Sports Story

‘ট্রাক নিয়ে বাবা এখন বাংলাদেশ সীমান্তে, দেখা হবে বলেছে’

জীবনটা হঠাৎই বদলে গিয়েছে। গায়ের নীল জার্সি আর হাতের লাল ব্যান্ডে লেখা ‘ক্যাপ্টেন’ শব্দটার মধ্যে যে এত শক্তি ছিল সেটা আগে বোঝেননি। রাতারাতি হিরো হয়ে যাওয়ার স্বাদ ঠিক কেমন হয়? সম্বিত ফিরতে সময় লেগেছিল ২০ বছরের হরজিৎ সিংহর।

Advertisement

সুচরিতা সেন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:১২
Share:

বিশ্বকাপ হাতে হরজিৎ সিংহ।

জীবনটা হঠাৎই বদলে গিয়েছে।

Advertisement

গায়ের নীল জার্সি আর হাতের লাল ব্যান্ডে লেখা ‘ক্যাপ্টেন’ শব্দটার মধ্যে যে এত শক্তি ছিল সেটা আগে বোঝেননি। রাতারাতি হিরো হয়ে যাওয়ার স্বাদ ঠিক কেমন হয়? সম্বিত ফিরতে সময় লেগেছিল ২০ বছরের হরজিৎ সিংহর। মনে হচ্ছিল , ‘‘আমি কি সত্যিই পেরেছি? অনেক পরে সতীর্থদের ধাক্কাধাক্কিতে মনে হল হ্যাঁ পেরেছি। দেশকে ১৫ বছর পর জুনিয়র হকি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করতে পেরেছি আমরা।’’ তার পরটা তো ইতিহাস। হরজিৎদের সঙ্গে উৎসবে মেতেছে পুরো দেশ।

এই তো সেদিনের কথা। গত রবিবার। লখনউ-এর মাটিতে ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পরে স্টেডিয়াম জুড়ে যে ‘ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া’ চিৎকারটা ইকো হচ্ছিল সেটা বুধবার ফাঁকা কলকাতা সাই সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়েও কানে বাজছিল হরজিৎ সিংহর। সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এখনও গলা কেঁপে উঠছিল সদ্য ভারতীয় হকিকে স্বপ্ন দেখানো এই মিড ফিল্ডারের। বলছিলেন, ‘‘এই প্রথম ২০ হাজার দর্শকের সামনে খেললাম। অদ্ভুত অনুভূতি।’’ সমর্থকদের সামনে খেলারও তো একটা চাপ রয়েছে তাও আবার অধিনায়কের দায়িত্ব এই ছোট্ট কাঁধে। দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে যে সে আবার ছোট কোথায়? তাই হয়তো ছোট কাঁধ শুনে হেসে ফেলেছিলেন হরজিৎ। ‘‘চাপ না, সমর্থকরা যখন গ্যালারি থেকে আমাদের জন্য গলা ফাটায় তখন চাপের থেকেও বেশি উৎসাহ পাই।’’

Advertisement

বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়িতে হরজিৎ সিংহ।

এই বয়সেই এত মনের জোড়, এত আত্মবিশ্বাস দেখলে অবাক হতে হয়। কথায় কোনও জড়তা নেই। বলে যেতে পারেন অনর্গল। প্রতিদিন নিজেকে উন্নতির কথা বলেন ছোট ছেলেটি। আসলে জীবন যুদ্ধের কষ্ট দেখেছেন জ্ঞ্যান হওয়ার পর থেকেই। পঞ্জাবের মোহালি জেলার কুরালি গ্রামের ছোট্ট ঘরটায় দিন আনা দিন খাওয়ার সংসারে হকি ছিল বিলাসিতা। বাবা রামপাল সিংহ অন্য লোকের ট্রাক চালান। ট্রাক বোঝাই করে বেরিয়ে পড়েন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কী থাকে সেই ট্রাকে? ‘‘যখন যা পায়, তাই নিয়ে যায়।’’ কখনও সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে। বাবার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। কাকতালীয় ঘটনাই বটে। বলছিলেন হরজিৎ, ‘‘আমি কালকেই কলকাতায় এসেছি। আর বাবা এখন রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডারে। কাল আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে।’’ আবেগী শোনায় হরজিতের গলা। কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে সীমান্তের রেখা, মিশে গিয়েছে রাজ্যের বাউন্ডারি। বাবা-ছেলের টানে কমে গিয়েছে পঞ্জাব-কলকাতার দুরত্ব।’’

ট্রাক থেকে জিনিস নামাতে ব্যস্ত হরজিতের বাবা।

আরও খবর: এখনই বন্ধ করে দেওয়া উচিত বেটন কাপ, মনে করেন দীপক ঠাকুর

বিশ্বকাপ শেষেই যোগ দিয়েছেন অফিস দলে। চলে এসেছেন কলকাতায় বেটন কাপ খেলতে। ভারত পেট্রোলিয়ামের হয়ে সাই সেন্টারে খেলেও ফেলেছেন বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক। কিট ব্যাগ কাঁধে সল্টলেকের রাস্তায় যখন তাঁকে পেলাম তখন ট্যাক্সির অপেক্ষায় তিনি। মুহূর্তে বদলে গিয়েছে হরজিতের জগৎ। ছোটবেলায় পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে এমনিই হকি খেলতে নেমে পড়তেন। সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখার শুরু। পরিবার ভেবেওছিল ছেলের স্বপ্ন পূরণ করবে। ধার দেনা করে হকি স্টিক কিনে দিয়েছিল হরজিৎকে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বুঝতে পারেন আর সম্ভব নয়। ছেলেকে খেলা ছেড়ে পড়াশোনায় মন দিতে বলেন হরজিতের বাবা-মা। ‘‘পড়ায় মন বসত না। চেষ্টা করেছিলাম জানেন। কিন্তু হকিই ছিল আমার জীবন। পারিনি ওটা ছেড়ে থাকতে। স্থানীয় গোপাল হকি অ্যাকাডেমিতে চলে গিয়েছিলাম চুপচাপ। বাড়ির কেউ দীর্ঘদিন জানত না আমি হকি ট্রেনিং নিচ্ছি। কোচ, সিনিয়ররা প্রচুর সমর্থন করেছে। না হলে পারতাম না।’’

বুধবার কলকাতা সাইয়ে ভারতীয় জুনিয়র হকি দলের অধিনায়ক হরজিৎ সিংহ।

‘‘বাড়ি থেকে যে হকি স্টিকটি কিনে দিয়েছিল সেটা প্র্যাকটিস করার সময় ভেঙে যায়। বাড়িকে আর জানাতে পারিনি। কারণ বাড়ির কেউ তখনও জানে না হকি চালিয়ে যাচ্ছি আমি। সেই সময় অ্যাকাডেমির সবাই মিলে চাঁদা তুলে আমাকে স্টিক কিনে দিয়েছিল,’’ বলেন তিনি। হঠাৎই একদিন বাড়ির লোক জানতে পারে খেলা ছাড়েনি বাড়ির ছেলে। খুব বকুনি খাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু ততদিনে স্থানীয় হকিতে নাম হতে শুরু করেছে গ্রামের ছেলের। আর বাঁধা দিতে পারেনি তাঁর পরিবার। ভাইয়ের খেলার জন্য টাকা জোগাড় করতে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন হরজিতের দাদা।

২০০৮ সালে জালন্ধরের সুরজিৎ অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন তিনি। ভেবেছিলেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক সুরজিৎ সিংহর মতো ফুলব্যাকে খেলবেন। কিন্তু কোচেদের পরামর্শে হয়ে যান মিডফিল্ডার। তার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ঠিকই। সাফল্য এখন তাঁর সঙ্গেই চলে। চাকরিও পেয়েছেন। কিন্তু এখনও বাবার ট্রাক চালানো ছাড়াতে পারেননি। বাড়ি ফিরলে উঠোনের ছোট্ট খাটিয়াটায় বাবা মায়ের সঙ্গে বসে ভাগাভাগি করে নেন জীবনের সব অভিজ্ঞতা। সঙ্গে চলে দুটো স্বপ্ন। এক, ট্রাকের স্টিয়ারিং থেকে বাবার হাতকে মুক্তি দেওয়া। দুই, টোকিও অলিম্পিক্স।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন