পর্তুগালের নিউজ ওয়েবসাইটের ছবিটা দেখলে হাসি পেয়ে যাবে। বেশ পেশিবহুল, বাঁটুল দি গ্রেট ধাঁচের একটা চেহারা। টুপি পরা, খালি গা, নীচে শর্টস। কষিয়ে তিনি আইসল্যান্ড যোদ্ধাদের প্রাচীরে ফ্রি কিক মারছেন ঠিকই। কিন্তু বলটা এক ফুটবলারের মাথায় ধাক্কা লেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। নীচে লেখা, ‘রোনাল্ডোকে নিয়ে একটু মস্করা করা হল!’
ব্রিটিশ মিডিয়া যে সাধারণত একটু জঙ্গিমনোভাবাপন্ন হয়, কে না জানে! কিন্তু তাই বলে এতটা? প্রশংসা নয়, নিন্দা নয়। এক কথায় সাদা পাতায় কালো কালিতে স্রেফ এক-একটা থাপ্পড়। হিংস্র ভাবে লিখে ফেলা— ‘‘ওহে রোনাল্ডো, আমরা জানি না তুমি রোজ সকালে উঠে আয়না দেখো কি না। যদি উত্তরটা ‘না’ হয়, তা হলে বলব এ বার থেকে একটু আয়নায় নিজেকে দেখো!’’
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে আইসল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ওলাফার গ্রিমসন যে সাক্ষাৎকারটা দিয়েছেন, পড়লে যে কোনও রোনাল্ডো সমর্থকের মাথা গরম হয়ে যাবে। বরফের দেশের প্রেসিডেন্ট কি না রোনাল্ডোর কথাবার্তায় এতটুকু রেগে যাননি। গ্রিমসনের বরং মনে হচ্ছে, রোনাল্ডোর কাছে তাঁরা কৃতজ্ঞ থেকে যাবেন। সওয়া তিন লক্ষের দেশ নিয়ে ফেটে পড়ছেন সিআর সেভেন, যা মুখে আসছে তা-ই বলছেন, আইসল্যান্ডের এর চেয়ে ভাল প্রচার আর কী হতে পারত!
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর একত্রিশ বছরের জীবন নিঃসন্দেহে বর্ণহীন যায়নি। পারফরম্যান্স গ্রাফ কখনও চড়াই ধরে উঠেছে। কখনও নামিয়ে দিয়েছে সমতলে। এটাও ভাবার কারণ নেই যে বিতর্ক, মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা বলে দেওয়া এই প্রথম তাঁর জীবনে ঘটল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বিতর্ক নিয়ে চলতে ভালবাসেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বিতর্কের দুনিয়ায় বাঁচতে ভালবাসেন। ফুটবল শুধু নয়, ফুটবলের বাইরের জগৎকেও নিজের দিকে টেনে রাখা— তাঁর বরাবরের পছন্দ। কিন্তু তাই বলে যে এত দুর্যোগপূর্ণ একটা সময় তাঁর ফুটবল-কেরিয়ারে ওত পেতে থাকবে, দিনের পর দিন টানা ক্ষতবিক্ষত করে যাবে, অপমানের ঘা শুকোনোর আগে তৈরি হয়ে যাবে নতুন ক্ষত— পর্তুগিজ মহাতারকা ভাবতে পেরেছিলেন?
ভাবতে পেরেছিলেন, তাঁর তারকাদ্যুতিকে অনায়াস উপেক্ষা করে ‘আইসল্যান্ড’ নামের নতুন রোমাঞ্চের দিকে ঘুরে যাবে পৃথিবী? ভাবতে পেরেছিলেন, এক জনও তাঁর কথা শুনবে না, এক জনও দাঁড়াবে না পাশে? যে দেশে জন্মেছেন, তারা বিদ্রুপ করবে। যে দেশে খেলে বিখ্যাত হয়েছেন, তারা ছিঁড়ে ফেলবে তীব্র সমালোচনায়!
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ভাবতে পেরেছিলেন, ইউরোয় তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচ নিয়ে কোথাও একটা কথাও হবে না?
আজ, শনিবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে বারোটায় দাভিদ আলাবার অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে নামছেন রোনাল্ডো। প্রথাগত যে সাংবাদিক সম্মেলনটা করতে হয়, সেটা পর্তুগাল ‘বিস্ময় বালক’ আঠারো বছরের রেনাতো স্যাঞ্চেজ করে গেলেন। কিন্তু অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে কী হবে না হবে, পর্তুগাল কোচ টিমকে জেতাতে কোন স্ট্র্যাটেজিতে যাবেন, সে সব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কোথায়? ঘুরেফিরে তো সেই রোনাল্ডো এবং আইসল্যান্ড। সেই রোনাল্ডোর খেপে গিয়ে আইসল্যান্ডকে ‘ছোট মনের’ বলে দেওয়া। আর সাংবাদিকদের সময়ও কোথায়? একটা বিতর্ক মিটতে না মিটতেই আরও একটা পাওয়া গিয়েছে। রোনাল্ডোকে নিয়েই পাওয়া গিয়েছে।
এবং এখানেও আইসল্যান্ড!
পর্তুগালের রোনাল্ডো এবং আইসল্যান্ডের গানারসনের মধ্যে সে দিন যে কিছু একটা হয়েছিল, আন্দাজ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়া। জার্মানির ‘বিল্ড’ পুরো ঘটনাটাকে এখন তুলে এনেছে। রোনাল্ডোকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ধত মানুষ’ বলে উল্লেখ করা ছেড়ে দেওয়া যাক। জার্মান কাগজ ঘটনার আরও গভীরে ঢুকেছে। তাদের দাবি, গানারসন সে দিন ম্যাচের পর রোনাল্ডোর কাছে রিয়াল মাদ্রিদের নতুন জার্সিটা চেয়েছিলেন। যার উত্তরে রোনাল্ডো নাকি বলেন, ‘‘তোমার সঙ্গে জার্সি বদল! তুমি কে হে?’’
জার্মান কাগজে লেখা হয়েছে, ফুটবল ম্যাচ শেষে প্রতিপক্ষ প্লেয়ারদের সঙ্গে হাত মেলানো, তাদের সঙ্গে জার্সি বদল স্বাভাবিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে। কে আসল স্পোর্টসম্যান আর কে নয়, এতেই বোঝা যায়। ফুটবলে সম্মান পেতে হলে এই জিনিসগুলো কর্তব্য। কিন্তু রোনাল্ডোকে এ সব ভদ্রতার রাস্তায় হাঁটতে কখনওই দেখা যায় না। ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত দৈনিক আবার লিখেছে, রোনাল্ডোর উচিত ছিল আইসল্যান্ডের প্রশংসা করা, সমালোচনা নয়। দেখা উচিত ছিল, ফুটবল বিশ্বের লিলিপুট হয়েও গালিভারদের ছুঁয়ে ফেলতে তাদের উদগ্র বাসনা। নিরন্তর রগড়ানির সঙ্গে ইচ্ছাশক্তি মিশিয়ে একটা গোটা ফুটবল-মডেলই তৈরি করে ফেলা, যা বড়-ছোট নির্বিশেষে যে কোনও আয়তনের দেশকে সাহস দেবে। নিজের বাইরে ভাবলে রোনাল্ডো এগুলো দেখতে পেতেন। অনুভব করতে পারতেন। আর আইসল্যান্ডের ফুটবলাররা তথাকথিত ‘ছোট মনের’ নন। ছোট মনের এক জনকেই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি— ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!
পরিস্থিতি এত ঘোরালো হয়েছে যে, আঠারো বছরের রেনাতো স্যাঞ্চেজকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে রোনাল্ডো নিয়ে। রেনাতো বলে দিয়েছেন, ‘‘আমাদের মনের অবস্থা ভাল ছিল না। আমরা আসলে প্রবল ভাবে জিততে চেয়েছিলাম। যা-ই হোক, পরের ম্যাচ নিয়ে আমরা প্রস্তুত।’’ বিতর্ক ও ড্রয়ে রোনাল্ডো বেকায়দায় বুঝে অস্ট্রিয়া কোচ জ্লাটকো জুনুজোভিক আবার বলে দিয়েছেন, ‘‘রোনাল্ডোর সব ভিডিও আমাদের দেখা শেষ। কোনও অবস্থাতেই ওকে আমাদের গোলের দিকে আসতে দেওয়া হবে না!’’ জিনিয়াসরা এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত ফুটবলের ভাষা দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দেন। নিশ্চিহ্ন করে দেন যাবতীয় বিতর্ক, সমালোচনার আগ্নেয়গিরিকে। দিয়েগো মারাদোনার জীবনেও তো কম কিছু ঘটেনি। বিতর্ক, ব্যক্তিগত জীবন— কোনটা বাদ ছিল? কিন্তু কোনওটাই তাঁর ফুটবল-দক্ষতার শৃঙ্গকে টপকে যেতে পারেনি।
সিআর সেভেনের তো এখন সেটাও নেই। বিখ্যাত স্টেপওভার, মোহিনী ড্রিবলিং, অকল্পনীয় নাক্ল বল ফ্রি কিক— রাতারাতি উধাও। মোক্ষম সময়ে একে একে বিদ্রোহ করছে সকলেই। শনিবার সম্মানের যুদ্ধে প্রত্যাবর্তন ঘটবে তাদের? দেখা যাক!