ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল রবিচন্দ্রন অশ্বিনের একটা বল

প্রখ্যাত ক্রিকেট-লিখিয়ে সিএলআর জেমস টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাখ্যায় অসামান্য একটা কথা লিখেছিলেন। ক্রিকেট-পূজারী যদিও তিনি একা নন। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বিখ্যাত, বিভিন্ন ভাবে ক্রিকেটের রূপ-রস-মোহ-অনিশ্চয়তা ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কানপুর শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১১
Share:

অশ্বিনের সেই ম্যাজিক বলে আউট কেন উইলিয়ামসন। ছবি: এএফপি।

ভারত ৩১৮ ও ১৫৯-১নিউজিল্যান্ড ২৬২

Advertisement

প্রখ্যাত ক্রিকেট-লিখিয়ে সিএলআর জেমস টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাখ্যায় অসামান্য একটা কথা লিখেছিলেন। ক্রিকেট-পূজারী যদিও তিনি একা নন। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বিখ্যাত, বিভিন্ন ভাবে ক্রিকেটের রূপ-রস-মোহ-অনিশ্চয়তা ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। কিন্তু সিএলআর জেমসের বর্ণনাটা বোধহয় একটু স্বতন্ত্র, কিছুটা আলাদা।

ক্রিকেট ইজ ফার্স্ট অ্যান্ড ফরমোস্ট আ ড্রামাটিক স্পেক্টাক্যাল। ইট বিংলস উইথ থিয়েটার, ব্যালে, অপেরা অ্যান্ড দ্য ডান্স!

Advertisement

শনিবারের গ্রিন পার্কে বসে ভারতের ঐতিহাসিক টেস্টের অকল্পনীয় মোচড় দেখতে দেখতে কারও যদি সিএলআর জেমস মনে পড়ে যায়, দোষ দেওয়া যাবে না। একটা টেস্ট ম্যাচ, যেখানে কি না দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত একটা টিমকে চরম মূমূর্ষ দেখাচ্ছিল, যে টিমটা পাঁচটার মধ্যে চারটে সেশনেই চূর্ণ হয়ে বসেছিল, তারাই কি না চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছে! পাঁচশোতম টেস্ট জয়ের সুখস্বপ্ন দেখাচ্ছে কি না পাঁচ দিনেরও কম সময়ে। থিয়েটার, অপেরা, ব্যালে, ডান্স সব জুড়ে সমগ্র যে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়, এ তো এক কথায় তাই!

কোহালি, বিরাট কোহালির ভারতের কথা হচ্ছে।

এবং সমগ্রতার ভেতরে আলাদা-আলাদা থিয়েটার, ব্যালে, অপেরার মুগ্ধতা খুঁজতে যান, তা-ও পাবেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের যে স্বপ্নের ডেলিভারিটা কেন উইলিয়ামসনকে স্তম্ভিত করে ছেড়ে দিল, তার মধ্যে ব্যালের রোম্যান্স নেই? বা চেতেশ্বর পূজারা-মুরলী বিজয় যে ধ্রুপদী ব্যাটিং করে ভারতকে স্বপ্নের জয়ের মোহনায় এনে ফেললেন, তার সৌন্দর্য কি অপেরার চেয়ে কম কিছু? কিংবা তৃতীয় দিনের প্রথম সাড়ে তিন ঘণ্টায় যে মহানাটক সম্পন্ন হল গ্রিন পার্ক বাইশ গজে, তার মোচড় তো থিয়েটার-সম। মঞ্চে অভিনীত হলে বিশ্বাসযোগ্য লাগে, বাস্তবে নয়।

সহজ কথাটা সোজাসুজি এখানে বলে দেওয়া ভাল। ভারত ন’উইকেট হাতে রেখে পাঁচশোতম টেস্টে এখনই ২১৫ রানের লিড নিয়ে বসে! বাকি এখনও পরিপূর্ণ দু’টো দিন। ফের যদি তোলপাড় ফেলা কিছু ম্যাচের চতুর্থ এবং পঞ্চম দিনে ঘটে যায়, আলাদা কথা। নইলে পাঁচশোতম টেস্ট জিতে বিরাট কোহালিদের গ্রিন পার্ক ছাড়া উচিত। প্রশ্ন দু’টো। এক, আবহাওয়া। কানপুরের আগামী দু’দিনের যা আবহাওয়া পূর্বাভাস, তাতে দু’দিনই নাকি দফায় দফায় বৃষ্টি হতে পারে। সেটা যদি হয়, তা হলে দ্বিতীয় এবং মোক্ষম প্রশ্নটা পিছু-পিছু আসবে।

কোহালি ডিক্লেয়ার করবেন কখন?

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কিন্তু জামাইকা টেস্টে এই ডিক্লেয়ারশনের টাইমিংয়ে ডুবেছিল ভারত। বৃষ্টি সে বারও আক্রমণ করেছিল টেস্টকে। এবং বৃষ্টি এবং কোহালির দেরিতে ডিক্লেয়ারেশনের সুবিধে নিয়ে রস্টন চেজ সেঞ্চুরি করে ম্যাচ বাঁচিয়ে দিয়ে চলে যান। এ দিন ভারত প্রায় ওভার পিছু সাড়ে তিন গড় রেখে দিনের খেলা শেষ করেছে। চেতেশ্বর পূজারা পর্যন্ত একটা সময় প্রায় একশোর কাছাকাছি স্ট্রাইক রেট রেখে কিউয়ি-নিধন করে গিয়েছেন। সেই হিসেবে চললে, রবিবার চা-বিরতিতে ছেড়ে দেওয়া ভাল। চারশো রানের লিড কিন্তু গ্রিন পার্কের ফোর্থ বা ফিফথ ডে উইকেটের জন্য যথেষ্ট। উইকেটে এ দিন ভাল টার্ন ধরতে শুরু করেছে। কোনও কোনওটা এমন ঘুরছে যে, ব্যাটসম্যানের পক্ষে তার দাওয়াই বার করা প্রায় দুঃসাধ্য দাঁড়াচ্ছে। ডিক্লেয়ারেশনটা কখন হয়, দ্রষ্টব্য এখন শুধু সেটা।

কোহালি কী করবেন, কত রানের লিড নিয়ে ছাড়বেন, সময় বলবে। কিন্তু একটা কথা এখনই লিখে ফেলা যায় যে, দেড়খানা সেশন নয়, রবীন্দ্র জাডেজাও নন, কানপুর টেস্ট ভারতের দিকে ঘুরিয়ে দিল গেল স্রেফ একটা বল।

রবিচন্দ্রন অশ্বিনের করা একটা ডেলিভারি।

কেন উইলিয়ামসন সম্ভবত আজীবন ডেলিভারিটা মনে রাখবেন। মাইক গ্যাটিংকে করা শেন ওয়ার্নের ডেলিভারিটা যদি ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে বিবেচ্য হয়, শনিবার অশ্বিনেরটা তা হলে ‘বল অব দ্য ফাইভ হান্ড্রেথ টেস্ট ম্যাচ।’ পরে সাংবাদিক সম্মেলনে নিউজিল্যান্ড উইকেটকিপার ওয়াটলিংকে তা বলাতে তিনি মেনেও নিলেন। অশ্বিনের বলটা পড়েছিল সিক্সথ স্টাম্প লাইনে, শর্ট অব গুড লেংথে। উইলিয়ামসন ব্যাকফুটে কভারের দিকে পাঞ্চ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে, অভাবনীয় টার্নে বলটা মিডল স্টাম্প নড়িয়ে দিয়েছে! ভুল হল একটু। অশ্বিনের বলটা আসলে গোটা নিউজিল্যান্ড টিমের বিশ্বাসের শালগ্রামশিলাটাকেই নড়িয়ে চলে গেল!

উইলিয়ামসনের টিম যে স্পিন অতীব জঘন্য খেলে, এটা লেখা যাবে না। আমিরশাহিতে পাকিস্তানি স্পিন তারা সামলে এসেছে। কিন্তু স্বয়ং নৃপতিরই যদি ও রকম বেআব্রু দশা হয়, পদাতিকদের হৃদয়ে কাঁপুনি তো ধরবেই। কে না জানে, নিউজিল্যান্ডের সেরা স্পিন খেলিয়ে ব্যাটসম্যানের নামই হল উইলিয়ামসন। তার উপর তৃতীয় দিনের পিচে টার্ন ধরায়, জাডেজার বলগুলো মোটামুটি দুর্বোধ্য হয়ে গেল। একদিকে জাডেজা, উল্টো দিক থেকে অশ্বিন— দু’জন মিলে সফরকারী টিমের সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। অশ্বিনের মাঝে এক বার মধ্যমায় লাগল। কিছুটা রক্তও বেরোল। কিন্তু তাতে একচুলও টার্ন পাওয়া কমেনি। সত্যি, তিনি নমস্য স্পিন-কুশীলব বটে।

একটা কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে, তার মৃদু আন্দাজ অবশ্য এ দিন সকালে পাওয়া গিয়েছিল। দিনের খেলা তখনও শুরু হয়নি। আচমকা দেখা যায়, পিচের ধারে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন ভারতীয় কোচ অনিল কুম্বলে। সঙ্গে অশ্বিন-জাডেজা। দূর থেকে এটুকু বোঝা গেল, কিছু একটা আলোচনা চলছে। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে জাডেজা বললেন যে, তাঁকে উইকেটের ‘রাফ’গুলো দেখে রাখতে বলেছিলেন কুম্বলে। সঙ্গে বলেছিলেন যে, অফস্টাম্পের আশেপাশে প্রচুর ফুটমার্কস তৈরি হয়ে আছে। ব্যাটসম্যানের মনে যা ভাল রকম ভীতি ছড়াবে। তাঁকে শুধু একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গলে বলগুলো রাখতে হবে। আর আসতে হবে ওয়াইড অব দ্য ক্রিজ।

কুম্বলের মতো মগজাস্ত্র এ সব ধরবেন না তো কে ধরবে? কিন্তু তাতে যে এমন ব্যাটিং-মড়কে আক্রান্ত হয়ে যাবে নিউজিল্যান্ড, ভাবা যায়নি। ২৫৫-৫ থেকে ২৬২-তে টিমটা যে অলআউট হয়ে যাবে, কষ্টার্জিত কল্পনাতেও আসে কি? দশ বলে কি না নিউজিল্যান্ডের শেষ চার-চারটে উইকেট তুলে নিল ভারত। জাডেজা এক ওভারে পেলেন তিনটে! তিনি তো হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।

জাডেজার পাঁচ, অশ্বিনের চার, বিজয়-পূজারার দাপুটে ব্যাটিং সব মিলেজুলে ভারত তার ঐতিহাসিক পাঁচশোতম টেস্ট জয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রার্থনার সংখ্যা এক এবং একমাত্র। বৃষ্টিটা স্রেফ টেস্ট-আকাশ থেকে দূরে থাকুক। দু’টো দিনের জন্য দূরে থাকুক।

গ্রিন পার্কের সুপার-সপারগুলো প্রয়োজনের সময় মাঠে নামে না যে। গোটা দিন ওখানে শুধু চাঁদোয়া টাঙিয়ে মাঠকর্মীদের চায়ের পার্টি চলে!

নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১৫২-১): ল্যাথাম এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৫৮, উইলিয়ামসন বো অশ্বিন ৭৫, টেলর এলবিডব্লিউ জাডেজা ০, রঞ্চি এলবিডব্লিউ জাডেজা ৩৮, স্যান্টনার ক সাহা বো অশ্বিন ৩২, ওয়াটলিং ক ও বো অশ্বিন ২১, ক্রেগ এলবিডব্লিউ জাডেজা ২, সোধি এলবিডব্লিউ জাডেজা ০, বোল্ট ক রোহিত বো জাডেজা ০, ওয়াগনার ন.আ ০, অতিরিক্ত ১৫, মোট ২৬২। পতন: ৩৫, ১৫৯, ১৬০, ১৭০, ২১৯, ২৫৫, ২৫৮, ২৫৮, ২৫৮, ২৬২। বোলিং: শামি ১১-১-৩৫-০, উমেশ ১৫-৫-৩৩-১, জাডেজা ৩৪-৭-৭৩-৫, অশ্বিন ৩০.৫-৭-৯৩-৪, বিজয় ৪-০-১০-০, রোহিত ১-০-৫-০।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস: রাহুল ক টেলর বো সোধি ৩৮, বিজয় ৬৪ ন.আ ৬৪, পূজারা ন.আ ৫০, অতিরিক্ত ৭, মোট ১৫৯। পতন: ৫২। বোলিং: বোল্ট ৫-০-১১-০, স্যান্টনার ১৩-৫-৩৩-০, ক্রেগ ১১-১-৪৮-০, ওয়াগনার ৮-৩-১৭-০, সোধি ৭-২-২৯-১, গাপ্তিল ৩-০-১৪-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন