গ্যালারিতে আইজল সমর্থকদের পাশে সঞ্জয়।-নিজস্ব চিত্র
আইজল ২ : মোহনবাগান ১ (সানডে, কিমা পেনাল্টি ) (গ্লেন)
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তখন শুধুই রং আর রং। আইজলে যেন ফের দোল শুরু হয়েছে। ওঁরা নাচছেন, গাইছেন। ডমরুর মতো দেখতে কী একটা বাজছে। রাজীব গাঁধী স্টেডিয়ামের কোণে কোণে ধাক্কা লেগে ফিরছিল সেই মায়াবী সুর।
ওঁরা মানে, ম্যাচের টিকিট না পাওয়া আইজল টিমের সমর্থকরা। মাঠে ঢুকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত যাঁরা পাহাড়ে চড়ে বসেছিলেন খেলা দেখতে। সমর্থকদের মতোই মাঠের মধ্যে তখন সানডে-কিমারা উদ্দাম নাচছেন। গ্যালারিতে বসে থাকা সঞ্জয় সেনের মাথা নিচু। হতাশ মুখে নেমে গেলেন। গ্লেন-কাতসুমিরাও হাঁটা লাগালেন অন্ধকার ড্রেসিংরুমের দিকে।
‘বিভীষণ’ হয়ে এক সবুজ-মেরুন সদস্য জহর দাস-ই শেষ পর্যন্ত টেনে খুলে দিলেন আই লিগে মোহনবাগানের অপরাজিত থাকার মুকুট। টানা এগারো ম্যাচ পর হারল সঞ্জয় ব্রিগেড। কাচ ঢাকা বক্সে ভাল করে খেলা দেখতে পাচ্ছেন না বলে একটা সময় গ্যালারিতে এসে বসেছিলেন বাগানের ‘মেঘনাদ’ কোচ সঞ্জয়। বেঞ্চে বসা সহকারী শঙ্করলাল চক্রবর্তীকে পাঠানো কোনও তূণই কাজে লাগেনি। বাগান নামক অশ্বমেধের ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়ল পাহাড়ে। বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবেই। আই লিগ ‘রামায়ণ’-এ মেঘনাদ বধ ঘটল কিন্তু ‘বিভীষণ’-এর হাতে!
যদিও ফেডারেশনের নির্দেশে নির্বাসিত বাগান কোচ ভাঙলেও মচকাচ্ছেন না। ‘‘এক দিক থেকে এই হার শাপে বর হল। পরের শনিবার ডার্বিতে আমার ফুটবলাররা আরও বেশি সতর্ক থাকবে। গত বারও তো রাংদাজিদের কাছে এ ভাবেই হঠাৎ হেরেছিলাম। তার পর কিন্তু শেষমেশ আমরাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম,’’ খেলার শেষে নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু গ্লেন-কাতসুমি-ধনচন্দ্ররা যে ফুটবল খেললেন আজ তাতে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, এটা শেষ পর্যন্ত ট্রফি জয়ের পথে বড় ধস হয়ে দাঁড়াবে না তো? হেরে-হেরে বিধ্বস্ত ইস্টবেঙ্গল আইজলে জিতেই ডার্বির অক্সিজেন নিয়ে ফিরেছিল দিনকয়েক আগে। বাগান সেখান থেকেই ফিরছে একরাশ হতাশা আর ফিকে হয়ে পড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে। পরিস্থিতি যা তাতে শিলিগুড়ি ডার্বিতে কোনও কারণে পদস্খলন হলেই সব স্বপ্ন হয়তো শেষ হয়ে যাবে সঞ্জয়ের।
স্টেডিয়ামে আসার সময় দেখছিলাম, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ম্যাচের টিকিট বিক্রি হচ্ছে অনেকটা লটারির টিকিট বিক্রির কায়দায়। যা ভারতীয় ফুটবলে অভিনব। যাঁরা টিকিট পেয়েছিলেন ম্যাচের পর আইজলের ড্রেসিংরুমে তাঁদের উপচে পড়া ভিড়। বঙ্গসন্তান কোচ জহর দাসকে ঘিরে রীতিমতো উৎসব চলছে তখন সেখানে। মোহনবাগানের সঙ্গে ফুটবলার থেকে ক্লাব সদস্য— চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জড়িয়ে থাকা জহর অবশ্য ম্যাচ জিতে উঠে পুরনো ক্লাবের প্রতি আবার আবেগে ডুবলেন। ‘‘এক দিন হেরেছে বলে মোহনবাগান খারাপ, বলা ঠিক নয়। যা টিম, এর সঙ্গে সনি-জেজেরা আবার ফিরে এলে দেখবেন ডার্বি ওরাই জিতবে। চ্যাম্পিয়নও হবে।’’
তবে এ দিন লুসিয়ানো-লেনিদের বিশ্রী পারফরম্যান্স দেখার পর আইজল কোচের কথাগুলো তাঁর পুরো ক্লাবকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোই শোনাচ্ছিল। ম্যাচের শুরু থেকেই পাহাড়ি ছেলেদের গতির কাছে বারবার আটকে যাচ্ছিলেন শৌভিকরা। আর জেতার মরিয়া ইচ্ছে থাকলে সবচেয়ে কঠিন এবং বড় বাধাও যে অনায়াসে টপকে যাওয়া যায় তা দেখিয়ে দিল মিজোরামের একঝাঁক ভূমিপুত্র। কার্যত এ দিন গ্লেনদের খেলতেই দেননি জহরের পাহাড়ি ছেলেরা। ম্যাচের তিন মিনিটে সানডের গোল দিয়ে যে শাসনের শুরু। যদিও আইজল গোলকিপারের ভুলে গ্লেন হাফটাইমের আগেই ১-১ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে গ্লেন-সুভাষদের মাঠে প্রায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাঝমাঠ ফ্লপ। উইং প্লে নেই। রক্ষণ কাঁপছে। বাগান কোচ স্বীকার করলেন, ‘‘দেবজিৎ গোলে না থাকলে গোলের মালা পরে ফিরতে হত। আমরা খেলতেই পারিনি।’’ আর একটা ধ্রুবসত্য যেটা বললেন না যে, একজন কোচ ততটাই ভাল যতটা ভাল তার টিম। সনি-জেজে না থাকলে বাগানের কী হাল হয় সেটা আজ নিশ্চয়ই বুঝলেন কোচ।
দেবজিতের জন্য নিশ্চিত তিনটে গোল পায়নি আইজল। প্রবল চাপে এর মধ্যেই আবার হাতে বল লাগিয়ে বাগানকে ডোবান ধনচন্দ্র। পেনাল্টি থেকে আইজলের জয়ের গোল তুলে নিতে কোনও ভুল করেননি কিমা। মোহনবাগানের হারে তাদের ঘাড়ে উঠে পড়ার মোক্ষম সুযোগ এসে গেল বেঙ্গালুরু এফসি আর ইস্টবেঙ্গলের সামনে। আই লিগ খেতাব অটুট রাখতে বাগানের পরের চার ম্যাচের তিনটে জিততেই হবে।
সনি-জেজেরা ফিরে এসে মোড় ঘোরালে আলাদা কথা। না হলে কিন্তু ঘোর বিপদে সঞ্জয়ের বাগান।
মোহনবাগান: দেবজিৎ, ধনচন্দ্র, কিংশুক, লুসিয়ানো, প্রবীর, কাতসুমি, লেনি, শৌভিক (অভিষেক), মণীশ (কেন), সুভাষ (পঙ্কজ), গ্লেন।