দ্রোণাচার্য: অনুশীলনে এ ভাবেই ছাত্রদের ভুলত্রুটি শুধরে দিতেন কোচ প্রদীপকুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
ভারতের সর্বকালের সেরা ফুটবলার ও কোচ। আই লিগে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বির আগে স্মৃতির সরণিতে হাঁটলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বি মানেই ভয়ঙ্কর উত্তেজনা। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই অদ্ভুত ভাবে আবহ বদলে যেত। মনে হত, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছি! ফুটবলার, কোচ, ক্লাবের কর্মকর্তা থেকে সাধারণ সমর্থক— সকলের জীবন যেন এই ম্যাচটার উপরেই নির্ভর করত। পরিষ্কার দু’ভাগ হয়ে যেত বাঙালি।
দুই প্রধানেই কোচিং করানোর সুবাদে অসংখ্য ডার্বিতে রিজার্ভ বেঞ্চে বসেছি। কিন্তু আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে তিনটি ডার্বি। প্রথমেই থাকবে ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে চূর্ণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। তার পরে রাখব ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে ডায়মন্ড সিস্টেমকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ৪-১ জয়। এর পরে রাখব রোভার্স কাপে মোহনবাগানের কোচ হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয়।
পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের আগে ঠিক করলাম, অনুশীলনের পরে ড্রেসিংরুমে টিম মিটিং করব না। ওয়ার্ম আপের সময়েই কথা বলব ফুটবলারদের সঙ্গে। ওদের বোঝাব, আমি ঠিক কী চাইছি। কী ভাবে খেলতে হবে। শেষ টিম মিটিং করব ম্যাচের দিন মাঠে নামার ঠিক আগে। এখনও মনে আছে, ড্রেসিংরুমে বলেছিলাম, মরসুমের শেষ ম্যাচ খেলতে নামছ তোমরা। কে জিতল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী ভাবে জিতল, সেটাই আসল। যদি তোমরা আধিপত্য নিয়ে জিততে পারো, তা হলে বুঝব, আমি যা চেয়েছি তা দিতে পেরেছ। সে-দিন অবিশ্বাস্য খেলেছিল ছেলেরা। আমি অবশ্য জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কারণ, আমাদের প্রস্তুতি খুব ভাল হয়েছিল।
১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালের আগে আমি মোটেই স্বস্তিতে ছিলাম না। মোহনবাগান দারুণ খেলছিল। প্রতিদিনই নানা রকম অঙ্ক করতাম ওদের হারানোর জন্য। ম্যাচের কয়েক দিন আগে আমার কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিলেন মোহনবাগানের কোচ, প্রয়াত অমল দত্ত। ভাইচুং ভুটিয়াকে বললেন ‘চুমচুম’। স্যামি ওমোলোর নাম দিলেন ‘ওমলেট’। সোসোকে বললেন ‘শসা’। ফুটবলারদের বললাম, অমল দত্ত নিজে বড় ফুটবলার ছিলেন না। তাই তোমাদের ছোট করার চেষ্টা করছেন। তোমাদের মনে রাখতে হবে, রাস্তায় বা লোকের মুখে ফুটবল হয় না। খেলতে হয় মাঠে নেমে। এর পরের ঘটনা তো ইতিহাস। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রেকর্ড দর্শকের সামনে ৪-১ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। হ্যাটট্রিক করে উপেক্ষার জবাব দিয়েছিল ভাইচুং।
আমি তখন মোহনবাগানের কোচ। সালটা ঠিক মনে পড়ছে না। মুম্বইয়ে রোভার্স কাপে প্রতিপক্ষ দুর্ধর্ষ ইস্টবেঙ্গল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর ক্ষমতা নেই আমাদের। ম্যাচের আগের দিন ছেলেদের বললাম, মাঠে যখন নামবে, শুধু তোমাদের দল নয়। গোটা দেশের মানুষ তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমি বিশ্বাস করি, এই ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ার ক্ষমতা রয়েছে তোমাদের। যদি সেই আত্মবিশ্বাস না-থাকে, তা হলে মাঠে নেমে বিশ্বাসঘাতকতা করে দলকে ডুবিয়ো না। সে-দিন ছেলেরা মাঠে নেমে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিল। কুপারেজ স্টেডিয়ামের দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ময়দান থেকে দূরে। কিন্তু ডার্বির প্রসঙ্গ উঠলে এখনও একই রকম উত্তেজনা হয়। মনে পড়ে যায়, ডার্বি জেতার জন্য কত কাণ্ডই না করেছি আমি! কখনও ফুটবলারদের উত্তেজিত করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে অপমান করেছি। কখনও বাবাবাছা করে বাড়িতে ডেকে এনে আদর করে খাইয়েছি। এর জন্য আমার প্রয়াত স্ত্রী আরতিকে বিদেশি রান্না করতেও শিখিয়েছি। ডার্বির দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই বেশি করে ফিরে আসছে অতীতের স্মৃতি।
ফুটবলারদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল অদ্ভুত রকমের। মাঠের মধ্যে আমি কড়া শিক্ষক। কোনও রকম বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করতাম না। কিন্তু মাঠের বাইরে বন্ধুর মতো মিশতাম ওদের সঙ্গে। বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতাম বিদেশি ও ভিন্ রাজ্যের ফুটবলারদের উপরে। ওরা নিজেদের পরিবার ছেড়ে খেলতে এসেছে। বাড়ির জন্য ওদের মন খারাপ করাটা খুব স্বাভাবিক। আমার লক্ষ থাকত, ওরা যেন কলকাতায় নিজেদের একা না-ভাবে। এর জন্য মাঝেমধ্যেই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতাম। একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। চিমা ওকোরি তখন ইস্টবেঙ্গলে। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, আমি যা চাইছি, ওর কাছ থেকে তা পাচ্ছি না। চিমা মনে হয় মানসিক কষ্টে ভুগছে। এ দিকে দরজায় কড়া নাড়ছে ডার্বি। আরতির দ্বারস্থ হলাম। ওকে বললাম, চিমাকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করছি। তবে তোমাকে কিন্তু নাইজিরীয় খাবার রান্না করতে হবে। আমার কথা শুনে আরতি তো স্তম্ভিত। বলল, ‘‘আমি তো নাইজিরীয় রান্না জানি না। তুমি বরং ওকে কোনও রেস্তরাঁয় নিয়ে যাও।’’ আমার উদ্দেশ্য ছিল, নাইজিরিয়ার খাবার খাইয়ে চিমাকে বোঝানো যে, তুমি আমাদের পরিবারেরই সদস্য। রেস্তরাঁয় নিয়ে গেলে তা হত না। আরতিকে বললাম, আমিই তোমাকে নাইজিরীয় রান্না শিখিয়ে দেব। ইন্টারনেট থাকলে সহজেই শিখিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আশির দশকে সেই সুযোগ ছিল না। শুনেছিলাম, চিজ় ও মাখন খুব ব্যবহার করা হয় নাইজিরীয় রান্নায়। চিমা খুব মাংস খেতে ভালবাসত। আমার কথা শুনে রান্না করল আরতি। যা খেয়ে চিমা অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। বাঙালি ফুটবলারেরা আরতির রান্নার দারুণ ভক্ত ছিল। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হত।
অথচ এই আরতির সঙ্গেই বেশ কয়েক বার আমার বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ডার্বিকে কেন্দ্র করে! ও মোহনবাগানের সমর্থক ছিল। সমস্যাটা হত আমি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হলে। মনে পড়ছে, বেশ কয়েক বার ম্যাচের আগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে আমি জিতে বাড়ি ফিরলে দারুণ আনন্দ করত।
কোচের কাজ কিন্তু ফুটবলারদের শুধু অনুশীলন করানো বা রণকৌশল তৈরি করা নয়। আসল পরীক্ষা ফুটবলারদের কাছ থেকে সেরাটা বার করে আনা। তার জন্য ফুটবলারদের ক্ষোভের মুখেও পড়েছি বহু বার। অনেকে তো প্রকাশ্যে আমাকে জঘন্য ভাষায় গালাগালি দিতেও ছাড়েনি। আমি অবশ্য কোনও কিছুই গায়ে মাখতাম না। জানতাম, ওরা আমাকে সকলেই শ্রদ্ধা করে। ম্যাচের উত্তেজনা থেকেই গালাগালি করেছে। ফুটবলারেরা তার দলের কোচকে এ ভাবে আক্রমণ করছে দেখে অনেকেই অবাক হতেন। আমি মনে মনে হাসতাম। কারণ, ওদের মধ্যে এই আগুনটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম। তার জন্য ম্যাচের আগে নানা ভাবে উত্তেজিত করতাম। কখনও মহম্মদ হাবিবকে বলতাম, সবাই বলে আমেদ খান বিরাট ফুটবলার। প্রমাণ করো, তুমি তার চেয়েও বড় ফুটবলার। সাত্তারের মতো এত ভাল পাসার আমি কখনও দেখিনি। তুমি কি পারবে ওকে ছাপিয়ে যেতে? প্রত্যেকের জন্যই আলাদা ফর্মুলা থাকত আমার। এর জন্য সবার মনস্তত্ত্ব বুঝতে হত। তার পরে রণকৌশল ঠিক করতে হত।
তবে কোচ হিসেবে ভোম্বলবাবু (সুভাষ ভৌমিক) ও গৌতমকে (সরকার) সামলাতেই সব চেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে। সুভাষ সতীর্থদের পিছনে খুব লাগত। এর ফলে অনেকেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ত। দলে শৃঙ্খলার অভাব ঘটত। এক দিন সুভাষকে ডেকে বললাম, দেখো বাবা, কাউকে ছোট করলে তোমার নিজের খেলাই খারাপ হয়ে যাবে। তখন কিন্তু কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবে না। ওকে উত্তেজিত করার জন্য বলতাম, তুমি জেনে গিয়েছ। শুধু তোমার সতীর্থ নয়, অভিনেতা উত্তমকুমার কী করছেন, সেই খবরও তোমার কাছে রয়েছে। এক বার তো খেপে গিয়ে চিৎকার করে আমাকে বলেছিল, ‘‘আপনি আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছেন।’’ গৌতমের রাগ যেন সব সময়েই সপ্তমে চড়ে থাকত। যে-কোনও সময় খুন করে ফেলবে। মজা করে ওকে আমি ‘বুল টেরিয়র’ বলে ডাকতাম।
শুধু ফুটবলারদের নয়। ডার্বির আগে নিজেকেও সামলাতেও হত কোচেদের। বেশ কিছু ডার্বির আগে সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না। অস্থির-অস্থির লাগত। অথচ কাউকে বলতে পারতাম না। আরতি বলত, ‘‘তোমার দল তো দারুণ খেলছে। তা হলে কিসের ভয়?’’ ডার্বি শুধু ফুটবলারদের নয়, কোচেদের কাছেও নিজেদের প্রমাণ করার মঞ্চ।