ইনদওরে বিরাট-মার। রবিবার।ছবি: রয়টার্স।
প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কোনও কালেই। কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগীরা সন্দিহান ছিলেন তা হল—অধিনায়কত্ব বিরাট কোহালির কাঁধে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে কি না!
টেস্ট টিমের অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর সেই উত্তরটা দিয়েছে বিরাট কোহালির চওড়া উইলো। আর মহাষ্টমীর সুপার সানডে-তে ইনদওর যে বিরাট শো হয়ে গেল তার পর এই প্রশ্নটা আগামী দিনে কারও মাথায় আর ঘুরপাক খাবে বলে মনে তো হচ্ছে না!
কেন এ কথা মনে হচ্ছে? আসলে ভারতীয় টেস্ট ক্যাপ্টেনের চেয়ারটা এমনই এক রহস্যময় আসন যার চাপ অনেক তাবড় তাবড় টেস্ট অধিনায়কও সামলাতে পারেনি। এর প্রভাব পড়েছে তাঁদের ফর্মে। সেখানে বিরাটের কেরিয়ারের দিকে তাকালে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। নেতৃত্ব ভারতের এই ‘দিল্লিওয়ালা অধিনায়ক’কে আরও পরিণত করছে। বাড়িয়েছে দায়িত্ববোধ। মোদ্দা কথা হল, টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন্সিটা চুটিয়ে উপভোগ করছে বিরাট। যে রকম করত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক থাকার সময়।
তার মানে কিন্তু এটা নয় যে সিনিয়র টিমের অধিনায়কত্ব বিরাটের ব্যাটে রান এনে দিয়েছে। এ রকম পারফরম্যান্স ও ধোনির টিমের হয়েও করেছে। তখনকার সঙ্গে এখনকার তফাৎটা হল— বিরাট এখন আগের চেয়েও দায়িত্বশীল। সামনে থেকে টিমকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর সেটা করতে গিয়ে ও টিম আর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের সুইচ অন, সুইচ অফটার মধ্যে একটা দুর্দান্ত কো-অর্ডিনেশন রেখে যাচ্ছে। সেটা ইনদওরের হোলকার স্টেডিয়ামেও গত দু’দিন ধরে দেখলাম। টিমের প্রয়োজনে যখন ব্যাট হাতে নামছে তখন ক্যাপ্টেন্সির সুইচটা অফ রাখছে সাময়িক ভাবে। আর তার পর প্যাভিলিয়নে ফিরলে ব্যাটসম্যানের সুইচটা অফ করে ক্যাপ্টেন্সির সুইচটা অন করে দিচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টটা খুব ভাল করে দেখলেই তা বোঝা যাবে। ৬০-২ হয়ে যাওয়ার পর ক্রিজে এল বিরাট। খানিক পরেই ভারত ১০০-৩। এই রকম পরিস্থিতিতে বোলাররা ঘাড়ে চেপে বসার চেষ্টা করে। ব্যাটসম্যানরাও জানে একটা ভুল মানেই টিম গাড্ডায় পড়বে। এই অতি সতর্কতা থেকেই কেউ কেউ চাপে পড়ে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলে। কিন্তু বিরাট কোহালি এই জায়গাতেই আলাদা। ওর কাছে চাপ যত বাড়ে ও তত ভাল খেলে। এটাই ওর কেরিয়ারের ইউএসপি।
নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসনও তাঁর জোরে বোলারদের লেলিয়ে দিয়েছিল বিরাটের উপর। ওদের শর্ট বল সামলে দেওয়ার পর জিতন পটেলদের স্পিনটাও বিরাট খেলে দিল অবলীলায়। অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিরাটের ব্যাট আগ্রাসী হয়ে উঠত। কিন্তু এই বিরাটের মাথা শশার মতো ঠান্ডা। এই ২১১ রানের ইনিংসটা ও দারুণ ভাবে প্ল্যান করে খেলল। অহেতুক আগ্রাসী হয়নি। বরং পরিসংখ্যানে দেখছি, ও ৩৬৬ বল খেলেছে, ১১৫টা সিঙ্গল নিয়েছে। বাউন্ডারি ২০টা। নিজের ইনিংসকে অন্য গিয়ারে নিয়ে গিয়েছিল ও। যে কারণে ওর অন্য বড় ইনিংসগুলোর থেকে একটু আলাদা ইনদওরের এই ডাবল সেঞ্চুরি। বিরাটের শরীরী ভাষাও তাই বলছে। আগে এ রকম ইনিংসের পর চেস্ট বাম্প, হাত ছোড়া, লাফানো— সব দেখা গিয়েছে বিরাটের কাছ থেকে। কিন্তু এ বার ডাবল সেঞ্চুরির পর অদ্ভুত রকমের শান্ত। আর এটাই হচ্ছে নতুন বিরাট। যে একইসঙ্গে টিমের অন্যতম সেরা পারফর্মার ও অধিনায়ক।
ইনদওরে এই ২১১ রানের ইনিংসের পর অধিনায়ক হিসেবে দু’টো ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে গেল বিরাটের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ঊনআশি দিন আগে প্রথমটা করেছিল ও। মাত্র দশ ইনিংস আগে। জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন্সি বিরাট কতটা উপভোগ করছে সেটা এই তথ্যটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে (২৫ এবং ১৩) ২৭ বছর বয়সেই ৩৮ টা সেঞ্চুরি করে ফেলেছে ছেলেটা। এর পরে ওকে টেস্ট ক্রিকেটারদের লেজেন্ডদের দলে কেউ না রাখলে তা বোকামির সামিল।
ক্রিকেট অনুরাগীরা ধন্যবাদ দিতেই পারেন মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কর্তাদের। গত তিন বছর ধরে দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজে বিরাটের কোনও সেঞ্চুরি ছিল না। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও প্রথম দুই টেস্টে বিরাটের তিন অঙ্কের রান নেই বলে কোনও কোনও মহল থেকে মৃদু গুঞ্জন তৈরির চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু কিউয়িদের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টে সব কিছুর জবাব দিয়ে দিল ও।
ভারতীয় ক্রিকেট দিল্লি স্কুল আর মুম্বই স্কুল— এই দুই ঘরানার দাপট নিয়েই এগিয়েছে প্রথম দিন থেকে। ইনদওর টেস্টের প্রথম ইনিংস সেই দুই স্কুলের দুই বর্তমান ফার্স্ট বয়— বিরাট কোহালির আর অজিঙ্ক রাহানের ব্যাটিং সৌন্দর্য দিয়েই সাজানো। বিরাটের ডাবল সেঞ্চুরির পাশে রাহানের সেঞ্চুরিও বেশ ঝকঝকে। টু পেসড পিচে এই দুই ব্যাটসম্যানের চতুর্থ উইকেটে ম্যামথ-পার্টনারশিপটাও ইনদওরের প্রথম টেস্টের একটা রেকর্ড। আর সেখানেও বিরাটের নেতৃত্ব দিয়ে রাহানেকে গাইড করাটাও একজন দায়িত্ববোধসম্পন্ন ক্যাপ্টেনের পরিচয়।
ভারত
প্রথম ইনিংস (প্রথম দিন ২৬৭-৩)
কোহালি এলবিডব্লিউ পটেল ২১১
রাহানে ক ওয়াটলিং বো বোল্ট ১৮৮
রোহিত ন.আ. ৫১
জাডেজা ন.আ. ১৭
অতিরিক্ত ১০
মোট ৫৫৭-৫ ডি.
পতন ২৬-৬০-১০০-৪৬৫-৫০৪।
বোলিং: বোল্ট ৩২-২-১১৩-২, হেনরি ৩৫-৩-১২৭-০,
পটেল ৪০-৫-১২০-২, স্যান্টনার ৪৪-৪-১৩৭-১, নিশাম ১৮-১-৫৩-০।
নিউজিল্যান্ড
প্রথম ইনিংস
গাপ্টিল ন.আ. ১৭
ল্যাথাম ন.আ.৬,
অতিরিক্ত ৫
মোট ২৮ বিনা উইকেটে।
বোলিং: শামি ২-০-৫-০, উমেশ ২-০-৭-০,
অশ্বিন ৩-১-৯-০, জাডেজা ২-১-২-০।