নেমেই নায়ক কুলদীপ। ২-২৮। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
ড্রেসিংরুমে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেলেন ইউসুফ পাঠান। জুহি চাওলা ডাকছেন, পত্রপাঠ আবার মাঠে। ঘাড়ের কাছে টিম ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে। সে আজ পাঠানোচিত বিভিন্ন পোজ চায়। আর পাঠান, ডেভিড ওয়ার্নারের হায়দরাবাদকে উড়িয়ে দেওয়া ইউসুফ পাঠান, কিছুতেই ব্যাপারটা সামলে উঠতে পারছেন না! রি-টেক নিতে নিতে ফটোগ্রাফারের হাতে ব্যথা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন যখন, রবিবারের কেকেআরের আসল এবং সোনার ছবি। ম্যান অব দ্য ম্যাচের স্মারক নিয়ে নাইট মালকিন জুহি চাওলার সঙ্গে নাচছেন পাঠান।
নাচছেন, ডোয়েন ব্র্যাভোর অতি পরিচিত চ্যাম্পিয়ন ডান্স!
ছেলেটা ক্লাবহাউসের আপার টিয়ার দিয়ে দৌড়চ্ছে তো দৌড়েই চলেছে। গালে বিশাল-বিশাল অক্ষরে কেকেআর লেখা। হাতের হলুদ ফ্ল্যাগ বারবার উড়ছে। হায়দরাবাদ উইকেট যত বার পড়ছে, তত বার। গোটা মাসের ওয়ার্কআউট আজ, শুধু একটা রবিবারেই সেরে ফেলতে চায় যেন।
চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব কী ভাবে? কলকাতা আজ তো জিতছে রে!
রবিবার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটার নাম বোধহয় গৌতম গম্ভীর। শেষ বল হয়ে গিয়েছে, নাইট ডাগআউটে এখন তিনি। ওয়াসিম আক্রমকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলেন। ক্লাবহাউস লোয়ার টিয়ার থেকে ঝুঁকে পড়ে ইডেন লনে পৌঁছে যেতে চাইছে যে শরীরগুলো, তাদের দিকে হাত তুলছেন না? ঠিকই। তুলছেন। শুধু তুলছেন না, ছেষট্টি হাজারের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা সমর্পণে হাততালি দিচ্ছেন।
উদ্বেলিত গম্ভীর আবার আজ হাসছেন, বহু দিন পর। তিন ম্যাচ-ব্যাপী অসহ্য টেনশনের পর। রবিবার বিকেল চারটের আকাশে মেঘ ছিল না। পূর্বাভাস মিলিয়ে বৃষ্টিও আসেনি। কিন্তু কেকেআর আবহাওয়া শুরুতে এতটাই গুমোট ছিল যে, দেশজুড়ে গ্রীষ্মের দাবদাহও তার কাছে শিশু মনে হবে! ক্লাবহাউস গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে কেকেআর মহাকর্তা বেঙ্কি মাইসোর টেনশনাক্রান্ত ভাবে এক পরিচিতকে জিজ্ঞেস করছেন, ওয়েদার রিপোর্টটা ঠিক কী? বৃষ্টি আসছে, না আসছে না?
আবার টসের সময় যে কেকেআর অধিনায়ককে ধরল ক্যামেরা, তাঁর অবস্থাও দারুণ কিছু নয়। একই রকম থমথমে। এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কি না টস ভাগ্যটাও বিদ্রোহ করল! যে টিমের রান তাড়া এত পছন্দের, তাদের কি না শেষ দিনের শেষ যুদ্ধে কপালে জুটল সেই প্রথমে ব্যাট করার আতঙ্ক। কেকেআর তো প্রথমে ব্যাট করেই হেরেছে গত দু’ম্যাচে।
শোনা গেল, ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে তুমুল উৎসব করেছে টিম। এটাও কেউ কেউ বললেন যে, ‘বেবি নাইট’-এর ঝাঁককে গলা ছেড়ে গান গাইতেও শোনা গিয়েছে। হবে না? কেকেআর আজ গাইবে না তো কবে গাইবে? উৎসব আজ করবে না তো কবে করবে?
অথচ একটা সময় পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, এত কাছে এসেও আবার হল না। আরবসাগর পারে গত বার হারের বৃত্তান্ত লিখতে হয়েছিল, গঙ্গাপারেও একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হবে। শোকগাথার সম্ভাবনা ছাড়া আর তো কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। কেকেআর দুর্দান্ত খেলতে খেলতে শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র তিরিশ তুলল। দু’শোর আশা দেখিয়ে উঠল মোটে একশো সত্তর। এর চেয়ে বেশি রান আরসিবি ইডেনের গত ম্যাচে তাড়া করে গিয়েছে। আর কে না জানে, ডেভিড ওয়ার্নার নামক এক ক্রিকেট-গোলিয়াথের লাগলে এ সব একশো সত্তর শিশুপাঠ্য।
ওয়ার্নার পারেননি। কিন্তু তখনও কেকেআরও পারেনি নিশ্চিন্ত হতে। ইডেনের কলকাতা আর বাইশ গজের কলকাতা অপূর্ব মোহনায় মিশে গেল বরং যুবরাজ সিংহ আউট হওয়ার পর। ছেষট্টি হাজারের ইডেন আশঙ্কায় একেবারে ভোগেনি, তা নয়। ভুগেছে। বলাবলি করেছে, ইডেনে শেষ তিনটেয় দু’টোয় হেরেছে কেকেআর। ওয়ার্নারের সামনে কতটা পারবে সোনালি-বেগুনি? কেউ কেউ গত বছরের উদাহরণ টেনে উদ্বিগ্ন স্বগতোক্তি করেছেন, শেষের দুর্ভাগ্য আবার বোধহয় তাড়া শুরু করল কেকেআরকে।
শাহরুখ খান— এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি নেই কেন, তা নিয়েও জল্পনা চালিয়েছে ইডেন। কেউ বলেছেন, নিশ্চয়ই তিনি বুঝেছেন যে, তিনি এলে টিম হারে। তাই আসেননি। কেউ কেউ আবার দ্রুত শুধরে দিয়ে বলেছেন, তাই কি? কিংগ খান এখন দেশের বাইরে না? কিন্তু টানা উৎসবে কার্পণ্য করেনি ইডেন। বরং যেন প্রথম মিনিট থেকে বুঝিয়ে দিয়েছে, টিম জিতুক, হারুক, প্লে অফে যাক বা না যাক। টিমের পাশে শহর ছিল, আছে, থাকবে। আরসিবি ম্যাচের দিন নিজ-টিম ছেড়ে বিরাট কোহালি নামক এক ক্রিকেট-জিনিয়াসের পুজো করেছিল কলকাতা। আজ দেখাল, সেটা ব্যতিক্রম মাত্র। এক-আধ দিন হবে। বরং নিয়ম হবে কেকেআরের প্রতিটা সিঙ্গলসের জন্য পাগলামি, প্রতিটা বাউন্ডারির জন্য চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে পড়া, প্রতিটা ছক্কার জন্য একবার করে ক্লাবহাউস জুড়ে উন্মত্ত দৌড়।
যারা ম্যাচ শেষ হলেও চলে যাবে না। উন্মুখ হয়ে শুনবে গম্ভীর বলছেন, “আজকেরটাই বলতে গেলে প্লে অফ ছিল। কী খেলল ইউসুফ! আসলে ওর রোল পাল্টে দিয়েছি আমরা। আগে ছিল ফিনিশার। এখন যাতে বল বেশি পায় সেটা দেখা হচ্ছে।” যারা চিৎকার করবে পুরস্কার মঞ্চে ইউসুফের গলার আওয়াজে। ঝুঁকে পড়ে দেখবে, কী চলছে লনে? পাঠান বি ব্লকে হাত নাড়াচ্ছেন কার দিকে? স্ত্রীর কোলে ওটা তাঁর ছেলে না?
এটাই রবিবারের ইডেন। এটাই রবিবারের ইডেনে কেকেআর-কলকাতা যুগপৎ। এটাই সেই মায়াবী যুগলবন্দির অপরূপ রাতমোহনা। যেখানে সাড়ে তিন ঘণ্টার টেনশন উড়িয়ে নিয়ে গেল উৎসবের ‘রোয়ানু’। এত সুখ, এত রোমাঞ্চ, এত প্রাপ্তির আবিরের মধ্যে রেখে গেল শুধু একটা আফসোস, একটা ছোট্ট প্রশ্ন।
ইডেনে শেষে সব হল। কেকেআর জিতল। প্লে অফ গেল। শুধু প্লে অফটা ইডেন থেকে চলে গেল কেন?