প্রত্যাশিত ছক্কায় শেষ বাজিরাও মহেন্দ্রর মস্তানি

লন্ডন থেকে শাহরুখ খানের পুণে মাঠে দৌড়ে আসা রোববার শেষ পর্যন্ত ঘটল না। তিনি সশরীরে নেই। তাঁর ফিল্মের শেষে গিয়ে সেই নাটকীয় মোচড়ও বাইশ গজে পাওয়া গেল না যা ‘ডন’ থেকে ‘ফ্যান’— এসআরকে-র ছবি মানে অন্তে থাকবেই!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

পুণে শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৫৭
Share:

অদেখা ধোনি। কখনও আম্পায়ারের সঙ্গে তর্ক জুড়ছেন। নিচ্ছেন সব দুর্বোধ্য সিদ্ধান্ত। ছবি বিসিসিআই

লন্ডন থেকে শাহরুখ খানের পুণে মাঠে দৌড়ে আসা রোববার শেষ পর্যন্ত ঘটল না। তিনি সশরীরে নেই। তাঁর ফিল্মের শেষে গিয়ে সেই নাটকীয় মোচড়ও বাইশ গজে পাওয়া গেল না যা ‘ডন’ থেকে ‘ফ্যান’— এসআরকে-র ছবি মানে অন্তে থাকবেই!

Advertisement

উমেশ যাদব ছক্কা মেরে দু’উইকেটে জিতিয়ে দিলেন কলকাতা-১-কে। ঠিক সেই সময় ছক্কাটাকে যতই নাটকীয় মনে হোক, ম্যাচের প্যাটার্ন অনুযায়ী এটা তো ভবিতব্য ছিল। শেষ ওভারে যতই উত্তেজনা রেখে খেলা গড়াক, যে টিমটাকে প্রথম বল থেকে মনে হচ্ছিল জিতবে। যারা প্রথম ওভার থেকে রান রেটে বরাবর এগিয়ে ছিল। তারাই করল, লড়ল এবং জিতল। উপসংহার বলছে, কেকেআর-ভূখণ্ড জয় যেমন সৌরভ আমলে পুণের কাছে অনাবিষ্কৃত ছিল, ধোনির শাসনেও তাই।

লিগ টেবলের শীর্ষে থাকা কেকেআরকে এত দিন জেতাচ্ছিল দুর্দান্ত সব ওপেনিং স্ট্যান্ড। অথচ রবিবার রাতে প্রথম বলেই উথাপ্পা এলবিডব্লিউ। গম্ভীর কিছু পরে আর সবাইকে ছেড়ে কি না ধোনির গ্লাভসে রান আউট। ম্যাচ তো ঘুরে যাওয়া উচিত। সেটা নিজেদের দিকেই রেখে দিলেন সূর্যকুমার যাদব। দুই অশ্বিনকে এমন তুলে তুলে মারলেন যে, নাগপুর মাঠে বহু বছর আগে ইরানি ট্রফিতে টিনএজার বেঙ্গসরকরের দৌরাত্ম্য মনে পড়ে গেল। ওটা আরও কঠিন যেহেতু ঘটেছিল বেদী-প্রসন্নর বিরুদ্ধে। কিন্তু এটাই বা সহজ কোথায়? এত চাপের ম্যাচ। মর্যাদার ম্যাচ। শুধু ধোনির দিকে তাকালেই তো চাপের ডেসিবেল বোঝা যাচ্ছে। প্রতিটা ডেলিভারির পর বল যে দিকেই যাক, এমন ছুটছেন ভারত অধিনায়ক যেন তিনি শর্ট মিড উইকেট ফিল্ডার!

Advertisement

অবশ্য আগে ধোনির ক্যাপ্টেন্সির এমন সোনার সময় যাচ্ছিল যখন তিনি যা বোলার বদলাবেন, তাতেই সোনা। এখন সেগুলোই দুর্বোধ্য লাগছে। আজ যেমন স্লো, স্পিনিং ট্র্যাকে কেন শুরুতে স্পিনার আনলেন না, বোঝা গেল না। কেন তিনি রবি অশ্বিনের প্রতি রাতারাতি এত আস্থা হারিয়ে ফেললেন যে, দু’ওভার করালেনই না? তার চেয়েও ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসা এই টিমে যখন কোনও পাওয়ার হিটার নেই, তিনি কেন আগে ব্যাট করবেন না? আর ২০ রান হলে তো হাসতে হাসতে জিতল রে-র স্ক্রিপ্টই হয়তো থাকত না। টি-টোয়েন্টির সহজতম এবং আদি স্ট্র্যাটেজি হল, সেরা ব্যাটসম্যান সবচেয়ে বেশি বল খেলবে। সেরা বোলার পুরো চার ওভার করবে। দু’টো শর্তই রোববার ধোনি মানলেন না।

অথচ আইপিএলের এই বলয় বাইরে থেকে যত জৌলুস ভরাই থাক, এর আঁচড় কী মারাত্মক তিনি বিলক্ষণ জানেন। আইপিএল নক্ষত্রদের মধ্যে গণ্য হন এমন সিনিয়র কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারকে সম্প্রতি তাঁর বন্ধু বলেছে, আইপিএল এসে গেল, তোদের কী মজা? কোনও টেনশন নেই। জাস্ট এনজয় করবি। খাবি-দাবি। খেলবি।

ক্রিকেটারটি এ দিন পুণে ম্যারিয়টের কফিশপে বসে বলছিলেন, ‘‘কী করে লোককে বোঝাব যে এটা বোধহয় আরও বেশি টেনশনের। প্রতি মুহূর্তে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে জবাবদিহির দায় থাকে। লোকে দেখে ডিজে আর চিয়ারলিডার। আমরা জানি ওটা স্রেফ মোড়ক। হাড়ে হাড়ে বুঝি, পারফর্ম না করতে পারলে ভেতর ভেতর কী হয়।’’

রোববার রাতের রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ডাকা দু’টো ওয়াইড নিয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে জোর তর্ক জুড়তে দেখে সকালের আলোচনাটা মনে পড়ে গেল। দু’টো ওয়াইড ডাকা নিয়ে ধোনিকে এত মুখর হতে দেশজ ক্রিকেটেও কেউ দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু এটা কঠিন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। যেখানে এক ভারতীয় ক্রিকেটারের ভাষায়, ম্যাচ হেরে ডাগআউট থেকে বেরনোর সময় মালিক যদি বা সামনে না দাঁড়িয়ে থাকে, মালিকের ছেলে বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবধারিত একটা বিষ চাহনি নিয়ে ওয়েট করবে।

হয়তো আইপিএলের কঠিন রণভূমি একমাত্র কারণ নয়। আরও কিছু আঙ্গিক রোববার ম্যাচে জুড়েছিল। নইলে ধোনিকে স্কোয়ার লেগের পিছনে গিয়ে বল তাড়া করতে দেখব কেন? কিপার উঁচু ক্যাচ ধাওয়া করে স্কোয়ার লেগে যেতে পারে। উইকেটের পিছনে দু’টো ফিল্ডার রেখে নিজে কেন এত দৌড়বে?

দেখতে হচ্ছে টেল এন্ডারের ছক্কায় ম্যাচ হাতছাড়া।

আসলে কেকেআর ম্যাচ বাজিরাও মহেন্দ্রর কাছে এক মর্যাদার লড়াই ছিল। যার চাপে তাঁর এস্কিমোদের মতো মস্তিষ্ককেও বারবার অস্থির দেখাল। এমন দিন যখন ঢিকির-ঢিকির করে রান উঠছে। এক থেকে তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের মধ্যে কারও স্ট্রাইক রেট ১১০ পেরোয়নি, সে দিনও তিনি ব্যাট করতে এলেন ১৭ ওভারে। পুণে প্রেসিডেন্টস লাউঞ্জে দেখলাম, তিন নম্বর উইকেটটা পড়তেই উঠে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালেন সঞ্জীব গোয়েন্কা। ওখানে দাঁড়িয়ে ডাগআউট দেখা যায়। বোঝা গেল টিম মালিক টেনশনে। ১২ ওভারে মাত্র ৮০ হয়েছে। এই সময় তিনি হেলিকপ্টারে উড়তে চান।

কিন্তু কোথায় ধোনি? এলেন থিসারা পেরিরা। আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল পনেরো ওভারে। এ বার এলেন অ্যালবি মর্কেল। টুর্নামেন্টে এই প্রথম ম্যাচ খেলছেন মর্কেল। তা-ও স্লো ব্যাটিং ট্র্যাক। বল করছে ভারতীয় স্পিনার। এই সময় ধোনি নিজে না নেমে মর্কেল? পুণে মালিক যিনি একটু আগে বলছিলেন, এটিকে ম্যাচের চেয়ে আইপিএলে টেনশন ঢের বেশি হচ্ছে, তিনি এ বার হতাশ ভাবে বসে পড়লেন। একটু দূরে ধোনি-পত্নী সাক্ষী। যিনি সারাক্ষণ লাংগস ফাটিয়ে অজিঙ্কদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে যাচ্ছেন, ‘মারো মারো মারো’। তিনি সাময়িক নির্বাক।

ধোনি এলেন কিছু পরে যখন ইনিংস শেষ হতে গোটা ২০ বল বাকি। দুর্বোধ্যতম সিদ্ধান্ত। অথচ ১১ বলে ২৩ অপরাজিত থাকলেন আর মর্নি মর্কেলকে ইয়র্কারে একটা বাউন্ডারি মারলেন যা দেখার জন্য পুণে শহর থেকে স্টেডিয়াম অবধি হাঁটা যায়। পুণে লাউঞ্জে অবশ্য বিভ্রান্তিটা থেকেই গেল— ভাই আপ আগে কিউ নহি আয়ে?

কিন্তু সমপরিমাণের বিস্ময় তো ধোনি নামার পরেও। তিনি না হয় পেশোয়া। কিন্তু পেশোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী সেনাপতিকে ভুলে গেলে হবে? তিনি গৌতম গম্ভীরও তুখোড় টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। চমৎকার সব ফিল্ড প্লেসিং করেন এই ধরনের ক্রিকেটে। চাপ রাখেন বারবার বোলার বদলে। কিন্তু আজ এটা কি শুধুই ফিল্ড সাজানো ছিল নাকি একটা সরব বিবৃতিও দেওয়া? যে দ্যাখ, আক্রমণ কাকে বলে। বাদ দিয়েছিলি তো দ্যাখ, তাচ্ছিল্য কাকে বলে।

তিনি এমএস ধোনি এই পর্যায়ের ক্রিকেটে গ্যারি সোবার্স! নেমে প্রথম ফিল্ড পেলেন সিলি মিড অফ, ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ আর স্লিপ। এ তো ফিল্ড প্লেসিং নয়, স্লেজিং। স্টিভ ওয় ইডেন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে যা করেছিলেন সৌরভকে। অফসাইডে কিপার থেকে পয়েন্টে আট জন। ও দিকটা শুধু মিড উইকেট। সৌরভ অবাক হয়ে গার্ড নেওয়ার সময় স্টিভ নাকি পিছন থেকে বলেছিলেন, সান, আর ছ’মাস বাকি তোমার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে। যাও এনজয় করো।

সিএসকে-র ধোনি এ সব অসম্মান জীবনে দেখেননি। চেন্নাই ফ্র্যাঞ্চাইজিতে তাঁর পাশে যে অনেকে ছিল। তখন তিনি ছিলেন বার্সার মেসি। পুণে-তে যেন আর্জেন্তিনার মেসি। একে নিজের ক্যাপ্টেন্সির মান অনেক পড়ে গিয়েছে। প্লাস পাশে সেই লোকগুলো নেই। রায়না, জাডেজা, ব্র্যাভো।

আজকের পর পুণে টানা চার ম্যাচ হেরে সেমিফাইনালের লড়াইয়ে আরও পিছিয়ে গেল। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো তাদের হারের দিনে কি না আবার দুর্ধর্ষ ম্যাচ জিতল তাদেরই মতো নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি গুজরাত লায়ন্স। একটা নতুন টিম ক্রমশ ওপরে উঠছে, অন্য নতুন টিম নীচে নামছে। এর পর ধোনিকে সরাসরি প্রশ্ন না শুনতে হলেও কোচ স্টিভন ফ্লেমিংকে ডেকে পাঠানো উচিত মালিকপক্ষর। জিজ্ঞেস করা উচিত, এটা কী স্ট্র্যাটেজি যে তোমার ক্যাপ্টেন টিমের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি প্লেয়ার হয়েও শুধু ১৮/২০ বল খেলবে?

আইপিএল ইতিহাস বলে টুর্নামেন্ট প্রথমার্ধে টানা চার ম্যাচ হেরেও পুনর্ভ্যূদয় সম্ভব। কিন্তু আজকের দিনে পেশোয়া বাজিরাওয়ের মতোই ট্র্যাজিক দেখাচ্ছে ধোনিকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় থেকেই তিনি পরের পর এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যার ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

কে বলতে পারে, বাকি আইপিএল মরসুম এমন চললে কঠিন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট কী বার্তা নিয়ে অপেক্ষা করবে তাঁর জন্য? মনে রাখতে হবে, এরা হলুদ জার্সি পরে না। এদের নাম সিএসকে নয়। এর মালিক কোনও নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নন!

সংক্ষিপ্ত স্কোর: রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস ১৬০-৫ (রাহানে ৬৭, ধোনি ২৩ ন.আ.)। কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৯.৩ ওভারে ১৬২-৮ (সূর্যকুমার ৬০, ইউসুফ ৩৬। ভাটিয়া ২-১৯)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন