হার্দিক ম্যাজিকে ম্যাচে ফিরল ভারত

বিরাট কোহালির দলের জন্য দিনটা যদিও উৎসব দিয়ে শুরু হয়নি, হয়েছিল অন্ধকার দিয়ে। একে তো ফের টস হারলেন ভারত অধিনায়ক। তার উপর তীব্র সমালোচিত হতে থাকলেন আগের ম্যাচে বল হাতে সব চেয়ে সফল ভুবনেশ্বর কুমারকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

সেঞ্চুরিয়ন শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১১
Share:

হার্দিকের থ্রোয়ে রান আউট আমলা। শনিবার। ছবি: রয়টার্স

ক্রিকেট না ক্রিকেট উৎসব? নাকি বলা উচিত, টেস্টের সাদা পোষাকে আইপিএল টি-টোয়েন্টি ধমাকা চলছিল?

Advertisement

শনিবার সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্ট পার্কে চক্কর মারতে গিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল। এমন রঙিলা গ্যালারি আর কার্নিভালের মেজাজ যে এতদিন শুধু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেই দেখা গিয়েছে।

বিরাট কোহালির দলের জন্য দিনটা যদিও উৎসব দিয়ে শুরু হয়নি, হয়েছিল অন্ধকার দিয়ে। একে তো ফের টস হারলেন ভারত অধিনায়ক। তার উপর তীব্র সমালোচিত হতে থাকলেন আগের ম্যাচে বল হাতে সব চেয়ে সফল ভুবনেশ্বর কুমারকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য। সুনীল গাওস্কর থেকে অ্যালান ডোনাল্ড— প্রত্যেকেই ভুবিকে বসানো নিয়ে তোপ দাগলেন।

Advertisement

আনন্দবাজারে এ দিন প্রকাশিত খবর অনুযায়ীই, তিনটে পরিবর্তন করা হল প্রথম একাদশে। তার মধ্যে শিখর ধবনের জায়গায় কে এল রাহুলের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে বিতর্ক নেই। আছে ঋদ্ধিমান সাহার জায়গায় পার্থিব পটেল-কে আনা এবং ভুবনেশ্বর-কে বসানো নিয়ে। পার্থিব এ দিন হাসিম আমলার লেগসাইডে দেওয়া ক্যাচ ধরতে পারলেন না। আমলা তখন ৩০ এবং ঋদ্ধিমানের যা ফুটওয়ার্ক এবং বল সংগ্রহ করা বা ক্যাচিং দক্ষতা, এ ধরনের ক্যাচ তিনি প্রচুর নিয়েছেন। কোহালি যদিও টসের সময় এসে বলে গেলেন, ঋদ্ধির সামান্য চোট রয়েছে। হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগছে তাঁর। যদি ফিটনেসের কারণে ঋদ্ধিকে বসতে হয়ে থাকে, তা হলে বলার কিছু নেই। না হলে ব্যাট হাতে পার্থিব কী করেন, সেটাও দেখতে চাইবে ক্রিকেট মহল।

আরও পড়ুন: ঋদ্ধির বদলে পার্থিব? দ্বিতীয় টেস্টে ভারতীয় দলে চমক

প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রানের পাহাড়ের দিকেই এগোচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখান থেকে শেষ বেলায় দুর্দান্ত ভাবে ম্যাচে প্রত্যাবর্তন ঘটাল কোহালির ভারত। চুম্বকে ধরা থাকছে, একটা রান আউট পাল্টে দিয়ে গেল সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের রং।

মাঠের টি-টোয়েন্টি আবহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গেমচেঞ্জার হয়ে থাকলেন ভারতের টি-টোয়েন্টি প্রজন্মের নতুন পোস্টার বয়— হার্দিক পাণ্ড্য। তাঁর একটা শর্ট পিচ্‌ড বল পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে অন সাইডে রক্ষণাত্মক শট খেললেন আমলা। খুব বেশি দূরে যায়নি সেই বল। কিন্তু নন-স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে ফ্যাফ ডুপ্লেসি রানের জন্য দৌড়লেন। ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে সামান্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা আমলা প্রথমে দোনোমোনো করলেন। তার পর দৌড়লেন। ব্যাস, আমলার ওই ক্ষণিকের দ্বিধায় ভোগাই হার্দিকের জন্য যথেষ্ট ছিল। চিতার ক্ষিপ্রতায় ফলো-থ্রুতে ছুটে গিয়ে বল তুলে নিলেন তিনি। তার পর রিভলভিং চেয়ারের মতো ঘুরে গিয়ে একই অ্যাকশনে সরাসরি থ্রো-তে ভেঙে দিলেন বোলার প্রান্তের স্টাম্প। যে দিকে দৌড়ে আসছিলেন আমলা। ওই এক থ্রো-তে ৮২ রানে আউট তো করে দিলেনই আমলাকে, দক্ষিণ আফ্রিকার মনোবল ভেঙে দিয়ে ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন বলেও লিখে দেওয়া যায়।

এর পরেই দু’টো দলের শরীরী ভাষা আমূল বদলে গেল। ভীষণ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে দেখা গেল কোহালিকে। যিনি এর আগে উইকেট তুলতে না পারায় কিছুটা হতাশই হয়ে পড়ছিলেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেখে মনে হতে থাকল, তারা প্রবল চাপে পড়ে গিয়েছে। ম্যাচ এর পরেই ইউ টার্ন নিয়ে ভারতের দিকে চলে এল। পাঁচ রানের মধ্যে তিন উইকেট হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা। দিনের শেষে তারা ২৬৯-৬। এর চেয়ে অনেক শক্তিশালী জায়গায় তারা শেষ করবে বলে মনে করা হয়েছিল।

কেপলার ওয়েসেলস বলছিলেন, সেঞ্চুরিয়নে এ রকম পিচ তিনি কখনও দেখেননি। প্রথম দিনেই বল টার্ন করছে। ওয়েসেলসের দলের প্রধান পেস অস্ত্র অ্যালান ডোনাল্ডও আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেঞ্চুরিয়নে বল ঘুরবে না। অথচ সকলকে অবাক করে দিয়ে আর. অশ্বিনের প্রথম ওভার থেকেই বল ঘুরতে শুরু করল। সকাল থেকে এমনিতেই ভুবনেশ্বরকে না খেলানো নিয়ে তীব্র তর্ক-বিতর্ক তো চলছিলই। এ বার অশ্বিনকে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক দেখাতে শুরু করায়, প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তা হলে কি দ্বিতীয় স্পিনার থাকলে ভাল হতো? দক্ষিণ আফ্রিকার ছ’টা উইকেটের মধ্যে দু’টো রান আউট। একটি মাত্র নিয়েছেন পেসার ইশান্ত শর্মা। তিনটি উইকেট নিয়ে বোলিংয়ে নায়ক অশ্বিন। যা দেখার পরে দুই স্পিনারের তত্ত্ব আরও বেশি করে এসে পড়তে পারে।

হার্দিক পাণ্ড্য যদি দুর্ধর্ষ রান আউটে ম্যাচের রং পাল্টে দিয়ে থাকেন, তা হলে মাঠের বাইরে সুপারস্পোর্ট পার্কে সেরা আকর্ষণ অবশ্যই সুইমিং পুল থেকে ক্রিকেট দর্শন। অস্ট্রেলিয়ার সৌজন্যে ক্রিকেট মাঠে সুইমিং পুলের জলোচ্ছ্বাস আগেই দেখা গিয়েছে। এ দিন সুপারস্পোর্ট পার্কে যেন আরও ঝলমলে ভাবে সেটা ক্রিকেটের অঙ্গ হয়ে ওঠার দাবি তুলে দিল। ক্রিকেট মহলে যার নামকরণ হয়ে গিয়েছে ‘বিচ অ্যান্ড বিকিনি ক্রিকেট’। সত্যিই দেখে মনে হবে, বিচ ভলিবলের মতো বিচ ক্রিকেট হচ্ছে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তরুণ-তরুণীরা। পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সেখান থেকেই ম্যাচ উপভোগ করছেন। ক্রিকেট কোথায়, এ তো ক্রিকেট কার্নিভাল-ই!

বিশেষ টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে সুইমিং পুলে ঢোকার জন্য। অবশ্যই বাড়তি টাকা লাগবে। কিন্তু প্রথম দিনেই সেখানে এমন হইহুল্লোড় আর ভিড় দেখা গেল যে, মনে হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন এই জলোচ্ছ্বাসের আবেদন নানা দেশে জনপ্রিয় হতে বাধ্য। আর সেই সুইমিং পুলেও দেখা গেল বিরাট কোহালির ভক্ত সংখ্যা প্রচুর। অনেকেই বলে গেলেন, ‘‘বিরাট কোহালি বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। আমরা ওঁর ব্যাটিং দেখতে এসেছি।’’ আর এই পুলের জলে শুয়ে-বসে ক্রিকেট দেখা? দুই ক্রিকেট ভক্ত বলে উঠলেন, ‘‘এ রকম গরম পরিবেশে পুলের জলে শরীর ঠাণ্ডা করে নেওয়া যাচ্ছে। আবার ক্রিকেট ম্যাচও দেখতে পাচ্ছি। দারুণ প্যাকেজ এটা।’’

বিনোদনের এখানেই শেষ নয়। স্টেডিয়ামের অন্য দিকটায় গিয়ে দেখা গেল বার্বিকিউ উৎসব চলছে। সেখানেও বেশ ভিড়। এমনিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠগুলোতে সেরা আকর্ষণ ‘গ্রাস এনব্যাঙ্কমেন্ট’। চেয়ার পাতা গ্যালারির দর্শকাসন তুলনায় অনেক কম। বেশি টিকিট ঘাসের উপর বসে ক্রিকেট উপভোগ করার জন্য বরাদ্দ। আবার মধ্যাহ্নভোজের সময় বাচ্চাদের নিয়ে সকলে নেমে আসতে পারেন মাঠের মধ্যেও। বাইশ গজকে ঘিরে রেখে মাঠের সর্বত্র ঘুরতে দেওয়া হয়। যা উপহাদেশের কোনও মাঠে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই।

মাঠের মধ্যে কিন্তু কোহালি এবং তাঁর দলের এটাকে বিদেশের চেয়ে দেশি পরিবেশই মনে হওয়া উচিত। সারা দিন ধরে চড়া রোদ আর গরম। কেপ টাউনের মতো হাওয়াও এখানে নেই। তার উপর পিচ যতটা না দক্ষিণ আফ্রিকান, তার চেয়ে বেশি ভারতীয় দেখাচ্ছে। আইডেন মার্করাম (৯৪) এবং আমলার লড়াইয়ের পর শুরুর হতাশা কাটিয়ে ম্যাচে ফিরেও আসতে পেরেছেন কোহালি-রা। এখন ক্রিজে একমাত্র কাঁটা বলতে ডুপ্লেসি। ২৪ রানে অপরাজিত তাঁকে রবিবার সকালে দ্রুত সরাতে হবে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কোহালিদের ভাল ব্যাট করতে হবে। না হলে শেষ বেলার এই প্রত্যাবর্তন বুদবুদের মতোই ভেসে উঠে মিলিয়ে যাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন