আর আজ থেকে কেউ বলবে না কে এই সঞ্জয় সেন

ডায়েরিতে লেখা প্রাক্তন লিভারপুল কোচ জেরার হোলিয়ারের একটা মন্তব্য পাখি পড়ার মতো আওড়ান সব সময়— কোচিং করতে এসে দু’একবার চাকরি যদি না হারাও তা হলে বড় কোচ হবে কী ভাবে। বরাবরের মাচো ইমেজ। অযথা হস্তক্ষেপে নো কম্প্রোমাইজ। প্রখর ফুটবল মস্তিষ্ক। সতীর্থদের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। বিনয়ী কিন্তু একরোখা। ব্যর্থতা হোক বা সাফল্য সব সময়ই মাথা উঁচু। অজুহাত নৈব নৈব চ। সংক্ষেপে এটাই আই লিগ জয়ী মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন।

Advertisement

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০৪:২৭
Share:

বেঙ্গালুরুর উৎসবে বাগান কোচ সঞ্জয় সেন। ছবি: এআইএফএফ

ডায়েরিতে লেখা প্রাক্তন লিভারপুল কোচ জেরার হোলিয়ারের একটা মন্তব্য পাখি পড়ার মতো আওড়ান সব সময়— কোচিং করতে এসে দু’একবার চাকরি যদি না হারাও তা হলে বড় কোচ হবে কী ভাবে।
বরাবরের মাচো ইমেজ। অযথা হস্তক্ষেপে নো কম্প্রোমাইজ। প্রখর ফুটবল মস্তিষ্ক। সতীর্থদের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। বিনয়ী কিন্তু একরোখা। ব্যর্থতা হোক বা সাফল্য সব সময়ই মাথা উঁচু। অজুহাত নৈব নৈব চ।
সংক্ষেপে এটাই আই লিগ জয়ী মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন।
তেরো বছর পর যাঁর হাত ধরে প্রথম আই লিগ এল গঙ্গাপারের তাঁবুতে। এল বাংলাতেও।
এত দিন ময়দানের ‘হুজ হু’-রা তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, কে এই সঞ্জয় সেন? ৩১ মে, ২০১৫-র পর আর হয়তো কেউ এই প্রশ্ন তুলবেন বলে মনে হয় না!
১৯৮২ থেকে ১৯৯৫ রেলওয়ে এফসির স্টপারে খেলেছেন সঞ্জয়। ফুটবলারজীবনে সে রকম মারকাটারি নাম না করতে পারলেও, সঞ্জয়ের কড়া ট্যাকলকে ভয় পেত না এ রকম ফুটবলার সেই সময় তিন বড় ক্লাবেও দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হত। চেতলার বাসিন্দা, সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র বড় দলের ডাক পেয়েছিলেন ১৯৮৯-এ। সে বার আন্তরিক ভাবে সঞ্জয়কে চেয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। কিন্তু ছোট টিম থেকে বড় দলে এসে নিয়মিত সুযোগ পাবেন কি না সেই দ্বিধায় আর লাল-হলুদে সই করা হয়নি সঞ্জয়ের।

Advertisement

এগারো দিন আগের কথা। বারাসতে রয়্যাল ওয়াহিংডো ম্যাচে জেতার পর ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের বলেছিলেন, ‘‘আজ তোমরা তিন পয়েন্ট দিলে। পরের স্পোর্টিং ম্যাচটা থেকেও তিন পয়েন্ট দাও। তার পর বেঙ্গালুরু থেকে কী ভাবে লিগ নিয়ে ফিরতে হবে সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।’’ যা শোনার পর সনি নর্ডি অবাক হয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘কোচ যে এ ভাবে চাপটা পুরো আমাদের কাঁধ থেকে নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন, তা দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম।’’

ঠিক এখানেই বিশেষত্ব আই লিগ জয়ী বাগানের বঙ্গসন্তান কোচের। সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে নিজের ফর্মের মধ্যগগনে খেলেছেন শিশির ঘোষ। এ দিন তিনি বললেন, ‘‘আমাদের সময় রেলওয়ে এফসি ছিল বড় দলের কাছে একটা ত্রাস। আর সঞ্জয় ছিল সেই টিমের এক সামুরাই যোদ্ধা। এই ধরনের ম্যাচ কী ভাবে হাসতে হাসতে ড্র করতে হয়, সেটা খেলোয়াড়জীবন থেকেই সঞ্জয়ের জানা।’’

Advertisement

ধর্মেন্দ্রর সিনেমার ভক্ত সঞ্জয় সত্যিই এক যোদ্ধা। ফুটবলার জীবনে এক দিন নিউ মার্কেটে গিয়েছিলেন কেনাকাটা সারতে। সেখানে জনৈক মহিলাকে কেউ একজন কটুক্তি করতেই প্রতিবাদ করেন সঞ্জয়। প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর মারপিট। রড, ধারালো অস্ত্র নিয়ে চড়াও হওয়া দশ জনকে একাই শুইয়ে দিয়ে সে দিন চেতলার বাড়িতে ফিরেছিলেন সঞ্জয়।

প্রতিপক্ষকে দেখলেই ধর্মেন্দ্রর মতোই ‘ম্যায় তেরা খুন পি যাউঙ্গা’ মার্কা মেজাজ সব সময়ই গনগনে সঞ্জয়ের ভেতরে। যদিও বাইরে থেকে শান্ত। বিনয়ী। সাফল্য, ব্যর্থতা কোনও কিছুই গায়ে মাখেন না। তাই মিডিয়াকে বলে দিতে পারেন, ‘‘আজ সাফল্য পাচ্ছি। কাল ব্যর্থতা আসতেই পারে।’’

বড় দলে খেলার আক্ষেপ সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে কোচিংয়ে আসা সঞ্জয়ের। এগিয়েছেনও ধাপে ধাপে। প্রথমে ছিলেন রেলওয়ে এফসি কোচ। তার পর ‘সি’ লাইসেন্স। আর ‘বি’ লাইসেন্স পাস করার পরেই কলিন টোলের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের সহকারী কোচের দায়িত্বে। সঞ্জয়ের নিজের কথায়, ‘‘কলিনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার চোখ খুলে যায়। কোচ হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার রসদ পাই।’’ এর পরেই ‘এ’ লাইসেন্স পাস। তার পর ইউনাইটেড স্পোর্টসে প্রথমে সুব্রত ভট্টাচার্যের সহকারী। তার পর পূর্ণ দায়িত্বে এসেই ডুরান্ড চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ইউনাইটেডকে।

কোচিংয়ে ইউথ ডেভলপমেন্টকে সমান গুরুত্ব দেন। তাই ইউনাইটেডের কোচের পদ থেকে সরে যাওয়ার পর গিয়েছিলেন ফেডারেশনের নিজস্ব টিম পৈলান অ্যারোজের কোচিং করাতে। তার পর মহমেডানে। তাঁর হাত ধরেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আই লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনে উঠেছিল মহমেডান। সনিদের ধানমন্ডিকে হারিয়ে গত মরসুমে আইএফএ শিল্ডও চ্যাম্পিয়ন হওয়া সঞ্জয়ের মহমেডানের। আর এ বার মরসিমের মাঝপথে মোহনবাগানের দায়িত্ব নিয়েই দেশের জাতীয় ক্লাবকে ভারত সেরা করালেন এই বঙ্গসন্তান কোচ।

কলকাতায় টিভির সামনে উন্মুখ স্ত্রী সবিতা, পুত্র সোহান। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ইউনাইটেডে সঞ্জয়ের সহকারী অঞ্জন নাথ বলছিলেন, ‘‘সঞ্জয়দা কখনও হারার আগে হারেন না। আর উনি যে দলে যান সেই দলের ডিফেন্সকে মজবুত করে দেন।’’ বাগানে সঞ্জয় সেনের সহকারী শঙ্করলাল চক্রবর্তী বা অর্পণ দে-রা বলছিলেন, ‘‘কে নেই আর কাকে পাওয়া গেল না তা নিয়ে সঞ্জয়দা কখনও কাঁদুনি গান না। আর অজুহাত দিতে পারেন না। শৃঙ্খলা ওঁর সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি। কাউকে কখনও ছোট করেন না।’’ বাগানের মহাসাফল্যের অন্যতম স্তম্ভ পিয়ের বোয়া বলছেন, ‘‘এই কোচ আমাদের সকলের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন। টিম স্পিরিট বজায় থাকে ওঁর জন্যই। ম্যান ম্যানেজমেন্ট দারুণ।’’

বাগানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হঠাৎই। দরজায় তখন কড়া নাড়ছে ফেড কাপ। শনিবারের নায়ক বেলোকে সঙ্গে নিয়েই বাগানে পা রাখা সঞ্জয়ের। ফেড কাপে না পারলেও আই লিগ দিয়ে মরসুম শেষ করে বড় ক্লাবে কোচিংয়ের প্রথম অধ্যায়টা শেষ করলেন সঞ্জয়।

আপোসহীন কোচ হিসেবেও ময়দানে সুনাম সঞ্জয়ের। ইউনাইটেডে তাঁকে সরিয়ে এলকো সতৌরিকে আনার সময় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ডাচ কোচের সহকারী হওয়ার। যা পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়ে সঞ্জয় হাতে পরবর্তী কাজ না থাকা সত্ত্বেও বলতে পেরেছিলেন, ‘‘যে কাজে নিজে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না তখন সেই কাজ করার দরকার নেই।’’

২০১২-র ঘটনা। জামশেদপুরে ফেড কাপ খেলতে গিয়ে তাঁরই দলের স্পনসর আর তাঁর পুত্রের ইন্ধনে হেনস্থার মুখে পড়েছিলেন। সে বছরই ১২ অক্টোবর টোলগে-ওডাফার মোহনবাগানকে হারানোর পর সেই টিম স্পনসর এবং তাঁর পুত্র ড্রেসিংরুমে ক্ষমা চেয়ে হাত মেলাতে এসেছিলেন। তখন হাওয়া মোরগের মতো ঘুরে না গিয়ে সোজাসুজি বলে দিয়েছিলেন, ‘‘আপনি তো স্পনসর। আপনার কথার কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই। আমার ভিত টাটা সেন্টারের মতো শক্ত। শিবালিক অ্যাপার্টমেন্টের মতো ঠুনকো নয়।’’

এ বারেও রয়্যাল ওয়াহিংডোর বিরুদ্ধে হোম ম্যাচের পর নতুন ফুটবল সচিব সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের গ্যালারিতে বসা নিয়ে মিডিয়া তাঁর কাছে প্রশ্ন তুলতেই নিজস্ব ঢঙে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘সত্য সব সময় স্বাগত। কোনও ইগো নেই। কিন্তু টিম নিয়ে যা সিদ্ধান্ত আমিই নেব।’’ এটাই সঞ্জয় সেন।

বাগানেও ফেড কাপের পর ফুটবলারদের যখন বকেয়া বেতন আর শীর্ষকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক, তখন আপোসহীন সঞ্জয়ই সাহস করে বৈঠকে বসেছিলেন সচিব অঞ্জন মিত্রর সঙ্গে। যেখানে স্পষ্ট জানতে চেয়েছিলেন ফুটবলাররা বকেয়া টাকা আর পাবেন কি না। যদি তা না হয় তা হলে তাঁর পক্ষে আর কোচিং করানো সম্ভব নয়। বাগান কর্তারা তাঁকে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ইতিবাচক আশ্বাস দেওয়ার পরেই মন দিয়েছিলেন আই লিগের জন্য ব্লু প্রিন্ট তৈরিতে।

ঘরে অবশ্য পুরোপুরি বাঙালি গৃহস্থ। স্ত্রী সবিতা আর পুত্র সোহানকে নিয়েই তাঁর জগত। ছেলের মাধ্যমিকের জন্য টানা এক মরসুম কোচিং করাননি। রবিবার ম্যাচের আগে হোটেল ছেড়ে বেরোনোর আগে ফোন করেছিলেন বাড়িতে। সেখানেই ছেলে আর স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন ট্রফি নিয়ে কলকাতা ফেরার ব্যাপারে।

এ দিন ছেলে টিভিতে খেলা দেখলেও বাগান গোল খাওয়ার পরে স্ত্রী সবিতা আর ম্যাচ দেখেননি। বাকি সময়টা ছিলেন ঠাকুরঘরে। ম্যাচের পর যোগাযোগ করা হলে বললেন, ‘‘এত দিনে ওঁর স্বপ্ন সত্যি হল।’’

বিয়ের আগে হবু স্ত্রীকে নিয়ে শাহরুখের ‘বাজিগর’ দেখতে গিয়েছিলেন বাগান কোচ। বাজিগরের মতোই হারতে হারতে শেষবেলায় গোল শোধ করে আই লিগ বগলদাবা করেই কলকাতা ফিরছেন সঞ্জয় সেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন