বদলের নাগপুরে ইতিহাস বদলের যুদ্ধ

কথাটা শুনে অট্টহাস্য শুরু করে দিলেন অমর কারলেকর। খর্বকায়, শীর্ণ ভদ্রলোক আদতে নাগপুর কিউরেটর। ভিসিএ প্যাভিলিয়নের সিঁড়ির সামনেটায় মিডিয়া তাঁর কাছে অদ্ভুত আবদার রেখেছিল যে, আপনি বলে দিন এটা তিন দিনে শেষ হবে কি না।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

নাগপুর শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:১৩
Share:

আয় তোরা। প্র্যাকটিসে স্বমেজাজে ক্যাপ্টেন কোহলি। ছবি: পিটিআই

কথাটা শুনে অট্টহাস্য শুরু করে দিলেন অমর কারলেকর। খর্বকায়, শীর্ণ ভদ্রলোক আদতে নাগপুর কিউরেটর। ভিসিএ প্যাভিলিয়নের সিঁড়ির সামনেটায় মিডিয়া তাঁর কাছে অদ্ভুত আবদার রেখেছিল যে, আপনি বলে দিন এটা তিন দিনে শেষ হবে কি না। নাগপুরে ঘোরাঘুরির প্রচুর জায়গা আছে। আপনি নিশ্চয়তা দিলে শেষ দু’দিন একটা সিটি ট্যুরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে! শুনে একচোট হেসে ভদ্রলোক বললেন, “আরে, এটা কি মোহালি নাকি? এখানে তিন দিনে হবে না।”

Advertisement

নিছক রসিকতা। কিন্তু কিউরেটর যা বললেন, সত্যি তো? কে জানে কেন, পুরোপুরি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না। দুপুর দেড়টা থেকে চোখের সামনে সিনেমা রিলের মতো পরপর যা ঘটছিল, তা তো আরওই বিশ্বাস করতে দেবে না। মোহালির মতো একেবারে পাশে চলে গিয়ে পিচ-দর্শনের অনুমতি ভারতর্বষের কোনও স্টেডিয়ামে আর নেই। কিন্তু গ্যালারির সিঁড়ি বা অতিকায় নাগপুর প্রেসবক্সে উঠলে সারফেস দেখা যায়।

লালচে একটা আয়তক্ষেত্র। পাশের দু’টো সবুজ আভা স্ট্রিপের সঙ্গে কোথাও বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। মাঠকর্মীদের কেউ না কেউ সব সময় ওই বাইশ গজের পরিচর্যায় ব্যস্ত। আর দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ। উদ্বিগ্ন মুখচোখে যারা শশব্যস্ত ভাবে বারবার আয়তক্ষেত্রর দিকে ছুটে যাচ্ছে। কেউ সোজা গিয়ে পিচের পাশে ঝুঁকে পড়ছেন, টিপেটুপে বোঝার চেষ্টা করছেন ব্যাপারটা কী। কেউ আবার ডেকে পাঠাচ্ছেন কিউরেটরকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা গেল, গ্রুপ থেকে দু’জন বেরিয়ে গেলেন। চলে গেলেন পাশেরটায়। এবং কতটা টার্ন করছে বোঝার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা শুরু।

Advertisement

ওঁরা কারা? সহজ তো। দক্ষিণ আফ্রিকা। যাদের অধিনায়ক কিছুক্ষণ আগে অসহায় ভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে বসে ছিলেন!

সিরিজ কভার করতে আসা ডারবানের এক সাংবাদিক ক্রমাগত আক্ষেপ করছিলেন যে, সফরের পড়ে থাকা পনেরো দিন তাঁকে প্রায় নির্বান্ধব কাটাতে হবে। সিরিজ দিল্লি পর্যন্ত যাবে ধরে দেশ থেকে আরও জনাকয়েক সাংবাদিক বন্ধুর আসার কথা ছিল। কিন্তু নাগপুর উইকেটের খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা আর ফ্লাইট টিকিট কাটেননি! কাটার কথাও নয়। পাঁচ বছর আগে শেষ বার যখন শশাঙ্ক মনোহরের শহরে দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট খেলতে এসেছিল, তার পিচ-চরিত্র ও রেজাল্টের সঙ্গে এ বার মিল থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারতের বিরুদ্ধে সে বার এ মাঠে ইনিংসে জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। হাসিম আমলা আড়াইশো করেছিলেন। জাক কালিস একশো সত্তরের উপর। শক্ত, বাউন্সি উইকেটে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন ডেল স্টেইন। প্রথম ইনিংসে সাতটা-সহ ম্যাচে দশটা নিয়ে। কিন্তু সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। কালিস অবসরে। আমলার অফ ফর্ম। স্টেইনের নামার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এবং নাগপুর পিচও তার ধর্ম বদলেছে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সবুজ নইলে হার্ড উইকেট দিয়ে এসেছে নাগপুর। যা হয় পেসার-সহায়ক হবে। নইলে ফলাফলশূন্য পাটা। উদাহরণও আছে যথেষ্ট। রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতকে (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় খেলেননি) এক বার সবুজ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার মুখে ফেলে দিয়েছিল নাগপুর। আবার বছর তিনেক আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে উইকেটে নেমেছিল ভারত, তার কথা মনে পড়লে বিরাট কোহলির মেজাজ আজও খিঁচড়ে যায়। ভারতের টেস্ট অধিনায়ক এখনও ভুলতে পারেননি পঞ্চম দিনের পিচের বন্ধ্যা থেকে যাওয়ার দগদগে ইতিহাস।

কিন্তু সেটা ইতিহাসই। শোনা গেল, বছরখানেক আগে থেকে নাগপুর পিচের চরিত্র পাল্টানো শুরু হয়েছে। এটা এখন আদ্যন্ত টার্নার। ক্রিকেট সংস্থার কেউ কেউ বললেন, মোহালির মতো প্রথম দিন থেকে ঘুরবে না ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে নির্ঘাত্‌ ঘুরবে। আর তিন দিন নয়, এটা নাকি চার দিন পর্যন্ত যাবে। মোহালির সঙ্গে তফাত নাকি এটুকু!

আর তাই গোটা দিন ধরে ভারতীয় শিবিরের উত্‌ফুল্ল মনোভাবের কারণ আন্দাজ করা কঠিন হবে না। অমিত মিশ্র আজ তেত্রিশে পড়লেন। সকালে সরকারি ব্রডকাস্টারদের সাক্ষাত্‌কার দেওয়ার সময় এক বার দেখা গেল, টিমের ফিল্ডিং কোচ শ্রীধর লেগ স্পিনারকে পিছন থেকে জড়িয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গাইছেন। মুরলী বিজয় কোথা থেকে এসে গালটা একটু টিপে দিয়ে গেলেন! বিরাট কোহলিকে দেখা গেল মাঠকর্মীদের সঙ্গে দেদার সেলফি তুলতে। টিম ফুরফুরে, চনমনে থাকলে যা হয় আর কী।

সম্ভাব্য টিমের ইঙ্গিত শুনলে ভারত সমর্থকদেরও চনমনে থাকা উচিত। ভারত অধিনায়ক যে ভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে, “আমার ভাগ্য ভাল যে আমাকে অশ্বিন-অমিত-জাডেজাকে খেলতে হয় না” বলে গেলেন, তার পর বেঙ্গালুরুর কম্বিনেশন ভেঙে তিন স্পিনারে ফেরাটাই স্বাভাবিক। চমক হতে পারেন বরং বিজয়। তামিলনাড়ু ওপেনারকে এ দিন এক ঘণ্টার উপরে অফস্পিন করানো হল। আগামিকাল থেকে টেস্টে যদি তিনি টিমের চতুর্থ স্পিনার হিসেবে আবির্ভূত হন, আশ্চর্যের হবে না। আর একজন পেসার কমিয়ে রোহিত শর্মার মতো বাড়তি ব্যাটসম্যানের দিকে টিম ঝুঁকলেও ঝুঁকতে পারে। নেটে রোহিতের খাটাখাটনি দেখে কোহলিকে প্রশ্নটা করাও হয়েছিল। অধিনায়ক হেসে ফেলে বললেন, “গুড ট্রাই। কিন্তু লাভ হল না।”

দরকারও কী? শুধু দিন পাঁচেক পরে নয়াদিল্লির ফ্লাইটে ভারত অধিনায়ক হাসতে-হাসতে উঠলেই চলবে। বিদেশে আফ্রিকার গত পাঁচ বছরের অপরাজিত থাকার রেকর্ড চূর্ণ করে, দেশের মাটিতে ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন