India

হার না-মানা এই ভারত সকলের অনুপ্রেরণা

Advertisement

এরাপল্লি প্রসন্ন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:৪১
Share:

জয়ের উচ্ছ্বাস: অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের পরে পতাকা উড়িয়ে উদ্‌যাপন ভারতীয় ক্রিকেট দলের। মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। ছবি সংগৃহীত।

অতিমারি নিয়ে আতঙ্ক। কঠোর নিভৃতবাস পালন করা। পাঁচ তারা হোটেলে কয়েদখানার মতো আটকে থাকা। বাইরে যাওয়া যাবে না, নিজেদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকো। একের পর এক ক্রিকেটারকে চোটের জন্য হারানো। বলতে গেলে, রিজার্ভ বেঞ্চের ক্রিকেটারদের নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শেষ দু’টি টেস্টে খেলতে হয়েছে ভারতকে। তার পরেও যে ঐতিহাসিক মুহূর্ত অজিঙ্ক রাহানের দল উপহার দিল, তাকে অত্যাশ্চর্য বললেও হয়তো কম বলা হয়।

Advertisement

আমার মনে হয়, ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা টেস্ট প্রাপ্তিগুলির মধ্যে ঢুকে পড়ল ব্রিসবেনের তিন উইকেটে জয়। আর একটু এগিয়ে আমি এটাও বলতে চাই যে, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের কোনও জয়ের চেয়ে কোনও ভাবেই পিছিয়ে থাকবে না এই সাফল্য। অ্যাডিলেডে ৩৬ অলআউট হওয়ার পরে কে ভেবেছিল, এ ভাবে ফিরে আসতে পারে ভারতীয় দল? আমার মনে হয় এই জয় দেশের সব মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে। বার্তা দিয়ে গেল, কঠিন সময়েও হাল ছেড়ো না। অন্ধকারের পরেও আলোর খোঁজ পাওয়া যায় যদি তোমার মধ্যে সেই আলো খুঁজে নেওয়ার উদগ্র বাসনাটা থাকে। এই হার-না-মানা ভারতই অস্ট্রেলিয়া সফরের প্রাপ্তি। অতিমারির সময়েও যা প্রেরণা দিয়ে যাবে অন্য জগতের অন্য পেশার মানুষদেরও।

ব্রিসবেন এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ার দুর্গ। ৩৮ বছরে কোনও বিদেশি দল কখনও গ্যাবায় হারাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে। শেষ বার জিতেছিল ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চিরকাল গ্যাবার অতিরিক্ত বাউন্স আতঙ্কিত করে রেখেছে সব দলকে। কে ভেবেছিল, প্রথম দলের অনেক ক্রিকেটারকে হারিয়েও ব্রিসবেন দুর্গে অস্ট্রেলিয়াকে ধরাশায়ী করে দেবে ভারত? সব চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই জয় এসেছে তরুণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের হাত ধরে।

Advertisement

শেষ দিনে ভারতের জয়ের দুই নায়ক শুভমন গিল আর ঋষভ পন্থ। দ্বিতীয় জনকে ভারতীয় জনতা আগেই দেখে নিয়েছে। তবে দারুণ প্রতিভাবান হয়েও ঋষভ নিজের জায়গা পাকা করতে পারছিল না। প্রথমত, ওর উইকেটকিপিং নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। মোক্ষম মুহূর্তে ক্যাচ গলাচ্ছে, স্টাম্পিংয়ের সুযোগ নষ্ট করছে বলে একটা ধারণাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, একে দিয়ে কিপিং চলবে। আমার মনে হয়, ঋষভের উইকেটের কাছে দাঁড়িয়ে কিপিং করার সময় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বলটা ধরার সময়ে লোফার বদলে চাপড় মারতে যায়। এগুলো মেরামত করা কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে যে বাড়তি শক্তিটা ও দলের মধ্যে এনে দেয়, তার কোনও বিকল্প নেই। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির যোগ্য উত্তরসূরির নাম ঋষভ পন্থ। মঙ্গলবারের পরে আশা করি কেউ আর এ নিয়ে সংশয় রাখবেন না। ঋষভের যে জিনিসটা আমাকে সব চেয়ে প্রভাবিত করেছে, তা হল, ওর ভয়ডরহীন মনোভাব। সিডনিতে টেস্ট বাঁচানোর চাপের মধ্যে এসে ও রকম আগ্রাসী ইনিংস খেলে গেল। এ দিন ৫০-৬০ রান বাকি থাকতে স্কুপ মারছে, এক বার রিভার্স সুইপও মারতে গেল। আমাদের সময়ে ফারুক ইঞ্জিনিয়ারকে দেখেছি। ডানপিটে ব্যাটসম্যান ছিল ফারুক। কিন্তু ঋষভ ওর চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাবান। আমার মনে হয়, ধোনি ছাড়া এত শক্তিশালী ব্যাটিং প্রতিভা আর কখনও কারও মধ্যে দেখা যায়নি। ঋষভ করল ১৩৮ বলে ৮৯। এমন একটা ঝকমকে ইনিংস দেখার পরে শুভমন গিলের অবদানের কথা যেন ভুলে না যাই। ১৪৬ বলে ৯১ করে গিল কিন্তু সুরটা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল যে, আমরা ড্র করতে আসিনি। চোখে চোখ রেখে জিততে এসেছি। ভোরবেলায় টিভি খুলে ম্যাচ দেখতে বসে কোটি কোটি ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত কিন্তু প্রথম গিলের ব্যাটিং দেখেই বিশ্বাস করতে শুরু করে, ম্যাচটা আমরা জেতার জন্য খেলছি। আমার কাছে এই সিরিজের সেরা আবিষ্কার শুভমন গিল। যদি মাথা ঠিক রাখতে পারে, ভারতীয় ক্রিকেট আরও এক বড় তারকাকে পেতে চলেছে।

একটা কথা দেখলাম অনেকে বলছে। অস্ট্রেলিয়া না কি ৩২৮ রানের টার্গেট দিয়েছিল ভারতের সামনে। এটা একেবারেই ঠিক ব্যাখ্যা নয়। অস্ট্রেলিয়া মোটেও টার্গেট দেয়নি। লক্ষ্যটা ভারতীয় বোলারেরা স্থির করে দিয়েছিল দলের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার সাহস হয়নি ইনিংস ডিক্লেয়ার করার। ভারতের অনভিজ্ঞ বোলারেরাই ওদের অলআউট করে ৩২৮ রানের টার্গেট স্থির করে নেয়। এই বোলিং আক্রমণটার দিকে তাকান। মহম্মদ সিরাজের এই সিরিজেই অভিষেক ঘটেছে। ওয়াশিংটন সুন্দরের ব্রিসবেনেই অভিষেক ঘটল। ওয়াশিংটন খেলছে অশ্বিনের জায়গায়। এত বড় এক জন বোলার। সিডনিতে ব্যাট হাতেও দুর্দান্ত ভাবে টেস্ট বাঁচিয়েছে অশ্বিন। কিন্তু ওয়াশিংটন কোনও অভাবই বুঝতে দিল না। শার্দূলকে কেউ কখনও টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ভাবেনি। রবীন্দ্র জাডেজা বাইরে চলে যাওয়ার পরেও দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেল। ওয়াশিংটন-শার্দুলের ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসের জুটিটা ব্রিসবেন টেস্টের টার্নিং পয়েন্ট। দ্বিতীয় ইনিংসেও চাপের মুখে ওয়াশিংটন হুক করে ছয় মারল। এর সঙ্গে বলতেই হবে বাবাকে হারিয়েও হার-না-মানা সিরাজের কথা। বুমরা নেই, শামি নেই, ইশান্ত শর্মা নেই, উমেশ যাদব নেই। জীবনের অভিষেক সিরিজেই ছেলেটা বোলিংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার মনে হয় ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার গভীরতা এখন কতটা, সেটাও এই ২-১ সিরিজ জয় দেখিয়ে দিয়ে গেল। পরিকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে, দেশের সব প্রান্তে ক্রিকেট পৌঁছে গিয়েছে। সব চেয়ে বড় ব্যাপার, আইপিএলের মতো মঞ্চ পেয়েছে এখনকার তরুণ ক্রিকেটারেরা। যেখানে নিজেদের প্রতিভার স্ফুরণ দেখাতে
পারছে তারা।

অজিঙ্ক রাহানে এবং তোমার দল— টুপি খুলে কুর্নিশ জানাচ্ছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন