প্রশ্ন: সেই লাল রুমালটা কোথায় যা ক্রিকেট মাঠে আপনার চিরসঙ্গী ছিল এবং যা গণহারে বিলি হয়েছিল আপনার শেষ টেস্টে?
স্টিভ: ওটা সিডনি মাঠের ক্রিকেট জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছি।
প্র: জাদুঘরে যেন নিজের ক্রিকেট পরবর্তী জীবনও দিয়ে দিয়েছেন। সিডনি ছাড়া আপনাকে ক্রিকেট মাঠের ধারেকাছে দেখা যায় না। এই সন্ন্যাস কেন?
স্টিভ: সন্ন্যাস তো নয়! অনেক কিছুর সঙ্গে আমি জড়িত হয়ে গেছি। কত কিছু করছি। আমার চ্যারিটির দশ বছর হল— সিডনিবাসী স্টিভ ওয় ফাউন্ডেশন। সেটার কাজ প্রচুর। রিসেন্টলি তার জন্য টাকা তুললাম। বাইক চড়ে সিডনি থেকে ব্রিসবেন গেলাম। ৯০০ কিলোমিটার বাইক চালিয়েছি। দিনে দেড়শো-দুশো কিলোমিটার করে। সঙ্গে বেশ কিছু লোকজন ছিল। কয়েক কোটি টাকা তুললাম চ্যারিটির জন্য। এটার মধ্যে রোমাঞ্চ কম নাকি?
প্র: আর কী কী করেন?
স্টিভ: এনআরআইদের জন্য সারা পৃথিবীতে বাড়ি খুঁজে দেওয়া প্রকল্পের সঙ্গে আমি যুক্ত। অনেকগুলো অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির বোর্ডে রয়েছি। অস্ট্রেলিয়ান অলিম্পিক্স টিমের আমি মেন্টর ছিলাম বেজিং আর লন্ডন দুটো অলিম্পিক্স গেমসের আগে। অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল টিমের সঙ্গে একই ভাবে মোটিভেটরের কাজ করেছি। কিছু না কিছু থাকেই।
প্র: ইংরেজিতে বলা হয়, ইওর হ্যান্ডস আর ফুল। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, ইওর লেগস আর অলসো ফুল।
স্টিভ: ইয়েস (হাসি)। পুরোটাই ভর্তি। মধ্যিখানে ক্রিকেটের জন্য একটা কাজও করেছি। আর্গাস রিভিউতে আমি জড়িত ছিলাম যেটা কিনা অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড থেকেই করানো হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের উন্নতির জন্য। কিন্তু তার বাইরে আমি কী করব? কী করতে পারি?
প্র: এমন কিছু যাতে আপনার অ্যাড্রিনালিন নিষ্ক্রমণ হয়।
স্টিভ: যেমন?
প্র: যেমন চ্যানেল নাইনের কমেন্টেটর হয়ে যাওয়া।
স্টিভ: আমার অনেক বন্ধু এখন কমেন্ট্রি বক্সে বসে। ওরা খুব ভাল কাজও করছে। ওদের কোনও রকম কটাক্ষ করতে চাই না। তবে ওই কাজটা বোধহয় আমাকে দিয়ে হবে না।
প্র: কেন?
স্টিভ: আমি জীবনে চ্যালেঞ্জ চাই। সংঘর্ষ চাই। অনিশ্চিত কিছুর জন্য ছুটতে চাই। ক্রিকেট তো আমার জানা জিনিস। তার মধ্যে বাড়তি চ্যালেঞ্জ কোথায়? আমি এখন যেগুলো করি তাতে আমার কোনও সহজাত দক্ষতা নেই। সেটাই তো চ্যালেঞ্জ যেখানে আমি সহজাত নই সেখানে পারছি কি না।
প্র: অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে আপনার যা কন্ট্রিবিউশন তাতে দেশ আপনাকে যথেষ্ট দিয়েছে বলে মনে করেন?
স্টিভ: আমি এই সব নিয়ে ভাবি না। শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়া এত সব রত্নগর্ভা প্লেয়ারে সমৃদ্ধ যে, একটা ব্যাচ যায় আর একটা উঠে আসে। ক্রীড়ামোদিরা একই রকম সম্ভ্রমে পরের ব্যাচের দিকে তাকায়।
প্র: ভারত এবং কলকাতায় আপনার যত ভক্ত আছে তার বিচারে কিন্তু মনে হয়, এ দেশে জন্মালে আপনি অনেক বেশি পুজো পেতেন।
স্টিভ: পুজো হোক আমি চাই না। সে দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছি বলে আমি ভাগ্যবান।
প্র: কেন?
স্টিভ: পুজো মানেই তো একটা পাটাতনের ওপর আপনাকে তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল। আমি সেটা চাই না। আমি একজন কমন ম্যান। আর কমন ম্যানেদের সঙ্গে যোগাযোগ হারাতে চাই না।
প্র: বলছেন কী? আপনি স্টিভ ওয় কমন ম্যান? আপনি হলেন সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক!
স্টিভ: না না। আমি মনে করি আমাদের স্পোর্টসম্যানদের বেশি পাত্তা দেওয়া হয়। আমরা জাস্ট খেলার স্কিলের ওপর ভিত্তি করে সোসাইটির এত বড় সম্মান ডিজার্ভ করি না।
প্র: বিনয় করছেন?
স্টিভ: একটুও না। সত্যিই মন থেকে তাই মনে করি। আমাদের চেয়ে সমাজে অনেক পেশাদারের প্রকৃত কন্ট্রিবিউশন বেশি, যাদের ওপর প্রচারের আলো পড়ে না।
প্র: আপনার কথাবার্তার মধ্যে কোথাও ইমরান-ইমরান ভাব আছে। শুনেছি বহু বছর আগে আপনারা নিউ সাউথ ওয়েলসে রুমমেট ছিলেন?
স্টিভ: ইয়েস। আমাকে ওঁর সঙ্গে এক রুমে রাখা হয়েছিল এত বড় ক্রিকেটারের থেকে শেখার জন্য। আমার বয়স তখন আঠারো। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে ওঁকে দেখতাম। আমি স্বভাবতই শাই। ইমরানও তখন মুখচোরা। কার্যত দু’জনে দু’জনকে নীরবে সম্মান জানাতাম।
প্র: শুনেছি কথা না হওয়ার আরও একটা কারণ, আপনি ঘরে ঢুকতে পারতেন না। ওটা এনগেজড থাকত বলে। বেশিরভাগ দিনই আপনি রাত কাটিয়েছেন অন্য ঘরে। সত্যি?
স্টিভ: (অপ্রস্তুত) না না সত্যি নয়। এই রকম কিছু মনে করতে পারছি না।
প্র: ওই বয়সে কী শিখেছিলেন ইমরানের থেকে?
স্টিভ: শিখেছিলাম ওর প্রফেশনালিজম। আর চিন্তা করার বৈশিষ্টতা। আমার ইমরানের মস্তানিটা দারুণ লাগে। একটা লোক ক্রিকেট থেকে সম্পূর্ণ ডুব দিয়ে আকণ্ঠ সমাজসেবা করল। আবার চলে গেল অনিশ্চিত রাজনীতিতে। সেখানেও প্যাশন। জীবন এমনই হওয়া উচিত।
প্র: মাফ করবেন কিন্তু শুনেছি এখনও আপনাদের দেখা হলে কোনওদিনই এক রুমে রাত কাটাতে না পারা নিয়ে খুব হাসাহাসি হয়।
স্টিভ: থাক ও সব। এখন আমরা ভাল বন্ধু। আমি শুধু ওকে বলি এটাই আপনার থেকে শিখেছি যে নিজের বাউন্ডারিকে ছড়াও। ছড়াতে ছড়াতে অজানা বন্দরে পৌঁছোও। তারপর সেটাকে নিতে চেষ্টা করো। তবে না কৃতিত্ব।
প্র: আপনি কলকাতায় এলেই অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে দুটো জিনিস। উদয়নের স্টিভদা ডাক। আর আরও বেশি মনে পড়ে ২০০১-এর ইডেন টেস্ট। আপনার কি ওটার কথা ভাবলে আজও রক্ত ঝরে?
স্টিভ: না আমার ওই ম্যাচটা নিয়ে কোনও আফসোস নেই। দুর্দান্ত একটা টেস্ট যেখানে আমরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েও হেরেছিলাম। ওই লড়াইয়ের চেয়ে বেশি আর কী আমরা দিতে পারতাম?
প্র: ফলো অন করানো নিয়ে কোনও আক্ষেপ হয়নি পরে?
স্টিভ: না হয়নি। আমি চেয়েছিলাম ম্যাচটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে জিততে। সেটা হয়নি।
ইডেনে আমাদের শুধু ২০০১-এ টেস্ট হারের কথা বলেন আপনারা। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ জয়ের কথা ভুলে যান। সে দিন কিন্তু এক লক্ষ সমর্থক আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাই আমার কাছে ইডেনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি ১৯৮৭।
প্র: আর আপনার বন্ধু গাঙ্গুলি, যিনি টসের সময় বারবার ব্লেজার ফেলে যেতেন অজুহাতে দেরি করতেন?
স্টিভ: না আজ আর সৌরভের সঙ্গে কোনও ভুল বোঝাবুঝি নেই। তখন বেশি রেগে গেছিলেন আসলে ম্যাচ রেফারি ক্যামি স্মিথ। আমি পরে বুঝেছি সৌরভ আমাদের আপসেট করতে চেয়েছিল। ঠিকই করেছিল।
প্র: কিন্তু তখনকার মতো রেগে গিয়ে আপনি নাকি বলেছিলেন, তোমায় আমি একটা ঘড়ি প্রেজেন্ট করতে চাই?
স্টিভ: আরে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য কেন আজ অবধি কোনও ঘড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি একসঙ্গে আমাদের মডেলিং করতে বলেনি (হাসি)।
প্র: স্টিভ আপনি শুধু ক্রিকেটই ভাল খেলেননি। আপনি ক্রিকেট চিন্তকও বটে। খেলাটাকে বদলেছেন। আজ ক্রিকেটের সঙ্গে না থেকেও আপনার খারাপ লাগে না যে, একটা ২৪০ বলের লড়াই ঘিরে উপমহাদেশের হাসি-কান্না নির্ধারিত হবে?
স্টিভ: কী করা যাবে এটাই ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে প্লেয়াররা অনেকটা দায়িত্ব নেয়। ওরা বোর্ডকে বলে টি-টোয়েন্টি কমাও, টেস্ট ম্যাচ বাড়াও। ইন্ডিয়াতে বিরাট আর ধোনিকেও তাই করতে হবে। বোর্ডকে বোঝাতে হবে টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটে হোক। দেশের হয়ে না। কারণ টেস্ট ক্রিকেটই আসল ক্রিকেট। যে কোনও মূল্যে ওটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
প্র: কী বলছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও তুলে দিতে?
স্টিভ: বিশ্বকাপ থাক কিন্তু আর বেশি কিছু দরকার নেই।
প্র: ভারতে আপনার লাখ লাখ ভক্ত। কলকাতায় বোধহয় সবচেয়ে বেশি। যে ভাবে চাপের মুখে আপনি ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটের দিশা বদলে দিয়েছেন আপনার টিমের দারুণ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে সেটা অসামান্য।
স্টিভ: ধন্যবাদ।
প্র: অথচ অবাক লাগে চ্যানেল নাইনে প্রায়ই আপনি সমালোচিত হন। শেন ওয়ার্ন তো আপনার সম্পর্কে চরম বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন। যা নিয়ে ক্রিকেট সার্কিট সরগরম।
স্টিভ: আমি কী বলব। শেনের বক্তব্যে আমার পরিবার গভীর মর্মাহত। আমার বন্ধুরা শকড। কিন্তু আমি প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কোনও কারণ দেখিনি। বলেছে বলেছে, আমি কী করব? ক্রিকেট ক্যাপ্টেন্সি এমন একটা ব্যাপার সবাইকে খুশি রেখে হয় না।
প্র: শুধু এইটুকু? কী বলছেন আপনার খারাপ লাগেনি?
স্টিভ: খারাপ লেগেছে এটা ভেবে যে, শেন আমাদের টিমটাকে অসুখী পরিবারে বানিয়ে ছাড়ল কিনা ভেবে।
প্র: কিন্তু ওঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধেও তো প্রচুর রিঅ্যাকশন হয়েছে। আপনার টিমমেটরা অনেকে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্টিভ: সারা ক্রিকেটবিশ্ব থেকে সমর্থন পেয়েছি। হাজারেরও বেশি ই-মেল এসেছে আমার সমর্থনে। গিলি মুখ খুলেছে। ম্যাকগ্রা কথা বলেছে। হেডেন বলেছে। ল্যাঙ্গার বলেছে। সংখ্যাধিক্যের সমর্থন নিয়ে আমি ভাবিতই নই।
প্র: যেটা সবচেয়ে অবাক লেগেছে, শেন ওয়ার্ন বলেছেন স্টিভ ছিল চরম স্বার্থপর ক্রিকেটার।
স্টিভ: আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। আমি সব সময় টিমের স্বার্থকে ওপরে স্থান দিয়েছি। যা কিছু করেছি অস্ট্রেলিয়ান টিমের জেতার কথা ভেবে। আর আমাকে বলছে স্বার্থপর!
প্র: কিন্তু রেকর্ডই তো আপনার হয়ে কথা বলে।
স্টিভ: আমি ও সব নিয়ে কিছু ভাবতেই চাই না। আমি নিজের হয়ে কথা বললে মনে হবে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছি। নিজের হয়ে সাফাই গাইছি। ধুর স্টিভ ওয় এ সবের মধ্যে নেই কারণ তার প্রয়োজনই নেই।
প্র: তা হলে স্টিভ আপনি এত রক্তাক্ত কেন আজ কলকাতায় বসে ঘটনার এক মাস বাদেও?
স্টিভ: আমার আসলে নিজেকে নিয়ে নয়, দলগত লজ্জা হচ্ছে। গোটা পৃথিবীর সামনে কি এটাই দাঁড়িয়ে গেল না যে, আমরা সুখী পরিবার ছিলাম না? কোনওদিন হতে পারে? হ্যাপি ড্রেসিংরুম না হলে একটা টিম এত ম্যাচ কখনও জিততে পারে? ইমপসিবল। যে কোনও ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন। কত হাসিঠাট্টা হত সেই অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিংরুমে। কী কী দিন গেছে।
আমার শুধু অবাক লাগছে। শেনকে বলতে ইচ্ছা করছে, বন্ধু তোমার স্মৃতিশক্তি কি এত দুর্বল হয়ে গেল যে সেই আমুদে দিনগুলো তুমি সব ভুলে গেলে? এত দুর্বল স্মৃতিশক্তি? কী করে হয় বন্ধু?