মহাকাব্যিক প্রত্যাবর্তনে টাইটানিক ডুবি

প্রথম লেগে ০-৩ পিছিয়ে থেকেও চাকা উল্টো দিকে ঘোরানো যায় একজন কিন্তু বলেছিলেন। তিনি আর্সেনালের প্রাক্তন কিংবদন্তি ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার। তাঁর সরল যুক্তি ছিল, খেলা হবে অ্যানফিল্ডে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০৪:৪৩
Share:

হুঙ্কার: বার্সেলোনার বিরুদ্ধে গোলের পরে সতীর্থ আর্নল্ডের সঙ্গে ওয়াইনলডম (সামনে)। গেটি ইমেজেস

লিভারপুল ৪

Advertisement

বার্সেলোনা ০

(দুই পর্ব মিলিয়ে ৪-৩)

Advertisement

সাত দিন আগেই ক্যাম্প ন্যু-তে লিভারপুলকে ৩-০ হারিয়ে ছিলেন লিয়োনেল মেসিরা। তখন বার্সেলোনাকে টাইটানিকের মতোই দেখিয়েছিল। কেউ যেমন ভাবেননি আটলান্টিকে তলিয়ে যাবে টাইটানিক, তেমনই অকল্পনীয় ছিল অ্যানফিল্ডে বার্সার ভরাডুবি!

বাস্তবে হল সেটাই।

প্রথম লেগে ০-৩ পিছিয়ে থেকেও চাকা উল্টো দিকে ঘোরানো যায় একজন কিন্তু বলেছিলেন। তিনি আর্সেনালের প্রাক্তন কিংবদন্তি ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার। তাঁর সরল যুক্তি ছিল, খেলা হবে অ্যানফিল্ডে। লিভারপুলের বিরুদ্ধে যে স্টেডিয়ামে ম্যাচ জেতা ‘কার্যত অসম্ভব’। সেটা অ্যানফিল্ডের অবিশ্বাস্য পরিবেশের জন্য। বিশ্বের কোনও ‘হোম টিম’ যে সুবিধা নাকি পায় না। এবং ওয়েঙ্গার পরিষ্কার বলেছিলেন, অ্যানফিল্ডের আগুনে মহান লিয়োনেল মেসির বার্সেলোনাও পুড়ে ছাই হয়ে গেলে অবাক হবেন না।

ওয়েঙ্গারের ভবিষ্যদ্বাণী এ ভাবে মিলে যাবে, ক’জন ভেবেছিলেন? ক্যাম্প ন্যুতে প্রথম লেগে বার্সেলোনা জিতেছিল ৩-০। যে ম্যাচে মেসির সেই ফ্রি-কিকের ভীতিপ্রদ প্রভাব ফিরতি ম্যাচেও লিভারপুলের উপর পড়বে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তার উপর ‘দ্য রেডস’ যে মহম্মদ সালাহ, রবের্তো ফির্মিনোকে গ্যালারিতে রেখে খেলবে সেটাও অজানা ছিল না। তাই অঘটনের সম্ভাবনা কার্যত অকল্পনীয় ছিল। প্রায় এক দশক আগে রোমার কাছে ফিরতি ম্যাচে হেরে রিয়াল মাদ্রিদের বিদায়, এসি মিলানকে এমনই এক ফিরতি ম্যাচে দেপোর্তিভো লা করুনার ০-৪ হারানোর মতো হাতে গোনা ব্যতিক্রম নিয়ে তাই মাথা ঘামানোই হয়নি।

অথচ ঘটল ঠিক সেটাই। ফুটবল পণ্ডিতেরা যাকে বলে দিলেন, শতাব্দীর অন্যতম সেরা অঘটন। য়ুর্গেন ক্লপ প্রমাণ করে দিলেন, নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও যে কোনও অবস্থায় তাঁর বল ছিনিয়ে নেওয়ার বিখ্যাত সেই ট্যাকটিক্স মারণাস্ত্র হতে পারে বার্সেলোনার মতো দলের বিরুদ্ধেও। শুধু মেসিদের নিজেদের মধ্যে অসংখ্য পাস খেলে যাওয়ার বহুচর্চিত কৌশলে বারবার ম্যাচ জেতা যায় না। সাদিয়ো মানেরা তো অ্যানফিল্ডে সেই তত্ত্বকে কার্যত ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। ম্যাচের আশি শতাংশ সময় যে অবিশ্বাস্য চাপের মধ্যে কাটাতে হল জেরার পিকেদের, তাতে বার্সার পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর ফল হলে সত্যিই বলার কিছু ছিল না। বার্সার নড়বড়ে এবং বিশ্রী রক্ষণকে দিশেহারা করা শুরু খেলার ৭ মিনিটেই দিভক ওহিগির গোল দিয়ে। একটা শট কোনও রকমে আটকেছিলেন টের স্টেগান। কিন্তু ওহিগি তাঁকে তাড়া করে গোল করে গেলেন। প্রথমার্ধে ০-১ পিছিয়ে থাকলেও ফল যে শেষ পর্যন্ত ৪-০ হবে, আর দুই ম্যাচ মিলিয়ে মোট গোলের হিসেবে ৪-৩ জিতে লিভারপুল টানা দ্বিতীয় বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে খেলবে সেটা অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেও দেখা গেল মানেরা একই রকম তীক্ষ্ণ। এবং অবশ্যই বার্সা রক্ষণ কুৎসিততম। ৫৪ ও ৫৬ মিনিটে জর্জিনিয়ো ওয়াইনলডমের এবং ৭৯ মিনিটের ওহিগির আরও একটা গোলকে অসাধারণ কিছু বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে প্রতীয়মান হয়েছে ক্লপের মস্তিষ্ক এবং সেই নাছোড় মানসিকতা। যার সামনে মেসি-ম্যাজিকের সামান্য ঝলককেও ম্লান দেখিয়েছে।

লিয়োনেল মেসির বার্সেলোনাকে হারিয়ে অবিশ্বাস্য এই ৪-০ জয়ের রাতে লিভারপুল ম্যানেজার য়ুর্গেন ক্লপ তাঁর ফুটবলারদের সঙ্গে দৈত্যদের তুলনা করলেন। এবং ম্যাচের পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লেন যে, একবার তাঁর মুখ থেকে আপত্তিকর শব্দ বেরিয়ে এল। নিজেকে সামলে যা নিয়ে তার পরেই বললেন, ‘‘চাইলে আমার জরিমানা হোক। তবে আপনারা আমাকে যতটা অসভ্য ভাবছেন মোটেই আমি তা নই। আসলে এর থেকে ভাল শব্দ কিছু মাথায়
এল না।’’

কেন তিনি এতটা উত্তেজিত তাও ব্যাখ্যা করলেন ক্লপ, ‘‘পুরো ম্যাচটার কথা ভাবুন। ছেলেরা এতটা ভাল খেলবে কেউ কল্পনা করেনি। এই পারফরম্যান্স বর্ণনার ভাষা নেই। জীবনে অনেক ফুটবল ম্যাচ দেখেছি। কিন্তু এ রকম ম্যাচ খুব বেশি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘এমনিতেই ওদের বিরুদ্ধে জেতা খুব কঠিন। তার পরেও আমরা একটা গোলও খাইনি এবং এতটা পরিষ্কার স্কোরে আর দাপট নিয়ে যে জিতেছি তা নিজেই ভাবতে পারছি না। অথচ আমরা সম্ভবত বিশ্বের সেরা দলের বিরুদ্ধে খেললাম। বিশ্বাস করুন, আমি নিজেই বুঝতে পারছি না ছেলেরা কী ভাবে এটা সম্ভব করল।’’

ক্লপ সবচেয়ে অবাক হয়েছেন তাঁর ফুটবলারদের উদ্দীপনা দেখে। এবং তার জন্য তিনি তাঁদের কুর্নিশও করেছেন। বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয় ফুটবলের এটাই সেরা মুহূর্ত। মানছি পৃথিবীতে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু আছে। কিন্তু খেলার মধ্যে আবেগ নিয়ে আসা একটা বিরাট ব্যাপার। এ সবই হয়েছে ফুটবলারদের জন্য। জীবনে কোনওদিন খেলার মাঠে এ রকম পরিবেশ দেখিনি। খেলার পরে দেখলাম জেমস মিলনার মাঠে বসে কাঁদছে। সত্যি ভাবা যায় না। এর পরে আর কী করে আমরা নিজেদের আবেগ সংবরণ করি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন