এখন লিয়েন্ডারকে দেশের সেরা প্লেয়ার বলতেই হবে

একই দিনে এত রকমারি চমক গ্র্যান্ড স্ল্যামের মতো টুর্নামেন্টেও খুব কম দেখা যায়! শুক্রবার রাতভোর জেগে টিভিতে ইউএস ওপেনে যা দেখলাম। হটফেভারিট বললেও কম বলা হয়, হটেস্ট ফেভারিট সেরেনার ক্যালেন্ডার স্ল্যামের স্বপ্ন কোনও এক রবার্তা ভিঞ্চির হাতে চুরমার হওয়ার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আবার বিয়াল্লিশ পেরনো লিয়েন্ডার পঁয়ত্রিশের পার্টনার হিঙ্গিসকে নিয়ে এ বছর মিক্স়়ড ডাবলস গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার হ্যাটট্রিক করে দেখাল!

Advertisement

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৭
Share:

জয়ী জুটি। ইউএস ওপেনের মিক্সড ডাবলস ফাইনালে লিয়েন্ডার পেজ এবং মার্টিনা হিঙ্গিস। ছবি: পিটিআই।

একই দিনে এত রকমারি চমক গ্র্যান্ড স্ল্যামের মতো টুর্নামেন্টেও খুব কম দেখা যায়! শুক্রবার রাতভোর জেগে টিভিতে ইউএস ওপেনে যা দেখলাম।
হটফেভারিট বললেও কম বলা হয়, হটেস্ট ফেভারিট সেরেনার ক্যালেন্ডার স্ল্যামের স্বপ্ন কোনও এক রবার্তা ভিঞ্চির হাতে চুরমার হওয়ার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আবার বিয়াল্লিশ পেরনো লিয়েন্ডার পঁয়ত্রিশের পার্টনার হিঙ্গিসকে নিয়ে এ বছর মিক্স়়ড ডাবলস গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার হ্যাটট্রিক করে দেখাল! সব শেষে ফেডেরারকে এই ভয়ঙ্কর পাওয়ার টেনিসের যুগেও চৌত্রিশ বছর বয়সে রোলস রয়েসের মতো মসৃণ দেখাল কোর্টে। তা-ও কিনা গ্র্যান্ড স্ল্যাম সেমিফাইনালে!
তিনটেই অবিশ্বাস্য!
লিয়েন্ডারকে আমি বলব আমাদের দেশের সর্বকালের সেরা এক জন স্পোর্টসম্যান। মিলখা সিংহ আর রামনাথন কৃষ্ণন তুলনায় আসবে। ক্রিকেট ঠিক ওয়ার্ল্ড স্পোর্ট নয় বলে সচিনকে আলোচনার বাইরে রাখব।
লিয়েন্ডারের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এই বয়সেও ওর জেতার মারাত্মক খিদেটা! বিয়াল্লিশে বেশির ভাগ প্লেয়ার হয় রিটায়ার জীবন কাটায়। কিংবা তখনও খেলে চললেও মনে মনে ভাবে, অনেক জিতেছি এখন খেলাটাকে এনজয় করি আর তাতে যদি গোটা কয়েক হারতেও হয় তো কী! কিন্তু লিয়েন্ডারের কাছে পেশাদার সার্কিটে পঁচিশ বছর কাটানোর পরেও এখনও প্রতিটা ম্যাচই যেন ফাইনাল! মরণপণ লড়াই। হারার কথা ভাবতেই পারে না। বছরের পর বছর এত চাপ কী ভাবে সামলায় সেটাই অবাকের!
ওর টেনিসের ‘ওয়ার্ক এথিকস’ নিয়ে অনেক জায়গায় অনেক কথা শুনি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম। বছর পনেরো-কুড়ি আগে ডেভিস কাপে আমি যখন নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন ছিলাম, দেখেছি লিয়েন্ডারের ট্রেনিং শি়ডিউল আর পাঁচ জন নামী টেনিস প্লেয়ারের মতোই। বিশেষ অসাধারণত্ব নেই তাতে।
তবে জীবনে কোনও দিন সিগারেট, মদ ছোঁয়নি। জন্মগত অ্যাথলিট। এতটাই ‘ন্যাচারাল অ্যাথলিট’ যে, ফুটবল বা ক্রিকেট খেললেও লিয়েন্ডার ইন্ডিয়া খেলত। খাওয়াদাওয়া খুব নিয়ম মেনে। যেখানে যতই পার্টি-ফার্টি থাক না কেন, রাত দশটায় শুয়ে পড়বেই। বছরভর জিমে যাওয়া তো আছেই। গত কয়েক বছর রোজ যোগাভ্যাসও করে। যে জন্য বিয়াল্লিশেও বাইশের তরুণের মতো ফিট, শক্তিশালী মাসল, রিফ্লেক্স।
লিয়েন্ডারের অসাধারণ রিফ্লেক্স আর হিঙ্গিসের অনবদ্য রিটার্ন ওদের জুটিকে এত ভয়ঙ্কর দেখানোর পিছনে আসল কারণ। ডাবলস-মিক্সড ডাবলসে প্লেয়ারের বিগ সার্ভিস না থাকলেও ম্যানেজ করা সম্ভব। বেশি দরকার ভলি, নেটের সামনে রিফ্লেক্স আর রিটার্ন। যার জন্য গড়পরতা সার্ভিস করেও লিয়েন্ডারদের জুটি ভালই কাজ চালিয়ে নিতে পারছে।

Advertisement

সেরেনার কথায় আসি। সেরেনার গত এক বছর অসাধারণ গ্র্যান্ড স্ল্যাম পারফরম্যান্স সত্ত্বেও কিন্তু বলব, ওর টপ ফর্মেও আচমকা একটা-দু’টো ম্যাচে হোঁচট খাওয়ার বদভ্যাস আছে। এ বছরই তো উইম্বলডনে কোন এক হেদার ওয়াটসনের কাছে হারতে হারতে কোনওক্রমে জিতেছিল। ফ্লাশিং মেডোয় সে রকমই অখ্যাত ভিঞ্চির বিরুদ্ধে সেটা আর দ্বিতীয় বার সম্ভব হয়নি সেরেনার।

ওয়াটসনটা ছিল তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচ। অপেক্ষাকৃত কম চাপ। সেরেনা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু শুক্রবার সেই একই পরিস্থিতিটা ছিল গ্র্যান্ড স্ল্যাম সেমিফাইনালে! মাত্র দু’টো ম্যাচ দূরেই সেরেনার জন্য ক্যালেন্ডার স্ল্যাম অপেক্ষা করছে। চার দিকে সর্বদা ‘জিততে হবে, জিততে হবে’-র প্রবল ঝড়। স্টেফি বলেছে, সাতাশ বছর আগে ও ক্যালেন্ডার স্ল্যাম করার আগে প্রচণ্ড চাপে ছিল। সেরেনাও থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ও-ও গ্রেট স্পোর্টসম্যান। কিন্তু মাঝেমধ্যে সত্যিকারের চাপের ম্যাচে একটু হলেও ‘চোক’ করে! শুক্রবারের ম্যাচটাই অন্য জায়গায় আবার হলে দশ বারে দশ বারই ভিঞ্চিকে হারাবে সেরেনা। কিন্তু নিউইয়র্কে ক্যালেন্ডার স্ল্যামের চাপের সামনে ভেঙে পড়ল!

Advertisement

তার আগে এ বছরই নাকি গ্র্যান্ড স্ল্যামে এক ডজন ম্যাচ থার্ড সেটে দাপটে বার করেছিল সেরেনা। কিন্তু সেটা আমার কাছে গুরুত্বের নয়। আপনি কোন পরিস্থিতিতে সেটটা খেলছেন সেটাই আসল। আমার টেনিসজীবনে সাধারণত পাঁচ সেটের ম্যাচ আমি হারতাম না। ফিফথ্ সেট মোটামুটি জিততামই। কিন্তু ছেষট্টিতে এক বছরে উইম্বলডন প্রি-কোয়ার্টার আর ডেভিস কাপ জোনাল ফাইনাল, চ্যালেঞ্জ রাউন্ড মিলিয়ে তিনটে ম্যাচ ফিফথ্ সেটে হেরেছিলাম। হারতে-হারতে জেতা কিংবা জিততে জিততে হারা জীবনে পাশাপাশিই চলে। তা ছাড়া সমালোচনার সামনে পড়ার ঝুঁকি নিয়েও বলব, সেরেনা যতই কিংবদন্তি হোক না কেন, ক্রিস এভার্ট, মার্গারেট কোর্ট, স্টেফি গ্রাফ, নাভ্রাতিলোভার মতো ধারাবাহিক নয়!

ফেডেরারও ওদেরই সমান, হয়তো বা তারও বেশি ধারাবাহিক! এ বার ফ্লাশিং মেডোয় ওকে মাস কয়েক আগের উইম্বলডনের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ইউএসওপেনে আসার ঠিক আগে সিনসিনাটিতে জকোভিচকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইস্তক এখনও পর্যন্ত একটাও সেট হারেনি। রবিবারের মেগা ফাইনালের আগে জকোভিচ-শিবিরও যেটা টের পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কারণেই জকোভিচের কোচ বরিস বেকার ‘মাইন্ডগেম’-এ ফেডেরারকে চাপে রাখতে চাইছে। আমার মতে, বেকারের ‘‘আমাদের খেলার সময় রজার এ ভাবে নেটের সামনে এগিয়ে এলে ওর গায়ে বল মারতাম’’ কথাটা ‘মাইন্ডগেম’ ছাড়া কিছু নয়।

নইলে বেকারের গ্রাউন্ড স্ট্রোক কোনও দিনই কোনর্স বা লেন্ডলের মতো অসাধারণ ছিল না। গ্রাউন্ড স্ট্রোক খুব ভাল না হলে নেটের সামনে দাঁড়ানো প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে মারা কঠিন। তা ছাড়া বিপক্ষের দ্বিতীয় সার্ভে এখন বেশি স্লাইস রির্টান মারছে রজার। মেরেই নেটে উঠছে পরের উইনারের জন্য। স্লাইসের মতো নীচু বল বিপক্ষের গায়ে রিটার্ন তো আরওই কঠিন। প্রায় অসম্ভব।

তাই মনে হচ্ছে, আজ ফেডেরারের চ্যালেঞ্জ সামলানো নিয়ে বেকার-জকোভিচ, গুরু-শিষ্য আসলে চাপে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন