প্রস্তুতি: অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের বাকি আর মাত্র আঠারো দিন। গোয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ের অনুশীলনে ব্যস্ত ভারতের যুব দলের ফুটবলাররা। ছবি: টুইটার।
ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখত কেউ।
ব্যাডমিন্টন তারকা হওয়ার লক্ষ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলনে নিজেকে ডুবিয়ে রাখত কেউ।
মাইকেল জর্ডানের মতো বাস্কেটবল কোর্টে ঝড় তোলার স্বপ্নও দেখেছিল কেউ।
ফুটবলার হওয়ার ভাবনা কারও মধ্যেই ছিল না। অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপে এরাই ভারতীয় দলের ভরসা!
জালন্ধরের ছয় ফুটেরও বেশি উচ্চতার আনোয়ার আলি ভারতীয় রক্ষণের অন্যতম ভরসা। আনোয়ারের স্বপ্ন ছিল অলরাউন্ডার হওয়া। শুরু করেছিল ক্রিকেটার হিসেবেই। কিন্তু বাবা চাইতেন ছেলে ফুটবলার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হোক। কিছু জোর করেই ছেলেকে পঞ্জাবের মাহিলপুল অ্যাকাডেমিতে আট বছর বয়সে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই স্ট্রাইকার হিসেবে নজর কেড়ে নিয়েছিল আনোয়ার। অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় দলের ট্রায়ালে নির্বাচিতও হয়। তার পর ফের চমক। উচ্চতা ও শারীরিক গঠনের জন্য আনোয়ারের পজিশনই বদলে দেন কোচ লুইস নর্টন দে মাতোস। স্ট্রাইকার থেকে ডিফেন্ডার। সন্দেশ ঝিঙ্গানের ভক্ত ভারতীয় দলের প্রতিশ্রুতিমান ডিফেন্ডার অবশ্য জানিয়েছে, দলের প্রয়োজনে যে কোনও জায়গায় খেলতে রাজি।
এই মুহূর্তে গোয়ায় প্রস্তুতি চলছে ভারতীয় দলের। শনিবার এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস ম্যাচে ০-১ গোলে হেরে গিয়েছে ভারতীয় দল। আজ, সোমবার খেলবে মরিশাসের বিরুদ্ধে। গোয়া থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে আনোয়ার বলল, ‘‘ব্যাটিং ও বোলিং দু’টোই করতাম। ভারতীয় ক্রিকেট দলে খেলাই ছিল আমার শৈশবের স্বপ্ন। কিন্তু আমার বাবা নিজে যে হেতু ফুটবলার ছিলেন, চাইতেন আমিও ফুটবল খেলি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাহিলপুর অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এখন অবশ্য ফুটবলই আমার প্রিয় খেলা।’’ আত্মবিশ্বাসী আনোয়ার যোগ করল, ‘‘বিপক্ষে যত ভালই স্ট্রাইকারই থাক, সহজে গোল করতে দেব না।’’
গোলকিপার ধীরাজ সিংহ মইরাংথেম মণিপুর থেকে কল্যাণীতে এসেছিল ট্রায়াল দিতে। আনোয়ারের মতো ধীরাজেরও শৈশবে ফুটবলের প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হওয়া। নিয়মিত অনুশীলনও করত। কিন্তু দুর্দান্ত ফিটনেসের জন্য তাকে ফুটবল খেলার পরামর্শ দেন স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক। তার পরেই নাটকীয় উত্থান। অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলের ট্রায়ালে নেমেই ধীরাজ নজর কেড়ে নেয় নির্বাচকদের। পেতহ চেহ্-ভক্ত ধীরাজের কথায়, ‘‘এখন আর ব্যাডমিন্টন ছাড়ার জন্য কোনও আক্ষেপ নেই। সুযোগ পেলে নিজেকে উজাড় করে দেব।’’ মণিপুরের বরিস সিংহ থাংজাম-ও ব্যাডমিন্টন ছেড়ে ফুটবলকে বেছে নিয়েছে।
অধিনায়ক সুরেশ সিংহ ছিল গোলরক্ষক। কিন্তু জাতীয় দলে মাঝমাঠে মণিপুরের এই কিশোরই এখন প্রধান ফুটবলার। আর এক মিডফিল্ডার মণিপুরের জ্যাকসন সিংহ ও সিকিমের কোমল থাহার মিক্সড মার্শাল আর্ট শিখতে শিখতেই ফুটবলে যোগ দেয়। মহারাষ্ট্রের সৌরভ মেহের প্রতিশ্রুতিমান সাঁতারু ছিল। এখন অবশ্য ফুটবলই তার ধ্যান-জ্ঞান। আবার বাস্কেটবল খেলোয়াড় হতে চাইত লালেনমাওয়াইয়া।
গত দু’বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এ ভাবেই অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলের জন্য ফুটবলার নির্বাচন করেছেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের স্পটাররা। ফুটবলার বাছার ক্ষেত্রে কী কী মাপকাঠি ছিল? বাংলায় যাঁরা ট্রায়াল নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক দেবজিৎ ঘোষ। তিনি বললেন, ‘‘যুব বিশ্বকাপ হবে ২০১৭-এর অক্টোবরে। তাই এমন ফুটবলার নিতে হবে যাদের টুর্নামেন্টের সময় বয়স যেন সতেরোর কম থাকে। দুই, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার মতো শারীরিক গঠন। তাই বেশি উচ্চতার ফুটবলারদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তিন, ফুটবলের প্রাথমিক জ্ঞান। অর্থাৎ হেডিং, পাস দেওয়ার দক্ষতা, অনুমান ক্ষমতা যাচাই করেই প্রথম পর্বে প্রাথমিক ভাবে চল্লিশ জন ফুটবলার তৎকালীন অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় দলের কোচ নিকোলাই অ্যাডামকে বেছে দিয়েছিলাম আমরা।’’
বিতর্কে জড়িয়ে অ্যাডান বহিষ্কৃত হন। তাঁর পরিবর্তে ভারতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছেন নর্টন। এই মুহূর্তে ২৭ জন ফুটবলারকে নিয়ে গোয়ায় শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারছেন তিনি। ৪-৪-২ ফর্মেশনে ম্যাচ প্র্যাকটিসের উপরেই জোর দিচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের কোচ। ২১ জনকে বেছে নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করবেন নর্টন।
দল গঠনের মতো বিশ্বকাপেও ভারত চমক দেবে কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।