‘আমেদ খানের সেই ড্রিবল কিন্তু অমরই থাকবে’

সন্তোষ ট্রফি ছাড়া আমেদ খানের দলে বা তাঁর বিরুদ্ধে কখনও খেলিনি। তবে ছোট থেকে তাঁর প্রচুর খেলা দেখেছি। খেলা দেখে মনে হতো, তিনি ফুটবলের সঙ্গে কথা বলেন। এমনই তাঁর বল কন্ট্রোল, ঠিকানা লেখা পাস বাড়ানোর দক্ষতা, ড্রিবলিং, সঙ্গে দু’পায়ে জোরালো শট।

Advertisement

চুনী গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৭ ০৪:০৭
Share:

কিংবদন্তি: ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে তরুণ আমেদ খান। ফাইল চিত্র

ফুটবলের জাদুকর সামাদ সাহেবকে আমি দেখিনি। দেখেছি আমেদ খানকে। পাঁচের দশকে ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত ‘পঞ্চপাণ্ডব’-এর শ্রেষ্ঠ পাণ্ডব বেঙ্গালুরুর এই ফুটবলার। আর আমার কাছে আমেদ খান-ই ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর। রবিবার বিকেলে তাঁর প্রয়াণের খবর শুনে মনটা তাই ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

সন্তোষ ট্রফি ছাড়া আমেদ খানের দলে বা তাঁর বিরুদ্ধে কখনও খেলিনি। তবে ছোট থেকে তাঁর প্রচুর খেলা দেখেছি। খেলা দেখে মনে হতো, তিনি ফুটবলের সঙ্গে কথা বলেন। এমনই তাঁর বল কন্ট্রোল, ঠিকানা লেখা পাস বাড়ানোর দক্ষতা, ড্রিবলিং, সঙ্গে দু’পায়ে জোরালো শট।

এর সঙ্গে ছিল তুখোড় ফুটবল বুদ্ধি। মনে পড়ছে ১৯৪৯ সালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আইএফএ শিল্ড ফাইনাল। ম্যাচের শুরুতেই আমেদ খান মোহনবাগানের অনিল দে-কে এমন কড়া ট্যাকল করলেন যে অনিল দে পাল্টা মারার জন্য নিশানা করলেন আমেদ খানকে। সেই সুযোগে ইস্টবেঙ্গলের বাকি খেলোয়াড়রা ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাচ্ছিলেন।

Advertisement

মোহনবাগানে সিনিয়র দলের দরজায় যখন কড়া নাড়ছি তখন আমেদ খান আমার কাছে ছিলেন একজন শিক্ষক। যাঁকে দেখে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। আজকের ইস্টবেঙ্গল মাঠে তখন একসঙ্গে তাঁবু ছিল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের। ফলে সকালে অনুশীলনে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম আমেদ খানকে।

আরও পড়ুন: কামো-ক্রোমার যুগলবন্দিতে কাস্টমস বধ বাগানের

ইস্টবেঙ্গল সে সময় খেলত ২-৩-৫ ছকে। আক্রমণে সেই পঞ্চপাণ্ডবের ব্যান্ডমাস্টার ছিলেন আমেদ খান। লেফট ইন-এ খেললেও আক্রমণ এবং মাঝমাঠের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটা করতেন তিনিই। গোল করার চেয়ে গোল করাতে ভালবাসতেন বেশি। আমেদ খানকে পাশে পেয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ধনরাজ। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ওঁর আশি শতাংশ গোলেই রয়েছে আমেদ খানের দুর্দান্ত সব পাস।

আমার ফুটবল-মেন্টর বলাইদাস চট্টোপাধ্যায় বলতেন, ‘‘আমেদ খানের বল কন্ট্রোল দেখো।’’ ফুটবলের এই কিংবদন্তির সঙ্গে আমার আলাপ ১৯৫৫ সালে। যে বার আমেদ খানের অধিনায়কত্বে বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে গেলাম এর্নাকুলামে।

আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘‘ভাল ফরোয়ার্ড এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। বিপক্ষ আক্রমণ করলে নীচে নেমে রক্ষণকে সহায়তা করে।’’ সে বার আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ফেরার সময় ট্রেনে একটা কথা বলেছিলেন। যা আজও মনে আছে। ‘‘ষোলো আনা পরিশ্রম করলে তবে চার আনার ফল পাবে। অনুশীলনটা মন দিয়ে করো।’’

দেশের হয়ে লন্ডন ও হেলসিঙ্কি—দু’টো অলিম্পিক্সে খেলেছেন। ১৯৫৩ সালে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে রোমানিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছিলেন। সব মিলিয়ে কলকাতা ফুটবলের স্বর্ণযুগে একজন ‘ম্যাটিনি আইডল’ ছিলেন আমেদ খান। ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডব—সালে, আমেদ, ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ, আপ্পা রাও-এর মধ্যে আমেদের জনপ্রিয়তাই ছিল সব চেয়ে বেশি।

খালি পায়ের পাতা দিয়ে টেনে টেনে আমেদের অদ্ভুত ড্রিবল দেখতে ময়দান উপচে পড়ত সে সময়। কিন্তু বুট পরে খেলা বাধ্যতামূলক হতেই আমেদ খান ক্রমশঃ ফুটবল মাঠে নিষ্প্রভ হয়ে যান। তবে সেই পড়ন্ত বেলাতেও ১৯৫৮-র আইএফএ শিল্ড ফাইনালে বলরামের সঙ্গে গোল করে চূর্ণ করেছিলেন মোহনবাগানকে।

ধূপ নিভে গেলেও যেমন তার সুগন্ধ রয়ে যায়, তেমন আমেদ খানও চিরকাল রয়ে যাবেন স্মৃতিতে। মনের সোনালি ফ্রেমে অমর হয়ে থাকবে তাঁর সেই অনবদ্য ড্রিবল, পাসিং আর দর্শনীয় বল কন্ট্রোল।

ভারতীয় ফুটবলের এই কিংবদন্তি কখনও অতীত হতে পারেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন