স্বাগত: শুক্রবার বিকেলে কলকাতায় ফিরলেন বাংলার দুই সফল তারকা। বিমানবন্দরে ঝুলন গোস্বামী এবং সায়নী দাস। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
দমদম বিমানবন্দর তখন সরগরম। কখনও ‘ঝুলন গোস্বামী, জিন্দাবাদ।’ কখনও আবার ‘থ্রি চিয়ার্স ফর সায়নী দাস, হিপ হিপ হুররে’।
খেলার দুনিয়ায় বাংলার নাম উজ্জ্বল করে দুই মেয়ের একসঙ্গে ঘরে ফেরা। কখনও এমন হয়েছে? বোধহয় না। শুক্রবার এ শহর এই প্রথম সাক্ষী হল এই ঘটনার।
আরতি সাহা থেকে জ্যোতির্ময়ী শিকদার— দেশের বাইরে সফল হয়ে শোরগোল তুলে ঘরে ফিরেছেন বাঙালি মেয়েরা। কিন্তু ঝুলন গোস্বামী, সায়নী দাসের মতো একই সঙ্গে নয়। বঙ্গকন্যাদেরই সময় এখন। চাকদহ থেকে কালনা। শহরতলি থেকে গ্রাম— বাঙালি মেয়েদেরই জয়জয়কার।
একজন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট মাঠ মাতিয়ে ফিরলেন। অন্যজন ইংলিশ চ্যানেল তোলপাড় করে। সারা দেশ, বাংলা সেলাম করছে দুই বীরাঙ্গনার কীর্তিকে। ঘর-সংসার, রান্নাঘরের গণ্ডি পেরিয়ে যে বাংলার মেয়েরাও পারে বিশ্বের দরবার থেকে সম্মান জিতে আনতে, তা ফের প্রমাণ করে দিলেন এই দুই মেয়ে। চাকদহের ঝুলন আর কালনার সায়নী।
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে শুক্রবার একই বিমানে দিল্লি হয়ে কলকাতায় এলেন এই দু’জন। চটপট সমস্ত নিয়ম-কানুন সেরে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েও এলেন। কালনার কল্যাণপুর গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষকের মেয়ের তো এই প্রথম বিদেশ যাত্রা। তাই সায়নী আটকা পড়ে গেলেন নিয়মের বেড়াজালে। ফলে বেরোতে একটু দেরিও হল তাঁর। চিত্রসাংবাদিকদের দু’জনকে একসঙ্গে ফ্রেমবন্দি করার ইচ্ছেরও দফারফা।
আরও পড়ুন:কলকাতা পর্ব জমিয়ে দেবো: অক্ষয় কুমার
বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও ঝুলন ও তাঁর সতীর্থরা জিতেছেন সারা দেশের হৃদয়। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তাঁদের বলেন, ‘ফাইনালে হারলেও দেশবাসী যে তোমাদের অনেক কাছের করে নিয়েছে, এটাই তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’ শুক্রবার বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে ঝুলন নিজেই জানালেন প্রধানমন্ত্রীর এই ‘মন কি বাত’। দেশে ফেরার পর সংবর্ধনা, সম্মানের শেষ নেই। যেখানেই যাচ্ছেন, অভিনন্দনের বন্যায় ডুবে যাচ্ছেন। এত কিছুর পরেও ফাইনালে হারের আক্ষেপ যাচ্ছে না। বললেন, ‘‘ওই ন’টা রানের মূল্য সারা জীবন বুঝতে হবে। এই আফসোস কখনও ভুলতে পারব না। ফাইনালের ৮৫ ভাগে আমাদেরই প্রাধান্য ছিল। অথচ শেষ ১৫ ভাগ ওরা দাপট দেখিয়ে ম্যাচটা বার করে নিয়ে চলে গেল! ইশ্, কী যে খারাপ লাগছে। এ আক্ষেপ থেকেই যাবে।’’ যখন দলের ১৫ বলে ১১ রান দরকার ছিল, তখন ড্রেসিং রুম থেকে বারবার বার্তা পাঠানো হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকো, জানালেন ঝুলন। বললেন, ‘‘কিন্তু বার্তা পাঠানো এক জিনিস আর মাঠে তা করে দেখানো অন্য জিনিস। এমন পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছি আমরা। কিন্তু সে দিন চাপে পড়ে ভুল করলাম আমরা।’’
সায়নীর মুখেও তাঁর ইংলিশ অবিযানের শেষ দিকে ধুন্ধুমার যুদ্ধ-জয়ের গর্ব। বিমানবন্দরে এ দিন বললেন, ‘‘এগারো ঘণ্টা সাঁতার কাটার পরে উল্টোদিক থেকে ভয়ঙ্কর স্রোত বইতে শুরু করে। সেই মারাত্মক স্রোত আমাকে উল্টোদিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সেই স্রোতের বিরুদ্ধে এগোতে শুরু করি।’’ কথাগুলো বলতে বলতে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন সায়নী।
বলে চলেন, ‘‘চার দিকে অন্ধকার। প্রচণ্ড ঠান্ডা জল। মাঝে মাঝে জেলিফিশ গায়ে লেগে মাথা ঝিমঝিম করে উঠছিল। শরীর ক্রমশ অবসন্ন হয়ে পড়ছিল। শুধুমাত্র মনের জোরে সাঁতারাচ্ছিলাম তখন। শেষে ডাঙায় উঠেই অজ্ঞান হয়ে যাই। প্রায় মিনিট পনেরো জ্ঞান ছিল না। ঠান্ডা আর পরিশ্রমে তখন সব শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল।’’
বাড়ির কাছেই গঙ্গা। বেশির ভাগ সময় সেই গঙ্গায় সাঁতার কেটেই প্রস্তুতি নেওয়া সায়নী বললেন, ‘‘গঙ্গাই আমাকে তৈরি করে দিয়েছে বলতে পারেন। ঠান্ডায়, রাতে প্র্যাকটিস করতাম গঙ্গায় নেমে। তারই ফল পেলাম।’’ দুই মেয়েই অভিভূত অভাবনীয় অভ্যর্থনায়। সীমাহীন ভালবাসা ও সম্মান পেয়ে ঝুলন বললেন, ‘‘পরের বিশ্বকাপেও খেলার ইচ্ছে হচ্ছে। চেষ্টা করে যাব। কিন্তু চার বছর সময়টা যে অনেক। এখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছি।’’ সায়নী আবার বলছেন, ‘‘এ বার জিব্রাল্টার পার হওয়ার ইচ্ছা আছে। দেখি কী হয়।’’
লড়াই যেন ফের হাতছানি দিচ্ছে দুই বীরাঙ্গনাকে। সাফল্য ফের নতুন করে ডাকছে তাঁদের।