পেসারের দিন, নাটকের টেস্ট

ইশান্ত-রাজ ভুলিয়ে টেস্ট ফের ‘ডিউস’

সিংহল ক্রিকেটের বড়-মেজো-সেজো-ছোট কর্তাদের মন বেশ খারাপ। প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে ভারত এল, বিরাট কোহলির মতো ক্যারিশমা-সম্পন্ন ক্রিকেটার খেলতে এলেন, সিরিজ উত্তেজনার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে ১-১, অথচ টিকিট কাউন্টারে হাই উঠছে।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কলম্বো শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪২
Share:

ভারত ৩১২ ও ২১-৩
শ্রীলঙ্কা ২০১

Advertisement

সিংহল ক্রিকেটের বড়-মেজো-সেজো-ছোট কর্তাদের মন বেশ খারাপ। প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে ভারত এল, বিরাট কোহলির মতো ক্যারিশমা-সম্পন্ন ক্রিকেটার খেলতে এলেন, সিরিজ উত্তেজনার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে ১-১, অথচ টিকিট কাউন্টারে হাই উঠছে। লঙ্কার ক্রিকেট-আভিজাত্যের সেরা সৌধে ঢুকতে সর্বাধিক মূল্যের যে টিকিট কাটতে হবে, তা ভারতীয় মুদ্রায় দেড়শো টাকা। তবু রবিবারের অবসরেও দর্শকসংখ্যা একশো পেরোলো না। দু’এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা, জনা পঁচিশেক হাতে পতাকা নিয়ে, আর বাকি বারো আনা এ দিক ও দিক অবিন্যস্ত। অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার তো রীতিমতো গলদঘর্ম। গ্যালারির কোথায় জুম করবে ক্যামেরা? লেন্স কী দেখাবে? লাঞ্চের সময় বেরিয়ে দেখা গেল, এসএসসি স্টেডিয়ামের লাগোয়া মাঠটায় কয়েক জন কিশোর ব্যাট পেটাচ্ছে। পাশের মাঠের কাণ্ডকারখানা নিয়ে তাদের ন্যূনতম আগ্রহও নেই। সাধারণ ‘টুকটুক’ চালকের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে গেলে দাঁত-খিঁচুনি আসছে— নো সঙ্গা, নো মাহেলা, হোয়াট ম্যাচ!

Advertisement

বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী, শান্তিপ্রিয়, ভারত মহাসাগর তটভূমির এই পুঁচকে দেশটার প্রায় অর্ধেক জানতেই পারল না, আজ তাঁদের দেশে টেস্ট ক্রিকেটের এক বিরল দিন নীরবে কেটে গেল। যেখানে অধুনা ক্রিকেটের স্বভাববিরোধী হয়ে গোটা দিন ফুলকি ছুটল পেস বোলিংয়ের। একটা ইনিংস শেষ হয়ে গেল শুরুর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। পনেরোটা উইকেট উড়ে গেল নিমেষে। দু’টো টিম মিলেজুলে আড়াইশো তুলতে না তুলতে। লঙ্কা ব্যাটিংকে কাঁপিয়ে ইশান্ত শর্মা বিদেশে জাহির খানের যোগ্য উত্তরসূরির পাসপোর্ট পেশ করলেন ঠিকই, কিন্তু তার কিছুক্ষণের মধ্যে ধামিকা প্রসাদকে মনে হল ম্যালকম মার্শাল! যিনি থার্ড ডে পিচে বিরাট কোহলির মুখের পাশ দিয়ে অবিরাম বার করে গেলেন!

ভারত-শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় টেস্ট কম হয়নি। দ্বীপপুঞ্জে এমনই এক যুদ্ধে মুরলীধরন আটশো উইকেট নিয়েছেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত আটানব্বই ভারতকে টেস্ট জিতিয়েছে। কিন্তু পেসারদের আড়াই দিন ধরে এমন টানা সিংহবিক্রম, ক্রিকেটপ্রেমীকে থ্রিলারের হটসিটে দিনভর বসিয়ে রাখা, সর্বোপরি টি-টোয়েন্টি ও ওয়ান ডে-র উত্তেজনাকে টেস্ট ক্রিকেটের এমন চরম নিষ্ঠুর পদাঘাত কোথায়, উপমহাদেশে ইদানীং তো দেখা যায়নি। এ যেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটের কান মুলে টেস্টের বুঝিয়ে দেওয়া যে, তোর এখন বাজার ভাল। অফিস ফেরতের কাছে চলছে বেশি। কিন্তু আমি, আমার রোম্যান্স, সর্বকালীন। তোর ঠুনকো চাকচিক্য আমার গর্বের দেওয়ালে ফাটল ধরাবে না!

ঠিকই। রবিবারের পর এসএসসি টেস্ট কোন দিকে যাবে, প্রশ্নটা পশ্চিমবঙ্গের এসএসসি পেপারসেটার রাখলে মন্দ হয় না। কারণ, তিনটে সম্ভাবনাই পড়ে। মন বলছে, সিরিজ ভারতের। দিনের শেষ প্রহরে ২১ রানে তিনটে গেলেও লিডটা এখনই ১৩২ রানের। ওটা আড়াইশো পার করলে কে ঠেকাবে? যুক্তি বলছে, টেস্টটা শ্রীলঙ্কারও। চতুর্থ দিনের প্রথম দু’ঘণ্টায় যদি কোহলিদের গোটা চারেক বার করা যায়, টার্গেট যদি থাকে দুশোর নীচে, তখন? দুশো ছুঁইছুঁই লিডও যে জয়ের অ্যাকাউন্ট খোলার নিশ্চিন্ত পাসওয়ার্ড নয়, গল টেস্ট সেটা দেখিয়েছে। তৃতীয় একটা পক্ষও থাকছে। কলম্বোর মেঘ। সে যদি আকাশ ভেঙে নামে, কে বলতে পারে এমন হাড়হিম করা টেস্ট যুদ্ধের পরিণতি ড্রয়ের ট্র্যাজিক করমর্দনে শেষ হবে না? পূর্বাভাস কিন্তু আছে।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন

এবং এই যে অনিশ্চয়তার সরণিতে সিরিজ নির্ধারক টেস্টকে নিয়ে ফেলা, কোহলির সিরিজ জয়ের ভাগ্যকে ধোঁয়াশায় ঢেকে ফেলা, এর পিছনে দু’টো কারণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমটা, এসএসসি পিচ। যা বড় বেয়াড়া। হাতে নতুন বল থাকলে সে পেসারকে পিচ হাত উপুড় করে দিচ্ছে। আর দিচ্ছে সকালের প্রথম দু’ঘণ্টায়। প্রথম সেশনে। বাকিটা থাকছে ব্যাটসম্যানের। যখন একটা অমিত মিশ্র বা রঙ্গনা হেরাথকে আউট করতে বোলার বিপর্যস্ত। ইশান্ত শর্মা লঙ্কা ব্যাটিংকে এ দিন প্রথম সেশনে পেয়ে গিয়েছিলেন। এবং পিচ থেকে সিম আর বাউন্স টানা বার করে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজদের ব্যাটিংকে একা চুল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

দিল্লি পেসার প্রায়শই অনুযোগ করতেন যে, তাঁর পারফরম্যান্সটাই কারও মনে থাকে না। সহজলভ্য কোপ দিতে হলে তাঁর নামটাকেই সর্বাগ্রে বেছে নেওয়া হয়। এ দিন ইশান্ত দেখিয়ে দিলেন আগ্রাসন হোক বা আগুন, উমেশ-বরুণদের তরুণ প্রজন্মের চেয়ে তিনি কয়েক মাইল এগিয়ে। ইশান্ত আজ বল করেননি, ট্রিগার টিপেছেন। শ্রীলঙ্কা ইনিংসের পাঁচ ওভারের মধ্যে থরঙ্গাকে তুলে নিয়েছেন। ব্যাটিং লাইন আপের এমন অবস্থা করে ছেড়েছেন যে, উনিশ ওভারের মধ্যে ক্রিজে কি না ধামিকা প্রসাদ! অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজকে করা তাঁর ডেলিভারিটা প্রায় স্বপ্নের। গুড লেংথে পড়ে সম্মোহিত লঙ্কা অধিনায়কের খোঁচা নিয়ে কিপারে গ্লাভসে চলে গেল। ইশান্ত থামলেন পাঁচটা নিয়ে। টেস্টে দু’শো উইকেট থেকে তিন পা দূরে। টিমকে তিনি এমন এক জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, যা থেকে সোনার ফসল উঠতেই পারত। শ্রীলঙ্কা কিন্তু ৪৭-৬ হয়ে গিয়েছিল!

কিন্তু ফসল উঠল না, নষ্ট হল। এবং ওখানেই দ্বিতীয় কারণের প্রবেশ। লোকেশ রাহুলের হাত।

কর্নাটকী যুবক সম্ভবত এ দিন একটা রেকর্ড করলেন। একই টেস্টের দু’ইনিংসে একই ভাবে জাজমেন্ট দিতে গিয়ে বোল্ড হয়ে। কিন্তু ম্যাচের প্রভাবে তার চেয়েও গুরুতর বোধহয় স্লিপে কুশল পেরেরাকে দশের নীচে ছাড়া। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটমহলে তাঁর একটা ডাকনাম আছে— জুনিয়র জয়সূর্য। কেন, টেস্টে একশোর কাছে স্ট্রাইক রেট রেখে বুঝিয়ে গেলেন অভিষেককারী। তাঁর অকুতোভয় হাফসেঞ্চুরি চুল্লি থেকে লঙ্কা ব্যাটিংকে যুদ্ধে ফিরিয়ে আনল। ফলো অন বাঁচাল। শেষ চার উইকেটে অমূল্য ১৫৪ যোগ করিয়ে দিল।

অধিনায়ক কোহলিকেও বড় বিভ্রান্ত লাগল এ সময়। কুশল ওপেনার। পেসার খেলতে ভালবাসেন। অশ্বিনকে আর একটু আগে কি আনা যেত না? অমিত মিশ্রকেও তো সাঁইত্রিশ ওভারের আগে ডাকা যেত। উল্টে কুশলের ব্যাট, কোহলির ভুল আর লোকেশের ক্যাচ মিসে ধামিকাকে শাসনের নতুন মঞ্চ দিয়ে গেল। দিনের শ্রেষ্ঠ ডেলিভারিতে যিনি ইতিমধ্যে তুলে নিয়েছেন পূজারাকে। এবং বাঁ হাতে সাদা টেপ, ভয়াবহ মুভমেন্ট, মুখে ক্রূর হাসি দেখে ভয়ই লাগছে। আবার সকাল আসছে। আবার আসছে আতঙ্কের প্রথম সেশন।

কাছাকাছি মন্দির আছে? কোহলিরা ভোরে একবার ঘুরে এলে পারেন না?

ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৯২-৮)

পূজারা ন.আ. ১৪৫, ইশান্ত বো হেরাথ ৬, উমেশ বো হেরাথ ৪, অতিরিক্ত ১৮, মোট ৩১২ অল আউট। পতন: ২, ১৪, ৬৪, ১১৯, ১১৯, ১৭৩, ১৮০, ২৮৪, ২৯৮। বোলিং: প্রসাদ ২৬-৪-১০০-৪, প্রদীপ ২২-৬-৫২-১, ম্যাথেউজ ১৩-৬-২৪-১, হেরাথ ২৭.১-৩-৮৪-৩, কৌশল ১২-২-৪৫-১।

শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংস

থরঙ্গা ক লোকেশ বো ইশান্ত ৪, সিলভা বো উমেশ ৩, করুণারত্নে ক লোকেশ বো বিনি ১১, চন্ডীমল এলবিডব্লিউ বিনি ২৩, ম্যাথেউজ ক নমন বো ইশান্ত ১, থিরিমান্নে ক লোকেশ বো ইশান্ত ০, পেরেরা ক কোহলি বো ইশান্ত ৫৫, প্রসাদ স্টাঃ নমন বো মিশ্র ২৭, হেরাথ ক নমন বো ইশান্ত ৪৯, কৌশল এলবিডব্লিউ মিশ্র ১৬, প্রদীপ ন.আ. ২, অতিরিক্ত ১০, মোট ২০১ অল আউট। পতন: ১১, ১১, ৪০, ৪৫, ৪৭, ৪৭, ৪৮, ১২৭, ১৫৬, ১৮৩। বোলিং: ইশান্ত ১৫-২-৫৪-৫, উমেশ ১৩-২-৬৪-১, বিনি ৯-৩-২৪-২, অশ্বিন ৮-১-৩৩-০, মিশ্র ৭.২-১-২৫-২।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস

পূজারা বো প্রসাদ ০, লোকেশ বো প্রদীপ ২, রাহানে এলবিডব্লিউ প্রদীপ ৪, কোহলি ন.আ. ১, রোহিত ন.আ. ১৪, অতিরিক্ত ০, মোট ২১-৩। পতন: ০, ২, ৭। বোলিং: প্রসাদ ৪.১-২-৮-১, প্রদীপ ৩-১-৬-২, হেরাথ ১-০-৭-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন