Mohun Bagan

ব্র্যাভোর ‘চ্যাম্পিয়ন’ নাচ আর সবুজ-মেরুন হোলি

মুঠো মুঠো আবির উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল আকাশে। দু’পাশের গ্যালারি থেকে উড়ে আসা সবুজ-মেরুন রং মেঘের মতো ছেয়ে ফেলেছিল কল্যাণী স্টেডিয়াম।  

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কল্যাণী শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২০ ০৪:১৬
Share:

কল্যাণীতে ভারতসেরা মোহনবাগান। উচ্ছ্বসিত বাগান সমর্থকরা।

মুঠো মুঠো আবির উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল আকাশে। দু’পাশের গ্যালারি থেকে উড়ে আসা সবুজ-মেরুন রং মেঘের মতো ছেয়ে ফেলেছিল কল্যাণী স্টেডিয়াম।

Advertisement

হোলির দিনে অবশ্য নানা রং রাঙিয়ে দিয়ে গেল একশো তিরিশ বছরের মোহনবাগানকে। ‘বাস্ক’ পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়লেন ‘মিডফিল্ড জেনারেল’ জোসেবা বেইতিয়া। স্পেনের পতাকা গায়ে জড়িয়ে ফ্রান গঞ্জালেস তাঁর সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া গ্যালারির দিকে। আশুতোষ মেহতা, ননগোম্বা নওরেমরা কেউ ক্লাবের পতাকা, কেউ দেশের পতাকা নিয়ে মাঠে পাগলের মতো দৌড়লেন। হঠাৎ-ই ‘আমাদের সুর্য মেরুন’ গান থামিয়ে মাইকে বেজে উঠল ডোয়েন ব্র্যাভোর সেই ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গান। কিবু ভিকুনার ব্রিগেড তার সঙ্গে নাচতে শুরু করে দিল। বিশাল চেহারার ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর ড্যানিয়েল সাইরাসকে দেখা গেল নাচের মধ্যমণি হতে। নাচ থামতেই মোহনবাগান কোচকে আকাশে তুলে ধরল পুরো দল। তাঁকে নিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দোলাতে শুরু করলেন পাপা বাবাকর দিওয়ারারা। স্টেডিয়ামের বাইরে তখন বাজির আওয়াজে কান পাতা দায়। জ্বলছে মশাল।

অপেক্ষার পরে সাফল্য পেলে উদ্বেলতা কি এ রকম বাঁধনছাড়া হয়? নদীর স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু। স্পেন, সেনেগাল, ত্রিনিদাদ, ভারত, বাংলা—সব মিশে যায় যে জোয়ারের টানে। মঙ্গলবারের মোহনবাগানে সেটাই হল।

Advertisement

পাঁচ বছর পরে ফের আই লিগ খেতাব গোষ্ঠ পাল সরণির তাঁবুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার ছিল পাঁচ ম্যাচে দু’পয়েন্টের। ড্র-এর অর্থ ফের অপেক্ষার প্রহর গোনা। কিন্তু কিবু বাহিনী তো অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না, তাঁদের দলের সমর্থকদের মতোই। হাতে থাকা সব অস্ত্র শুরু থেকেই তাই ব্যবহার করলেন স্পেনীয় কোচ। কিন্তু কিছুতেই যে গোল হচ্ছে না। বাবা, তুর্সুনভ সহজ সুযোগ নষ্ট করলেন। পাল্টা আক্রমণে আইজলও দু’বার মোহনবাগান গোলের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৪ ম্যাচে সাতটি ড্র করা স্ট্যানলি রোজারিয়োর দল কী ফের পয়েন্ট কেড়ে নেবে? বেইতিয়া বল ধরলেই দৌড়ে এসে তাঁকে ডাবল কভারিং করছে পাহাড়ি টাট্টু ঘোড়ারা। আইজলের দুই স্টপার ঘানার জোসেফ আর উগান্ডার রিচার্ড বারবার আটকে দিচ্ছিলেন লা লিগায় খেলে আসা পাপাকে। এ রকম চলতে চলতেই এল ভারত সেরা হওয়ার সেই কাঙ্ক্ষিত গোল। আশি মিনিটের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কাজ করল বেইতিয়া-পাপার যুগলবন্দিই। স্পেনীয় মিডিয়ো সাপের মতো এঁকেবেঁকে যে দৌড়টা দিলেন, তাতে কেটে গেলেন আইজলের তিন ফুটবলার। বেইতিয়া বল দিলেন পাপাকে। গড়ানো জোরালো শটটা হোলির দিনকে মুহূর্তে করে দিল সবুজ-মেরুন। টানা নয় ম্যাচে দশ গোল করে ফেললেন পাপা। মোহনবাগানও ছুঁয়ে ফেলল ডেম্পোর দুর্লভ রেকর্ড। জাতীয় লিগ ও আই লিগ মিলিয়ে পাঁচ বার খেতাব জিতল তারাও। গোয়ার ক্লাবের আরও একটা গর্বকে স্পর্শ করল কিবুর দল। লিগ শেষের চার ম্যাচ আগেই খেতাব জয়ের অনন্য সম্মান।

কোন রসায়নে কিবুর মোহনবাগানের এই দুর্দান্ত সাফল্য? উঠে আসছে অনেক চমকপ্রদ তথ্য। বিদেশি বাছার ব্যাপারে কোচের হাতে পুর্ণ ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন কর্তারা। বিশেষ করে, স্পেনীয় ফুটবলারদের বেছেছিলেন কিবুই। বাংলাদেশ থেকে খেলে ফেরার পরে সালভা চামোরোকে ছেঁটে পাপাকে নেওয়ার সময়ও আবার কর্তাদের সঙ্গে সহমত হন কোচ।

এ পর্যন্ত ১৮৯ দিন অনুশীলন করেছেন বেইতিয়ারা। প্রায় প্রত্যেক দিনই নতুন নতুন কিছু সেট পিস বা পাসিং ফুটবল শিখিয়েছেন কিবু। খেলা শুরুর আগে ছোট পর্দায় দেখিয়ে দিতেন, সে দিন কী অনুশীলন হবে। দলের ম্যানেজার সঞ্জয় ঘোষ বলছিলেন, ‘‘কিবুর আসল শক্তি তাঁর ড্রেসিংরুম রসায়ন। অসাধারণ ম্যান ম্যানেজমেন্ট। পাপাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, কিয়ান নাসিরিও সমান গুরুত্ব পেয়েছে।’’ কিবু প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে যাঁর উপরে ভরসা করেন, সেই সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী ছ’বছর কাজ করেছেন ইস্টবেঙ্গলে। তিন বিদেশি কোচের সঙ্গে কাজ করে আসা রঞ্জনের মন্তব্য, ‘‘কিবু দাম্ভিক নন। শেষ সিদ্ধান্ত নিজে নিলেও দল বাছার সময় সহকারীদের মত নেন। মাঠের বাইরে শান্ত হলেও ম্যাচ বা অনুশীলনের তিনি প্রকৃতই হেড মাস্টার।’’

খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে প্রায় দু’ঘণ্টা। স্টে়ডিয়ামের বাইরে তখনও ‘টিম বাস’ ঘিরে চলছে উদ্বেল ভক্তদের উল্লাস। পাপা, বেইতিয়াদের মতো কিবু বেরোতেই দাবি উঠল, ‘‘আই লিগ পেয়েছি। ডার্বিতে জিততে হবে স্যর।’’ কিবু স্যর হাসেন। তারপর বরাভয়ের হাত তুলে উঠে পড়েন গাড়িতে। কলকাতায় এসে তিনিও তো বুঝে গিয়েছেন, খেতাবের মতো ডার্বি জয়ও কত গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের কাছে।

মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, আশুতোষ মেহতা, ফ্রান গঞ্জালেস, ড্যানিয়েল সাইরাস, ধনচন্দ্র সিংহ, ননগোম্বা নওরেম (রোমারিও জেসুরাজ), শেখ সাহিল (শিল্টন ডি সিলভা), কোমরান তুর্সুনভ, জোসেবা বেইতিয়া, সুহের ভিপি (শুভ ঘোষ), পাপা বাবাকর দিয়োহারা।

আইজল এফসি: জোথামাইয়া, জোয়ি জোহিরলিয়ানা, জুকো রিচার্ড, জোসেফ আদিজা, রোচারিজেলা, পল রাচানজৌভা, আলফ্রেড জারিয়ান, লালমাংঘাকিমা (উইলিয়াম লালফানুলা), ক্ল্যারোসাংগা, মালসমজুয়ালা (জাস্টিস মর্গান), মাতিয়াস ভেরন।

আই লিগ

মোহনবাগান ১ - আইজল ০

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন