ফাইনাল উত্তপ্ত হবে গুরু-শিষ্যের ধর্মযুদ্ধেও

টুর্নামেন্টের সেরা প্রতিশ্রুতিমান কিপার বনাম তাঁরই আদর্শ কিপার ! বাংলা বনাম বাংলা। হুগলি বনাম বর্ধমান। ‘সেভজিৎ’ বনাম ভারতীয় ফুটবলের লিয়েন্ডার পেজ!

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৭
Share:

মুখোমুখি। আইএসএল ফাইনালে শিষ্য দেবজিতের লড়াই এ বার গুরু সন্দীপের বিরুদ্ধে।

টুর্নামেন্টের সেরা প্রতিশ্রুতিমান কিপার বনাম তাঁরই আদর্শ কিপার !

Advertisement

বাংলা বনাম বাংলা। হুগলি বনাম বর্ধমান।

‘সেভজিৎ’ বনাম ভারতীয় ফুটবলের লিয়েন্ডার পেজ!

Advertisement

কে বলল রবিবাসরীয় আইএসএল ফাইনালের ট্যাগলাইন শুধুই সচিন বনাম সৌরভের দলের লড়াই?

কোচিতে দুই ফাইনালিস্টের গোলের নীচে দুই বঙ্গসন্তান গোলকিপারের যুদ্ধও কম উত্তেজক নয়! সেটাও এটিকে বনাম কেরল ব্লাস্টার্স সামিট যুদ্ধের একটা ইউএসপি।

দেবজিৎ মজুমদার বনাম সন্দীপ নন্দীর গ্লাভস-যুদ্ধ।

যে যুদ্ধকে লেখার শুরুতে উল্লেখিত অনেক ট্যাগলাইন-ই দেওয়া যায়। যে লড়াই আবার ‘গৃহযুদ্ধ’-র মোড়কেও হাজির। কিংবা ‘ধর্মযুদ্ধ’-র মোড়কে!

ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত এ বারের আইএসএলে দেবজিৎ এটিকে-র ম্যাচে যা-যা ভুল করতেন তা ফোনে শুধরে দিতেন কেরলের সন্দীপ। ম্যাচের পরপরই কথা হত দু’জনের। আবার সন্দীপ ভাল খেললে ‘কনগ্র্যাটস্’ লিখে হোয়াটসঅ্যাপ করতেন দেবজিৎ।

কিন্তু গত চব্বিশ ঘণ্টায় সবই যে ওলটপালট! এক জন অন্য জনকে হারাতে মরিয়া এখন। দেবজিৎ-সন্দীপ সম্পর্ক সামনের তিন দিন শত্রুতার— বাক্যটা ক্লিশে মনে হতে পারে, বৃহস্পতিবার স্বয়ং দুই কিপারের কথাবার্তা শুনলে। বরং বলা উচিত, কোচিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন দু’দলের দুই বাঙালি গোলকিপার। বিধাননগরের মাঠে অনুশীলনে নামার আগে দেবজিৎ যেমন বলে দিলেন, ‘‘জানি না ফাইনালে খেলব কি না। যদি খেলি সন্দীপদা সে দিন আমার সব চেয়ে বড় শত্রু হয়ে থাকবেন ম্যাচের নব্বই মিনিট। কিংবা একশো কুড়ি মিনিট। বা টাইব্রেকারে। আমাদের স্ট্রাইকাররা যাতে সন্দীপদার জালে বল ঢোকাতে পারে সে জন্য সারাক্ষণ চেঁচিয়ে যাব আমাদের গোললাইন থেকে।’’

অন্য দিকে হোটেল সমস্যায় বৃহস্পতিবারও দিল্লিতে আটকে থাকা কেরল শিবির থেকে সন্দীপের মন্তব্য, ‘‘দেশের সব ট্রফি জিতেছি। শুধু আইএসএলটা এখনও জিতিনি। রবিবার সেটাও জিততে চাই। এই টুর্নামেন্টে প্রথম বার চাইব দেবজিতের গোলে যত বেশি হোক বল ঢুকুক।’’

এমন উত্তপ্ত আবহে এটিকে কিপার কি ফাইনালের আগে কোনও টিপস নেবেন না তাঁর গুরুর কাছে? প্রশ্নটা শুনে দেবজিৎ বিরক্ত। ‘‘সেই প্রশ্নই উঠছে না এখন। সন্দীপদার কাছে টিপস নেওয়া তো দূরের কথা। আইএসএলে এ বার ভাল খেলছি। কোচ আমার উপর আস্থা রাখছেন। আমারও তো কেরিয়ারে এই ট্রফিটা নেই। সন্দীপদা আমার আদর্শ। যা সাহায্য করেছেন কোনও দিন ভুলব না। কিন্তু ট্রফি পেতে ওঁকে হারাতেই হবে,’’ বললেন দেবজিৎ।

ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় যে সতীর্থ কিপারকে প্রথম দিন থেকে ভুল শুধরানোর কাজ করে গিয়েছেন, সেই ছেলেই বিপক্ষ গোলে দাঁড়িয়ে থাকবেন তাঁর অধরা ট্রফি জেতার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করার জন্য, সেটা ভেবে যেন খানিকটা অস্বস্তিতে সন্দীপ। বলে দিলেন, ‘‘এটাকে ধর্মসঙ্কট বলব না। তবে একটা সঙ্কট তো বটেই। এ রকম তো খেলার মাঠে হয়-ই। ফাইনালের আগে তাই দেবজিৎকে ফোন করে কিছু বলব না। বরং চাইব দেবজিৎ অন্তত এই একটা দিন ব্যর্থ হোক।’’

চব্বিশ ঘণ্টাও তখন কাটেনি, নাটকীয় টাইব্রেকারে দিল্লির এমার্সনের পেনাল্টি আটকে কেরলকে ফাইনালে তুলেছেন সন্দীপ। এর পর কমপক্ষে একশো জন তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, এই বয়সেও এ রকম অসাধারণ ফর্মে থাকার রহস্য কী? একচল্লিশের সন্দীপ একটা উত্তরই দিয়েছেন, ‘‘লিয়েন্ডার পেজ যদি তেতাল্লিশে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারে, একচল্লিশে সেরা গোলকিপিংটা করতে পারব না কেন? যত দিন নিজের সেরাটা মাঠে দিতে পারব, তত দিন খেলব।’’

আইএসএলে গ্র্যান্ড স্ল্যাম নেই। তবে গোল্ডেন গ্লাভস আছে। সেই দৌড়ে এখনও সন্দীপ-ই সবার আগে। ‘‘চার ম্যাচ আগে আমার হাতে যে রিবন (গ্লোল্ডেন গ্লাভসের দৌড়ে সবার আগে থাকা কিপারকে যা দেওয়া হয়) বেঁধে দেওয়া হয়েছিল সেটা এখনও আমারই রয়েছে। সেমিফাইনালেও তো ওটা বেঁধে খেললাম,’’ বলার সময় মেহতাব-রফিকের দলের শেষ প্রহরীর গলায় উত্তেজনা। গ্লাভস দখলের চূড়ান্ত লড়াইতেও দেবজিতের সঙ্গেই নামতে হবে সন্দীপকে। যে ব্যাপারে অবশ্য মনে হল আইএসএল থ্রি-র প্রবীণতম ভারতীয় ফুটবলার নির্লিপ্ত। ‘‘আইএসএল ট্রফিটা পেলেই হল। তার পর গোল্ডেন গ্লাভস পেলাম কি না তা নিয়ে ভাবছি না।’’ আর দেবজিতের মন্তব্য, ‘‘ট্রফি না পেলে গোল্ডেন গ্লাভসের কথা কেউ মনে রাখবে না। গ্লাভসের কথা আমি মাথায় রাখছি না। চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা পেতে চাই।’’

দেবজিৎ এ দিন অনুশীলন করলেও সন্দীপের তা করা হয়নি। কোচিতে হোটেল সমস্যা কাটেনি বলে দিল্লিতেই আরও এক দিন রয়েছে তেন্ডুলকরের টিম। সন্দীপ বলছিলেন, ‘‘বিভিন্ন দলের জার্সিতে অনেক পেনাল্টি সেভ করেছি। সেই তুলনায় ট্রফি পেয়েছি কম। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে আসিয়ান কাপ ছাড়া সাফল্য পাইনি। তার পর আবার পেলাম আইএসএল সেমিফাইনালে।’’ কেরল কিপারের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, জামব্রোতার দিল্লিকে হারানোর আনন্দের রেশ চব্বিশ ঘণ্টা পরেও উপভোগ করছেন তিনি। আবার মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ফিরতি সেমিফাইনালে সুনীল ছেত্রীর নিশ্চিত গোল আটকানো এটিকে কিপার দেবজিৎ বলছেন, ‘‘অন্য ম্যাচে কী হয়েছে, ভাল খেলেছি কি না সে সব ভেবে লাভ নেই। ফাইনালে সেরাটা দিতে হবে।’’

জোসে মলিনা এবং স্টিভ কপেলের মগজাস্ত্রের যুদ্ধে রবিবার দুই বঙ্গসন্তান ‘লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স’ দুই বিদেশি কোচের। সন্দীপ-দেবজিৎ, দু’জনই মনে করছেন ফাইনাল হাড্ডাহাড্ডি হবে। গড়াতে পারে টাইব্রেকারেও। সে জন্য মানসিক ভাবে তৈরি থাকছেন দু’জনই। সন্দীপ যেমন বললেন, ‘‘কিপারদের সব সময় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয় পেনাল্টি বাঁচানোর জন্য।’’ আর দেবজিতের মন্তব্য, ‘‘বেঞ্চে থাকলেও সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়। টাইব্রেকারও যার মধ্যে পড়ে।’’

দেখার শুধু, গুরু-শিষ্যের ধর্মযুদ্ধে শেষ হাসি হাসেন কে? দীপ, না জিৎ!

সন্দীপদা আমার সব চেয়ে বড় শত্রু হয়ে থাকবে নব্বই মিনিট। দেবজিৎ মজুমদার

এই টুনার্মেন্টে প্রথম বার চাইব কলকাতার গোলে যত বেশি হোক বল ঢুকুক। সন্দীপ নন্দী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন