ব্যর্থতার দায় নিয়ে নতুন লড়াইয়ের শপথ

কড়া রোদে মাঠে দাঁড়িয়ে তিনি টিভি-র বিশ্লেষণ শেষ করতেই গ্যালারি থেকে আওয়াজ উঠল, ‘বীরুভাই, কাম ব্যাক। উই মিস ইউ।’ ৩৩৩ রানে হারের যন্ত্রণাতেই এই আর্তনাদ পুণের ক্রিকেটপ্রেমীদের।

Advertisement

রাজীব ঘোষ

পুণে শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৬
Share:

১-০ এগিয়ে যাওয়ার হুঙ্কার। পুণেয় স্মিথরা। শনিবার। -এএফপি

কড়া রোদে মাঠে দাঁড়িয়ে তিনি টিভি-র বিশ্লেষণ শেষ করতেই গ্যালারি থেকে আওয়াজ উঠল, ‘বীরুভাই, কাম ব্যাক। উই মিস ইউ।’

Advertisement

৩৩৩ রানে হারের যন্ত্রণাতেই এই আর্তনাদ পুণের ক্রিকেটপ্রেমীদের। বীরু তাঁদের দিকে শুধু একবার ফিরে তাকালেন। টিভির কমেন্ট্রি বক্স ও সোশ্যাল মিডিয়া জমিয়ে রাখা বীরেন্দ্র সহবাগকে ইদানীং এত গম্ভীর দেখা যায় না বলেই শোনা যায়।

শহরের প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখতে আসা ক্রিকেটপ্রেমীদের বুকে হারের কাঁটা বিঁধে থাকলে কী হবে, টিম ইন্ডিয়ার আবহাওয়া তেমন গুমোট নয়। স্টিভ ও’কিফের ঘূর্ণিতে পৌনে তিন দিনে টেস্ট হারের কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা ভারতীয় দলটাই ফিরল মাঠে। বল নিয়ে। তবে ক্রিকেট বল নয়। ফুটবল জাতীয় কিছু একটা। খেলতে খেলতে তুমুল হইচই, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, খুনসুটি। কে বলবে, একটু আগে এই দলটারই কপালে ঘরের মাঠে জঘন্যতম টেস্ট হারের একটা জুটেছে?

Advertisement

তবে সাংবাদিক বৈঠকে নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন বিরাট কোহালি। বলেছেন, ‘‘দু’বছরের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে খারাপ ব্যাটিং পারফর্ম্যান্স। অথচ এই ব্যাটিংটাই আমাদের গর্বের জায়গা ছিল। তবে ওটাও মাথায় রাখতে হবে টানা ১৯টা টেস্টে অপরাজিত থাকার পরে এ রকম একটা বিপর্যয় ঘটল। আসলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরই অঙ্গ এটা।’’

কিন্তু এ তো আর যে-সে হার নয়। ২০০৪-এ নাগপুরে অস্ট্রেলীয়দের কাছে ৩৪২ রানে হারের সেই স্মৃতি মুছে যাওয়ার আগেই এ দেশে এসে ফের একটা বড় আঘাত দিল অস্ট্রেলিয়া। যন্ত্রণাটা বেড়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। আর সেটাই হচ্ছে। পুণের এমসিএ স্টেডিয়াম থেকে চোখে জল নিয়ে বেরোতে বেরোতে এক মরাঠি তরুণ বলছিলেন, ‘‘আর কখনও খেলা দেখতে মাঠে আসব না।’’

আরও পড়ুন:

পটৌডি তো কখনও স্লেজ করেননি, স্মারক বক্তৃতায় বলে দিলেন বেদী

স্পিনের দেশে এসে ভারতীয় ড্রেসিংরুমের মধ্যে স্পিন জুজু ঢুকিয়ে দেওয়াটা নিঃসন্দেহে অস্ট্রেলিয়ার নৈতিক জয়। সিরিজের শুরুতেই যে এমন একটা ধাক্কা খেয়ে যাবে তারা, তা বোধহয় ভাবতেই পারেনি কোহালির ভারত। ‘‘ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপে ধস নামাতে যে দুরন্ত ঘূর্ণির প্রয়োজন নেই, নির্দিষ্ট লাইনে গুড লেংথ স্পটে সমানে বল ফেলে গেলেই যে কেল্লা ফতে করা সম্ভব, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ও’কিফ,’’ বিকেলে কলকাতায় বসে ফোনে বলেন বিষাণ সিংহ বেদী। স্টিভ ও’কিফের ডাকনাম ‘সক’। ভারতকে যা ‘শক’ দিলেন তিনি, তার পর থেকে এই নামের যথার্থতা নিয়ে নিশ্চয়ই আর কোনও প্রশ্ন নেই।

‘‘অস্ট্রেলীয় স্পিনারদের থেকে কিন্তু অশ্বিন, জাডেজাদের বল বেশি ঘুরেছে। তাও আজ একটা সেশনে ওদের ব্যাটসম্যানরা প্রায় ১৪০ রান তুলে ফেলল! ভারতীয় স্পিনের বিরুদ্ধে খেলার কতটা প্রস্তুতি নিয়ে ওরা এসেছে ভাবুন। অথচ আমাদের ব্যাটসম্যানদের কোনও প্রস্তুতি ছিল বলে তো মনেই হল না,’’ বলছিলেন বেদী।

তা হলে অস্ট্রেলীয় স্পিনারদের এই সাফল্যের কারণ? কোহালি-র জবাবটাই অনেকের টেমপ্লেট হয়ে থাকতে পারে। ক্যাপ্টেন বলেন, ‘‘ও’কিফের বলটা বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম বলটা ঘুরবে, তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বলটা হঠাৎ স্টাম্পে ঢুকে এল।’’

একা কোহালি নন, এ ভাবে এ দিন ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপের অনেকেই ধোঁকা খেয়েছেন। এমনকী চেতেশ্বর পূজারা, অজিঙ্ক রাহানের মতো টেকনিকে তুখোড় ব্যাটসম্যানরাও।

রবি শাস্ত্রী টিভি বক্স থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘ও’কিফের বলের লাইনই ধরতে পারেনি আমাদের ব্যাটসম্যানরা। ওর বল পিচে পড়ে কোন দিকে ঘুরবে, সেটাই বুঝতে পারছিল না। একটা নির্দিষ্ট স্পটে বলটা বারবার ফেলে ছেলেটা উইকেট তুলে নিয়ে গেল।’’ পাশাপাশি রেকর্ড বইয়েও ঢুকে গেলেন ও’কিফ। ভারতে একই টেস্টে ১২ উইকেট এর আগে কোনও বিদেশি স্পিনার নিতে পারেননি। মুম্বইয়ে একবার ১৩ উইকেট নিয়েছিলেন ইয়ান বোথাম। কিন্তু স্পিনারদের দেশে এসে কোনও বিদেশি স্পিনারের এমন দাপট এই প্রথম।

দু’ইনিংস মিলিয়ে ৭৪ ওভার ব্যাট করল ভারত। যা এর আগে কোনও হোম টেস্টে হয়নি। সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টাও ক্রিজে থাকতে পারেনি বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল। ১০৫ রানের পরে ১০৭ অল আউট।

আগের দিন বার চারেক জীবন পাওয়া স্টিভ স্মিথ ১৮ নম্বর টেস্ট সেঞ্চুরিটা করে ভারতের ঘাড়ে ৪৪১ রানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার পরে বোঝাই গিয়েছিল হার ছাড়া কোনও রাস্তা নেই ভারতের। কিন্তু এই আত্মসমর্পণ! ভাবা যায়নি। যা দেখে অজিত ওয়াড়েকরকে ফোনে বলতে শোনা গেল, ‘‘বিদেশি কোনও স্পিনারেরর বিরুদ্ধে এত খারাপ ব্যাটিং আমি কখনও দেখিনি। এই উইকেটে কী ভাবে ব্যাট করতে হয়, স্মিথ, রেনশরা বরং দেখিয়ে দিল। স্পিনের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যাটসম্যানরা যে এত দুর্বল, তা তো জানা ছিল না।’’ মুরলী বিজয় এবং কে এল রাহুল আউট হওয়ার সময় অনর্থক দুটো রিভিউ কেন নিয়ে নেওয়া হল, সেও রহস্য।

আসলে খারাপ সময় যখন আসে তখন এ ভাবেই আসে। তবে এখনও তিনটে টেস্ট বাকি এই সিরিজে। রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ও দিকে ভারত অধিনায়কও ফিরে আসার জন্য তৈরি। শপথ নিচ্ছেন, নতুন লড়াইয়ের। বলছেন, বেঙ্গালুরুতে অনেক ভাল ফর্মের ভারতকে দেখা যাবে।

এক বনাম দুইয়ের লড়াইটা কিন্তু জমে গেল।

স্কোরবোর্ড

অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১৪৩-৪-এর পর) স্মিথ এলবিডব্লিউ জাডেজা ১০৯, মিচেল মার্শ ক সাহা বো জাডেজা ৩১, ওয়েড ক সাহা বো উমেশ ২০, স্টার্ক ক রাহুল বো অশ্বিন ৩০, ও’কিফ ক সাহা বো জাডেজা ৬, লায়ন এলবিডব্লিউ উমেশ ১৩, হ্যাজলউড ন.আ.২, অতিরিক্ত ১৪, মোট ২৮৫, পতন: ১০-২৩-৬১-১১৩-১৬৯-২০৪-২৪৬-২৫৮-২৭৯-২৮৫। বোলিং: অশ্বিন ২৮-৩-১১৯-৪, জাডেজা ৩৩-১০-৬৫-৩, উমেশ ১৩-১-৩৯-২, জয়ন্ত ১০-১-৪৩-১, ইশান্ত ৩-০-৬-০।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস: বিজয় এলবিডব্লিউ ও’কিফ ২, রাহুল এলবিডব্লিউ লায়ন ১০, পূজারা এলবিডব্লিউ ও’কিফ ৩১, বিরাট বো ও’কিফ ১৩, রাহানে ক লায়ন বো ও’কিফ ১৮, অশ্বিন এলবিডব্লিউ ও’কিফ ৮, ঋদ্ধিমান এলবিডব্লিউ ও’কিফ ৫, জাডেজা বো লায়ন ৩, জয়ন্ত ক ওয়েড বো লায়ন ৫, ইশান্ত ক ওয়ার্নার বো লায়ন ০, উমেশ ন.আ. ০, অতিরিক্ত ১২, মোট ১০৭, পতন: ১০-১৬-৪৭-৭৭-৮৯-৯৯-১০০-১০২-১০২-১০৭। বোলিং: স্টার্ক ২-২-০-০, লায়ন ১৪.৫-২-৫৩-৪, ও’কিফ ১৫-৪-৩৫-৬, হ্যাজলউড ২-০-৭-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন