ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ জয়ের একটা চার ফুটের ছবি টাঙানো দেওয়ালে। কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকলে সেটা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। সোনালি ফ্রেমে মোড়া সৌরভ-সচিন-যুবরাজদের ট্রফি হাতে সেই ঐতিহাসিক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার আফসোস করছিলেন কেরলের পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই এক ফুটবল ভক্ত। ‘‘ইস! আগের কোচের বদ মেজাজের জন্য হিউমকে যদি আমরা না হারাতাম, তা হলে সৌরভ-সচিনদের পাশে কেরল ব্লাস্টার্সের ছবিও টাঙানো থাকত। আইএসএল ট্রফি হাতে।’’
না, আফসোসের বৃত্ত এখানেই থেমে নেই। এ দিন সকাল থেকে স্টেডিয়াম লাগোয়া চত্ত্বরে চক্কর দিয়ে দেখা গেল, হিউমকে হারানোর যন্ত্রণা সর্বত্রই। সেটা এলাকার সবচেয়ে পুরনো পানের দোকান হোক কিংবা হাজির বিরিয়ানি হাউস। তবে একা হিউম নন। এ বছর তাঁর সঙ্গে দোসর পস্টিগাও। সচিন তেন্ডুলকরের টিমের কোচ স্টিভ কপেল তো বলেই দিলেন, ‘‘এ বারের সেরা অ্যাটাকিং জুটি পস্টিগা-হিউম। ওদের আটকানোই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’’
মাত্র এক ম্যাচ যেতে না যেতেই কি এত বড় শিরোপা তুলে দেওয়া উচিত? উত্তরটা ভবিষ্যতের ডায়েরিতে লুকিয়ে থাকলেও, আপাতত গোটা কেরল জুড়ে আতঙ্কের নাম যে হিউম-পস্টিগা জুটি, সেটা বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হল না। কপেল বলছিলেন, ‘‘এটিকে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা দল। ওদের টপকাতে হলে আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনকে আরও ভাল খেলতে হবে।’’
কিন্তু এখানেই তো গলদ। নর্থ-ইস্টের বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচে মাঝমাঠ থেকে বল এলেও, ফরোয়ার্ডদের নড়াচড়ার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় কেরলকে। তাই রফি-আন্তোনিও জার্মানদের থেকে যে খুব একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে, সেটা একেবারেই নয়। এ বার তার উপর যদি টিমের কাঁপুনির খবরও বিপক্ষ শিবিরে চলে আসে, তা হলে কেমন হয়?
এক কথায় বললে, খুব জোরদার হয়। এটিকে শিবিরও তাই দারুণ তেতে। কোচি থেকে শুধু তিন পয়েন্টই নয়, আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে নিতে মরিয়া ফুটবলাররা। কেরলের বিরুদ্ধে এটিকে-র রেকর্ড আগাগোড়াই ভাল। তবে অতীতের পাতা না উল্টে সামনের দিকেই তাকাতে চাইছে দল। কোচ মলিনা বলছিলেন, ‘‘আগের স্কোর দিয়ে তো এ বার জেতা যাবে না। মাঠে খেলেই জিততে হবে আমাদের। আমার ফুটবলাররাও সেটা জানে।’’
খাতায়-কলমে দেখলে দুটো টিমের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। কেরলকে যেখানে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দুর্বল দল বলা হচ্ছে, সেখানে এটিকে চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম দাবিদার। ইতিমধ্যে এই তিন বছরে তিনটে নতুন কোচ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে গিয়েছে কেরলের। আর পিটার টেলর ছাড়ার পরে এখনও পর্যন্ত ঠিক ভাবে টিমটাকে সাজিয়েই উঠতে পারেননি কপেল। মার্কি অ্যারন হিউজ আছেন। তবে পস্টিগা-হিউম জুটিকে তিনি কতটা সামলাতে পারবেন, তা নিয়ে খোদ টিমের অন্দরে প্রবল গুঞ্জন।
সেই তুলনায় আন্তোনিও হাবাসের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে প্রথম পরীক্ষায় পাশ মলিনা। কপালের ভাঁজেও সেটা স্পষ্ট। যেটা সাত-আটটা ভাঁজ থেকে এখন নেমে এসেছে তিন-চারে! এমনকী বুধবার ম্যাচের পরে সেটা একেবারে মুছে গেলেও খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে পাল্লা ভারী হলেও, দু’টো বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে এটিকে-কে। কেরলের মাঠ ও গ্যালারির চিৎকার।
এ বছর ক্রিকেট মাঠ থেকে পুরোপুরি ফুটবল মাঠে বদলে ফেলা হয়েছে কোচির মাঠকে। যুবভারতীর মতো বার্মুডা ঘাস লাগিয়ে। তাই ম্যাচের আগের দিন কোনও টিমই স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করার অনুমতি পায়নি। মলিনা নিজেও বলছিলেন, ‘‘স্টেডিয়ামের মাঠে এক বার প্র্যাকটিস করতে পারলে ভাল হত। স্টেডিয়ামের মাঠ পাইনি বলে অন্য একটা মাঠের ব্যবস্থা করেছি আমরা। মাঠের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।’’ স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস না করলেও, দুপুরের দিকে এক বার মাঠ পরিদর্শন করে যান এটিকে কোচ। তাতে অবশ্য ম্যাচের দিন কতটা লাভ হবে, সেটা জানা নেই।
কেরলের আরও একটা শক্ত ঘাঁটি হল গ্যালারি। সচিন তেন্ডুলকর, নাগার্জুন ও চিরঞ্জীবীর সঙ্গে প্রায় ষাট হাজার দর্শক যখন এক সঙ্গে হলুদ-ব্রিগেডের জন্য গলা ফাটাবে, তখন একটু চাপে তো থাকবেই বিপক্ষ শিবির। এটিকে-র এক অভিজ্ঞ ফুটবলার বলছিলেন, ‘‘কেরলে খেলা সবচেয়ে কঠিন। যেভাবে সমর্থকরা ওদের হয়ে চিৎকার করে, তাতে মাঝে-মধ্যে আমরাও ঘাবড়ে যাই।’’
মলিনা অবশ্য এ সব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। বরং তাঁর চিন্তা অন্য। স্পেনের শিবিরে সব ফুটবলারকে এক সঙ্গে পাননি। তাই তাঁর মতে বোঝাপড়া তৈরি হতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। টিম হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে এটিকে কোচ বলছিলেন, ‘‘সবাইকে নিয়ে মাত্র বারো দিন প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়েছি। সঠিক কম্বিনেশন এখনও খুঁজে পাইনি।’’ তবে সঠিক কম্বিনেশন নিয়ে কাটাছেঁড়া চললেও দেবজিৎ মজুমদারই যে গোলকিপার হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ, সেটা পরিষ্কার করে দিলেন।
সব মিলিয়ে মঞ্চ তৈরি। মঞ্চ তৈরি কেরলের আতঙ্ক বনাম এটিকে-র আত্মবিশ্বাসের যুদ্ধের জন্য। এখন শুধু দেখার, কেরল কোনও বড় অঘটন ঘটাতে পারে কি না!