিক ফুটবলের রীতি হচ্ছে, তোমার ভাল সাপোর্ট থাকলেই তুমি রাজা। মারাদোনা, ক্রুয়েফের সে সব যুগ আর নেই। ব্যক্তিগত প্রতিভার থেকে তাই জরুরি একটা ভাল টিম। মেসির আর্জেন্তিনা তো সেই জিনিসটাই। একটা সঙ্গবদ্ধ প্রতিভাবান দল। ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে দি’মারিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার ছিল না। তাতেও গায়তান কোনও সমস্যা টের পেতে দেননি। কী সুন্দর সুন্দর মুভ তৈরি করছিলেন। মেসিকে গোলের পাসটাও তো দারুণ বাড়ালেন। মেসি অসাধারণ হলেও বোঝা যাচ্ছিল, আর্জেন্তিনা পুরোপুরি এক জনের উপর নির্ভর করে নেই।

রোনাল্ডো নানি, কোয়ারেসমা, জোয়াও মারিওর মতো প্রতিভাবান ফুটবলাররা আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা আর্জেন্তাইন ফুটবলারদের ধারেকাছে নেই। অস্ট্রিয়া ম্যাচেই সেটা বোঝা গিয়েছে। যাবতীয় চাপটা তাই রোনাল্ডোর উপর পড়ছে। গোলের জন্য আর্জেন্তিনা যেখানে হয়তো ষাট শতাংশ নির্ভরশীল মেসির উপর, পর্তুগাল সেখানে প্রায় একশো শতাংশ রোনাল্ডোর দিকে তাকিয়ে। ক্লাব ফুটবলে যেটা হয় না। রিয়ালে একটা মডরিচ আছেন। একজন বেল আছেন। যাঁরা খারাপ ফর্মের রোনাল্ডোকে দিয়েও গোল করিয়ে দেবেন। কিন্তু পর্তুগালে রোনাল্ডোর সেই সাপোর্ট নেই। আর একা দলকে টানতেও পারছেন না পর্তুগিজ অধিনায়ক।

• ৫. ঘরানা

মেসি লাতিন আমেরিকান ঘরানা অনেকটা স্প্যানিশ ঘরানার মতো। পাওয়ারের থেকেও বেশি দরকার হয় স্কিল। সুন্দর সমস্ত মুভমেন্ট। খুব বেশি মারকুটে খেলা নয়। মেসিও চোট সারিয়ে কোপায় এসেছেন। কিন্তু টাফ ফুটবল নয় বলে কঠিন ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয়নি। আর্জেন্তিনা এই ঘরানাকে আরও আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। মেসি, আগেরো, ইগুয়াইনরা অনেক বেশি ডিরেক্ট করে দিয়েছে খেলাটা। ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সুযোগের পর সুযোগ তৈরি করে গিয়েছে আর্জেন্তিনা। আরও তিন-চারটে গোল হলে অবাক হতাম না। কোপায় এই মুহূর্তে আর্জেন্তিনাই সেরা।

রোনাল্ডো ইউরোপিয়ান ঘরানা অনেক বেশি ফিজিকাল ফুটবল। হাই টেম্পো। এক মিনিটও বলের উপর কেউ বিশ্রাম নিতে পারে না। পর্তুগালে যে সমস্ত ফুটবলার আছে তারা স্কিলের দিক দিয়ে ভাল হলেও ওয়ার্ক লোড নিতে পারে না। অস্ট্রিয়া অনেক বেশি উপরনীচ করে খেলছিল পর্তুগালের থেকে। এই রকম হাই টেম্পো ফুটবলে ফিটনেসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোনাল্ডো মনে হয় একশো শতাংশ ফিট নয়, তাই এ রকম হাই টেম্পোর সঙ্গে তাল রাখতে পারলেন না। ইউরোয় এখন পর্তুগাল পরের রাউন্ডে যেতে পারে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন