মামার বাড়ির শহরে সাফল্যের প্রথম উৎসব চান অনির্বাণ

পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপের পঞ্চম স্থানটা উৎসর্গ করছেন দেশকে। প্রাপ্তির ভাণ্ডার থেকে ভারতীয় গল্ফকে ফিরিয়ে দেবেন কী ভাবে, তা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অঙ্কুর ডালপালা মেলাও শুরু করেছে একটু একটু।

Advertisement

মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৫
Share:

“আমি সেনা পরিবারের ছেলে। স্বাধীনতা দিবসের সপ্তাহে এই সাফল্যের তাৎপর্য আমার কাছে আলাদা। সাফল্যটা দেশকে উৎসর্গ করছি।” —অনির্বাণ লাহিড়ী।

পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপের পঞ্চম স্থানটা উৎসর্গ করছেন দেশকে।

Advertisement

প্রাপ্তির ভাণ্ডার থেকে ভারতীয় গল্ফকে ফিরিয়ে দেবেন কী ভাবে, তা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অঙ্কুর ডালপালা মেলাও শুরু করেছে একটু একটু।

সামনে লক্ষ্য আগামী মরসুমের পিজিএ ট্যুর কার্ড এবং আগাস্টা মাস্টার্সে খেলার যোগ্যতা অর্জন।

Advertisement

তবে সে সবের আগে, আপাতত অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন অনির্বাণ লাহিড়ী।

কখন আসবে শুক্রবার। কখন পা রাখবেন মামার বাড়িতে!

সল্ট লেকের সিকে ১০৫ নম্বর যে বাড়িতে গল্ফ বিশ্ব কাঁপানো বাঙালি চ্যাম্পিয়নের মা, অধ্যাপিকা নবনীতা লাহিড়ী, দাদামশাই অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার নিমাই সেন, দিদিমা-সহ আত্মীয়-বন্ধুরা পথ চেয়ে বসে তাঁর।

সাফল্যের প্রথম উৎসবটা কলকাতাতেই হবে, বুধবার বেঙ্গালুরু থেকে মেবাইলে জানিয়ে দিলেন নায়ক স্বয়ং। অনির্বাণ লাহিড়ী বলছিলেন, ‘‘বড় কিছু নয়। তবে শুক্রবার দুপুরে জমাটি খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। আত্মীয়-বন্ধুরা সবাই থাকবে। আমি আর আমার স্ত্রী ঈপ্সা এখান থেকে যাচ্ছি। একটা দিন থাকব কলকাতায়।’’

মেনুতে নিশ্চয়ই আপনার পছন্দের দারুণ সব পদ?

ইলিশ থেকে মাটন রসিক বলে পরিচিত অনির্বাণ অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘‘মা আর দিদা যা রাঁধবে, সেটাই দুর্দান্ত হবে। আমার পছন্দ, আমার ভাল-মন্দ, আজও ওঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি ভাল বোঝেন। এটুকু জানি, রান্না অসাধারণ হবেই!’’ সঙ্গে অবশ্য একটু ‘মধুর’ টেনশনও রয়েছে। দাদু-দিদা কলকাতার সেরা সব মিষ্টি সাজিয়ে রাখবেন তাঁর জন্য। ‘‘কিন্তু আমি মিষ্টি খেতে কোনও দিনই ভালবাসি না। ওঁরা সেই মিষ্টি আনবেন আর আমি খেতে চাইব না। দাদু-দিদা আপসেট হয়ে যাবেন,’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন অনির্বাণ। মামার বাড়ির প্রসঙ্গ উঠতেই উচ্ছ্বসিত যাঁর কণ্ঠস্বর।

কলকাতায় রাহিল গাঙ্গজির মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পার্টির দাবি জানিয়ে রেখেছেন। মেজর-তারকা বললেন, ‘‘পার্টি অবশ্যই হবে! একটা কেন ওদের অনেক ক’টা পার্টি পাওনা। ওরা যে ভাবে পাশে থেকে সাহস আর উৎসাহ দিয়েছে, অবিশ্বাস্য!’’

বুধবার সন্ধ্যার টেলিফোন আলাপচারিতার শুরুতেই বলে নেন, ‘‘বাংলাটা আমার কিন্তু একটু গোলমাল।’’ কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই চলে আসছিল ইংরেজি। তবে হৃদয়টা খাঁটি বাঙালি। কিছু ফিরিয়ে দিতে চান কলকাতাকে। বললেন, ‘‘গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি যাওয়া প্রায় রুটিন ছিল। কিন্তু এ বারটা নিয়ে একদম অন্য রকমের অনুভূতি হচ্ছে। কলকাতাবাসী যে সমর্থন দিয়েছেন, কোনও সন্দেহ নেই আমার সাফল্যে ওঁরাও ভাগিদার। এ বার গিয়ে সেই প্রাপ্তিস্বীকারটাই করতে চাই।’’ বাঙালিকে বুক ফুলিয়ে বলার মতো ক্রীড়া-কীর্তি উপহার দেওয়া ছেলে যোগ করলেন, ‘‘কলকাতায় বরাবর উষ্ণ ভালবাসা পেয়েছি। জানি, এ বার সেটা আরও তীব্র হবে। আই অ্যাম লুকিং ফরোয়ার্ড টু ফিলিং দ্যাট ওয়ার্মথ।’’

মামার বাড়ির আদরটুকু উপভোগ করার সঙ্গে এ রাজ্যের গল্ফের হালহকিহতের খবর রাখেন নিয়মিত। এ দিন যেমন বললেন, ‘‘কলকাতার বিরাজ মাডাপ্পার দিকে নজর রাখুন। সতেরো বছর বয়সেই অবিশ্বাস্য প্রতিভা। আমি তো বলব, ব্রাইটেস্ট ট্যালেন্ট ফর ইন্ডিয়া।’’

বছরটা মার্কিন মুলুকে পিজিএ ট্যুরের ব্যস্ততায় কাটলেও ভারতীয় গল্ফের সব খবর নখদর্পণে। কারও ছোটখাট সাফল্যেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ভুল হয় না। কী করে সময় পান এত কিছুর?

বাবা কর্নেল তুষার লাহিড়ী সেনা চিকিৎসক। নিজেকে সেনা পরিবারের ছেলে বলা অনির্বাণের সাফ জবাব এল, ‘‘দেশকে ভালবাসি বলে। আর খেলাটাকে ভালবাসি।’’ যোগ করলেন, ‘‘ইন্টারনেটের যুগে খবর রাখা কঠিন নয়। দিনে শুধু কয়েকটা মিনিট বের করে নিতে হয়।’’

ভারতীয় গল্ফের প্রতি টান এত গভীর বলেই ভবিষ্যতে কী ভাবে গল্ফকে ফিরিয়ে দেবেন, সেটাও ভাবা শুরু করেছেন। বলছিলেন, ‘‘মেন্টর আর কোচরা চান আপাতত আমি শুধু কেরিয়ার নিয়ে ভাবি। তবে একবার বুট জোড়া তুলে রাখার পর ভারতীয় গল্ফের জন্য অবশ্যই কিছু করতে চাই। সেটা কোচিং হতে পারে, মেন্টরিং হতে পারে। আরও কিছু চিন্তা রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগাব।’’

পিজিএ ট্যুরের মতো শ্রেষ্ঠ পেশাদার সার্কিটে মানিয়ে নেওয়ার কাজটা সহজ হয়নি। ‘‘ও দেশে না গেলে বোঝাই যায় না গল্ফ খেলাটার কী অবিশ্বাস্য ফ্যান ফলোয়িং!’’ বলছিলেন অনির্বাণ। যিনি এই এক মরসুমে মার্কিন মুলুকে যত সই দিয়েছেন আর সেলফির আব্দার রেখেছেন, তত আজ পর্যন্ত এ দেশে দিতে হয়নি। বলছিলেন, ‘‘ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে সত্যিই সময় লাগছে। হঠাৎই যেন আমি দড়ির ও পারে। এত দিন যাঁরা প্রেরণা ছিলেন, মুগ্ধ হয়ে খেলা দেখতাম, তাঁরাই রাতারাতি প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁদের সঙ্গে লোকে আমারও ছবি তুলছে।’’ এটা বিহ্বল করেছে, আরও নম্র করেছে তাঁকে। বলছিলেন, ‘‘এত তাড়াতাড়ি যে আন্তর্জাতিক গল্ফে এত সাফল্য পাব ভাবিনি। সব খুব দ্রুত হয়ে গেল। তবে আমি যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছি, সেটা আমার কাছে সবচেয়ে গর্বের বিষয়।’’

খ্যাতির জ্বালাও টের পাচ্ছেন হাড়ে হাড়ে। দেশে ফিরে ইস্তক মোবাইলটা বিশ্রাম পায়নি বললেই হয়। অবশ্য সাক্ষাৎকারের প্রতিটা আব্দার হাসিমুখে মেটাচ্ছেন। তারই মধ্যে সামান্য অনুযোগ। ‘‘বাড়ি ফেরার পর থেকে সময়টা পিজিএ ট্যুরের চেয়েও স্ট্রেসফুল যাচ্ছে!’’ সেটা কী রকম জানতে চাইলে বললেন, ‘‘পিজিএ-তে খেলার পাশাপাশি আমেরিকার জীবনধারায় মানিয়ে নেওয়াও বেশ কঠিন। ওদের খাওয়ার ধরন আলাদা। তার উপর সব জায়গায় নিজে ড্রাইভ করে যেতে হয়। কোর্সগুলো সব তেপান্তরের মাঠে। কাছের ছোটছোট হোটেল বা বাড়িতে থাকা অভ্যাস করতে হয়। একেবারে একটা নতুন সংস্কৃতি। মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়।’’

তবু গল্ফের মেজর টুর্নামেন্ট খেলার চেয়েও বাড়ি ফিরে আরও চাপ। কারণ ‘‘একেবারে সাংসারিক সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’’ অবশ্য স্ত্রী ঈপ্সা সেই দায়িত্বের অনেকটাই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন বলে কৃতজ্ঞ অনির্বাণ। তবু রোজকার তেল-নুন-কাজের লোকের হিসাবনিকাশ যে তাঁর কম্ম নয়, সেটা বলে দিচ্ছেন।

আর জানাচ্ছেন, পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপের সাফল্য উৎসর্গ করছেন দেশকে। ‘‘স্বাধীনতা দিবসের সপ্তাহে এই সাফল্যের তাৎপর্য আমার কাছে আলাদা। সাফল্যটা দেশকে উৎসর্গ করছি।’’

বলে দিলেন ভারতীয় গল্ফের ‘মেজর’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন