বিধ্বস্ত: বিষণ্ণ বুফনের এই ছবি থেকে যাবে ইতালি ফুটবল ভক্তদের মনে। ফাইল চিত্র
ব্রাজিলের আছে মারাকানাজো! ১৯৫০-এ উরুগুয়ের কাছে হেরে বিশ্বকাপের স্বপ্নভঙ্গ।
ইতালির ফুটবলে এই ভূমিকম্পকে কী বলা হবে? মিলানাজো?
ব্রাজিল ফুটবলের হৃদস্পন্দন যেমন মারাকানা, তেমনই ইতালীয় ফুটবলের অলিন্দ হচ্ছে মিলানের স্টেডিয়াম সান সিরো। ইন্টার মিলান, এ সি মিলানের ‘হোম’। ইউরোপের সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম। আশি হাজারের উপর দর্শক খেলা দেখতে পারে। সেখানেই যে ঘটে গেল ষাট বছর পরে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার বিপর্যয়।
ইতালীয় সংবাদমাধ্যমেও কারও শিরোনাম ‘ফুটবলের কাপোরেত্তো’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির মিলিত (বাইরে থেকে সমর্থন ছিল জার্মানিরও) আক্রমণের সামনে হার মেনেছিল ইতালীয় সেনা। এতকাল সেটাকেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হার মনে করা হতো। এখন তার পাশে স্থান করে নিল ফুটবল পরাজয়। কেউ কেউ শোকগাথাও লিখে ফেলেছে। একটি কাগজের শিরোনাম ‘দ্য এন্ড’। সঙ্গে আকাশে দু’হাত তুলে হতাশা প্রকাশ করা জানলুইজি বুফনের সেই ছবি। যা হয়তো থেকে যাবে ইতালি ফুটবলের সবচেয়ে করুণ ছবি হয়ে।
সোমবার রাতে একইসঙ্গে ইতালি দু’টো বিশ্বকাপ হারাল। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের ভিসা তো পেলই না, বিলীন হয়ে গেল শেষ বিশ্বকাপ জয়ের চিহ্নটুকুও। বুফনের ঘোষণার পরে অবসরের কথা জানিয়ে দিলেন দানিয়েলে দে রোসি এবং আন্দ্রেয়া বারজায়লি। ২০০৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের এই তিন সদস্য ইতালির দুনিয়া শাসনের শেষ চিহ্নটুকু বহন করছিলেন। বিপর্যয় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে কোচ জান পিয়েরো ভেনটুরা এবং ইতালি ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান কার্লো তেভাক্কিও-কে। দু’জনের উপরই চাপ বাড়ছে সরে যাওয়ার জন্য।
প্রাথমিক শোক সামলে বিপর্যয়ের কারণ খোঁজার দাবিও উঠেছে। ইতালিকে দ্রুত ময়নাতদন্তে বসতে হবে। আর সেটা করতে গেলেই তারা দেখতে পাবে যে, রোম যেমন একদিনে তৈরি হয়নি তেমন তার পতনও একদিনে হয়নি।
একটা সময় ছিল যখন ইতালির ফুটবল লিগ ‘সেরি আ’ (বঙ্গীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশে লেখা হতে থাকা ‘সিরি এ’ নয়) ছিল ফুটবল বিশ্বের সেরা লিগ। সেই রমরমা অনেক কাল ধরেই উধাও। ম্যাচ গড়াপেটার কালো দাগ লাগার পর থেকেই ইতালীয় লিগে খুব নামী ফুটবলাররা খেলার আগ্রহ দেখান না। তাঁদের পছন্দ স্পেনের লা লিগা, জার্মানির বুন্দেশলিগা বা ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ। ইতালির লিগের অনেক দলই ধুঁকছে। অনেক স্টেডিয়ামই পড়ে আছে এবং অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। বেশির ভাগ দলই চলছে বয়স্ক ফুটবলারদের দিয়ে। দেশ হিসেবেও ইতালি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যায় ভুগছে। তার প্রভাবও পড়তে বাধ্য ফুটবলের উপর।
যদিও এ বারেই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করছিল। অনেক দিন পর আবার ‘সেরি আ’-তে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুফান উঠেছে। য়ুভেন্তাসের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করার সাহস দেখাচ্ছে অন্য দলগুলি। লিগের শীর্ষে রয়েছে নাপোলি। যাদের বিশ্বের অন্যতম সেরা দল বলেছেন পেপ গুয়ার্দিওলা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বারে সার্বিক ভাবে উন্নতি ঘটেছে ইতালির ক্লাবগুলির। আর সেই বছরেই কি না দেশের ফুটবলে ঘনিয়ে এল অন্ধকার।
আজ্জুরির পতনের পিছনে তাই শুধুই ঘরোয়া লিগের মানকে দায়ী করা যাবে না। থাকছে পদ্ধতিগত ব্যর্থতা এবং অপেশাদারিত্বও। প্রথমত, ফিফা র্যাঙ্কিং পদ্ধতির ব্যাকরণটাই বুঝে উঠতে পারেননি বুফনের দেশের ফুটবলার বা কর্তারা। গত পাঁচ বছরে অর্থহীন প্রচুর ফ্রেন্ডলি খেলেছে ইতালি। আর সেই ম্যাচগুলোতে খুবই খারাপ ফল করেছে তারা। সেই কারণেই ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে পিছলে যেতে শুরু করে একটা সময় ইউরোপের মহাশক্তিধর দেশ। রাশিয়া বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের জন্য ইতালি পড়ে গিয়েছিল স্পেনের গ্রুপে। ফ্রেন্ডলিগুলোতে ভাল ফল করতে পারলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না বুফনদের। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্যি যে, ফ্রেন্ডলি কম খেললেও হয়তো ইতালি অনেক সহজে পৌঁছে যেতে পারত রাশিয়ায়।
দ্বিতীয়ত, আন্তোনিও কন্তের মতো প্রতিষ্ঠিত কোচকে ছেড়ে ভেনটুরাকে দায়িত্বে আনা। যাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল কোচিংয়ের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। যাঁর একমাত্র ‘যোগ্যতা’ হচ্ছে, কন্তের চেয়ে বেশি শান্ত এবং পূর্বসূরির চেয়ে কম টাকা পারিশ্রমিক নেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে এখন দলগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আগের মতো একচেটিয়া আধিপত্য আর দেখাতে পারছে না কেউ। অতীতের ‘সুপারপাওয়ার’ দেশ যদি উন্নতির রাস্তা ধরতে না পারে, অনেক ছোট দেশ দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারে।
কারও কারও মতে, তারকাপুজো এবং অতিরিক্ত আবেগও ইতালির পতনের কারণ। ২০০৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের তিন সদস্য যে এগারো বছর পরে সোমবার মিলানের মাঠেও ছিলেন, সেটা ইতালীয় ফুটবলের খুব ভাল বিজ্ঞাপন কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। তা সে যতই বুফনকে নিয়ে জাতীয় আবেগ তৈরি হোক।
এগারো বছরে ইতালি তাদের বিশ্বকাপজয়ী ত্রয়ীকে ‘বিদায়’ জানাতে পারেনি। তুলে আনার চেষ্টা করেনি নতুন প্রতিভা। এখন বিশ্বকাপের আসর থেকে দলেরই বিদায় ঘটে মূল্য চোকাতে হচ্ছে।
বিশ্বকাপে যারা
• ইউরোপ: রাশিয়া (আয়োজক দেশ ), বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আইসল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, সার্বিয়া, স্পেন, সুইৎজারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, সুইডেন এবং ডেনমার্ক।
• আফ্রিকা: মিশর, মরক্কো, নাইজিরিয়া, সেনেগাল এবং তিউনিশিয়া।
• উত্তর, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান: কোস্টা রিকা, মেক্সিকো, পানামা।
• দক্ষিণ আমেরিকা: আর্জেন্তিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং উরুগুয়ে।
• এশিয়া: ইরান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব এবং অস্ট্রেলিয়া।
• শেষ স্থানটি ঠিক হবে পেরু এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় পর্বের খেলার পরে। প্রথম পর্ব গোলশূন্য ছিল।