পর্তুগালের জন্য রাত জাগবে মহিষাদলের মিরপুর

পর্তুগাল ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়ন হলে সুজিত পেরেরার বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হবে। রোনাল্ডো-নানি গোল দিলে আনন্দে আটখানা হবে ছেলে-ছোকরারা. পর্তুগাল চ্যাম্পিয়ন হলে বাজি ফাটবে। পর্তুগালের কোনও গ্রাম বা, কোনও শহর নয়, নিদেন পক্ষে ভারতের গোয়াও নয়। বিস্ময়ের হলেও সত্যি, এমনই একটি ছোট্ট জনগোষ্ঠী এই পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে থাকেন, যারা কার্যত বাঙালি আর পর্তুগিজদের মধ্যে ‘মিসিং লিঙ্ক’! গ্রামের নামটি মিরপুর।

Advertisement

আরিফ ইকবাল খান

হলদিয়া শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ২০:৩২
Share:

পর্তুগাল ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়ন হলে সুজিত পেরেরার বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হবে। রোনাল্ডো-নানি গোল দিলে আনন্দে আটখানা হবে ছেলে-ছোকরারা. পর্তুগাল চ্যাম্পিয়ন হলে বাজি ফাটবে। পর্তুগালের কোনও গ্রাম বা, কোনও শহর নয়, নিদেন পক্ষে ভারতের গোয়াও নয়। বিস্ময়ের হলেও সত্যি, এমনই একটি ছোট্ট জনগোষ্ঠী এই পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে থাকেন, যারা কার্যত বাঙালি আর পর্তুগিজদের মধ্যে ‘মিসিং লিঙ্ক’! গ্রামের নামটি মিরপুর। মহিষাদলের বেতকুন্ডূ গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটি ‘পর্তুগিজদের গ্রাম’ বলেই পরিচিত।

Advertisement

পর্তুগালের ইউরো কাপের ফাইনালে ওঠায় বেজায় খুশি এই গ্রামের আট থেকে আশি! সঙ্গত কারণেই পর্তুগাল নিয়ে এত মাতামাতি এখানে। ফাইনালের আগের দিন কেউ রোনাল্ডোর ছবি বুকে নিয়ে ঘুরছেন , কেউবা আবার রোনাল্ডোর ছবি লাগানো জার্সি গায়ে দিয়েই রোনাল্ডো হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন!

এই রোনাল্ডো প্রেমের পেছনে শুধু নিখাদ ফুটবল আছে তাই নয়, রয়েছে তিনশো বছরের এক ইতিহাস। এখানেই সময়ের চাকা যেন থমকে রয়েছে! তিনশো বছর আগেকার কথা। বর্গী দস্যুদের হাত থেকে মহিষাদল রাজপরিবারকে রক্ষা করতে রানি জানকী গোয়া থেকে জনা বারো অসম সাহসী পর্তুগিজ গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসেন। এদের জলপথে লড়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার জন্য বর্গী-হানার হাত থেকে রেহাই পায় মহিষাদল। পুরস্কার মেলে হাতেনাতে। রানি জানকী হুগলি– হলদি–রুপনারায়ণ নদীর মিলনস্থলের কাছেই গেঁয়োখালির মিরপুরে নিষ্কর জমি উপহার দেন পর্তুগিজদের। সেই থেকেই মিরপুর হল পর্তুগিজদের গ্রাম। এখন এখানে মেরেকেটে ১৬০-১৭০টি পরিবার থাকেন। এরা সবাই পর্তুগিজ, কিন্তু বাংলায় কথা বলেন। আচার-আচরণে আর পাঁচটা বাঙালির চেয়ে আলাদা নন তাঁরা। এই পর্তুগিজ বংশোদ্ভূতদের মধ্যে বেশির ভাগই ‘তেসের’ পদবি ব্যবহার করেন৷ বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ ‘রোথা’, কেউ ‘পেরেরা’, ‘লোবো’, কেউ ‘রোজারিও’, কেউবা ‘ডি'ক্রুজ’ পদবি ব্যবহার করেন৷ এখানেই রয়েছে ঝরঝরে বাংলায় লেখা যিশুর মন্দির। রোমান ক্যাথলিক গির্জাও রয়েছে। রোমান এবং প্রোটেস্টান্ট, দুই ধরনের মানুষই এখানে থাকেন।

Advertisement

গির্জায় ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহিলা এবং পুরুষেরা বসে রয়েছেন। ক্যাথলিক গির্জার কাছে কয়েক জন বৃদ্ধ বসে রয়েছেন নিরুত্তাপ ভাবে। কিন্তু সুদীপ্ত পেরেরা, সাহেব রোজারিও, মারতিন তেসরা, সাহিল লবু, সীমা তেসরা, মধুমিতা রোজারিওরা মেতে রয়েছেন ফুটবলে। তাঁরা মনে-প্রাণে চান পর্তুগালের জয়। সুদীপ্ত নবম শ্রেণির ছাত্র। তাঁর কথায়, ‘‘আমার আদর্শ রোনাল্ডো। যেমন স্কিল, তেমনই দেবদূতের মতো দেখতে। রোনাল্ডোর ছবি দেওয়া জার্সি পরে বসে খেলা দেখব।’’ রোনাল্ডোর কথা উঠতেই হই হই করে উঠলেন সীমা–মধুমিতারাও। তাঁদের কথায়, ‘‘ফুটবল অত বুঝি না। কিন্তু পর্তুগাল ফাইনাল খেলবে ভাবলেই বেশ আনন্দ হচ্ছে!’’ কলেজের ছাত্র সাহেব রোজারিও বললেন, ‘‘পর্তুগাল জিতবেই। কি দারুণ দল! আমরা ঠিক করেছি, সবাই দল বেঁধে ভাল কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে আসব। এটাই আমাদের সেলিব্রেশান!’’ এক সঙ্গে বসে খেলা দেখার ইচ্ছেও আছে সবার বলে জানালেন মাটিন তেসরা।

আর বয়স্করা কী বলছেন?

৮২ বছর বয়স্ক ইমান্যুয়েল রোজারিও বললেন, ‘‘কালের স্রোতে আমরা বাঙালিই হয়ে গেছি। আমাদের পরিচয় আমরা ভারতীয়। কিন্তু আমাদের শেকড়ের কথা মনে হলেই হুহু করে ওঠে মনটা!’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘পর্তুগিজ ভাষাও জানি না।’’ সুবিনয় ডি’ক্রুজ নামে ৮০ বছরের বৃদ্ধ বললেন, ‘‘আমি মারতিন বার্ন কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ফুটবলটা দারুণ খেলতাম। ছেলে-ছোকরাদের মুখ থেকে রোনাল্ডোর নাম শুনেছি। আমি আশা করি, ও-ই পর্তুগালকে জেতাবে।’’ তবে আশি বছর বয়সের ডিরল তেসরার কথায়, ‘‘খেলার খোঁজ রাখি না, ছেলেরা বলে আর আমরা শুনি। টিভিতেও খেলা দেখা হয় না।’’

এ দিন যিশুর মন্দিরে অনেকে রোনাল্ডোর গোল চেয়ে প্রার্থনাতেও বসেছেন। ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে শঙ্কর প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক দুরন্ত পর্তুগিজ দিয়েগো আলভারেজের। বাঙালি অভিনেত্রী বিপাশা বসুও রোনাল্ডোর সঙ্গে এক মঞ্চ ‘শেয়ার’ করেছিলেন। এক বাঙালি পর্তুগিজ বললেন, ‘‘আমরা চাই সারা বাংলা পর্তুগালকে সমর্থন করুক।’’

রোনাল্ডোর গোলার মত শট ফ্রান্সের গোলে আছড়ে পড়লে এই ছোট জনগোষ্ঠীর আবেগের বিস্ফোরণ শুধুই সময়ের অপেক্ষা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন