লিগের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে মহমেডান

বেঞ্চে বসা র‌্যান্টির ছটফটানিটাই এ বার আমার দলের রসায়ন

টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচের আগে যখন ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে হাঁটছি, আমার মনে আঠাশ বছর আগের একঝাঁক স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল। সে দিনের সেই অন্ধকারের মধ্যেও শেষমেশ আলোর সন্ধান পেয়েছিলাম দু’টি মানুষের জন্য।

Advertisement

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচের আগে যখন ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে হাঁটছি, আমার মনে আঠাশ বছর আগের একঝাঁক স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল। সে দিনের সেই অন্ধকারের মধ্যেও শেষমেশ আলোর সন্ধান পেয়েছিলাম দু’টি মানুষের জন্য। যাঁরা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। প্রয়াত জীবনদা আর পল্টুদা।

Advertisement

বছরটা ১৯৮৭। আমি তখন ইস্টবেঙ্গলে চুটিয়ে খেলছি। সে রকম সময় এক বাইক দুর্ঘটনায় আমার ফুটবলার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভরা মরসুমে আমার ঠিকানা হয়েছিল হাসপাতালের বেড। গোটা সিজন খেলতে পারিনি। তা সত্ত্বেও পল্টুদা আর জীবনদা আমার চিকিৎসার সব খরচ দিয়েছিলেন। মানসিক ভাবেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন।

আসলে ইস্টবেঙ্গল থেকে অনেক কিছুই পেয়েছি আমি। শনিবার সেই দলের কোচ হিসেবে প্রথম বার বেঞ্চে বসে তাই মনে হচ্ছিল, এ বারই তো আমার এই ক্লাবকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পালা।

Advertisement

একই সঙ্গে কোথাও একটু টেনশনও ছিল। টালিগঞ্জ ভাল টিম। আগের মরসুমে ইস্টবেঙ্গলে খেলে যাওয়া বেশ কয়েক জন ফুটবলার রয়েছে ওদের টিমে। যারা বেশ ভাল প্লেয়ার। তার উপর আবার একটা সংস্কারও নিজের মনের ভেতর খোঁচা দিচ্ছিল। অতীতে মোহনবাগান কোচ হিসেবে প্রথম ম্যাচেই পোর্ট ট্রাস্টের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। একটু হলেও মনে হচ্ছিল, এ বার সেটা ভাঙতে পারব তো!

মাঠে উপচে পড়া ভিড়। হাজার হাজার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের প্রত্যাশা ঘিরে রয়েছে আমাকে। ফুটবলার জীবনে এ রকম প্রত্যাশা অনেক বার পূরণ করেছি। কখনও আবার ব্যর্থও হয়েছি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কোচ হিসেবে প্রথম ম্যাচে সফল হওয়াটা আমার কাছে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছিল।

টিমে এখনও আরও বোঝাপড়া তৈরি করা দরকার। ফুটবলারদের আরও ফিট করে তুলতে হবে। কোরিয়ান ফুটবলার ডু ডং প্রথম দিন হয়তো একটু বেশি মাথা গরম করেছে। বল বেশিক্ষণ পায়ে রেখেছে। প্রহ্লাদ, জিতেন মুর্মুর মতো জুনিয়রদের আরও পরিণত করে তোলাও দরকার।

তবে এটাও বলছি, প্রথম ম্যাচের মতো গোলের সুযোগগুলো আর নষ্ট হবে না এর পর। শনিবার টালিগঞ্জ ম্যাচে যেমনটা হয়েছে। ফুটবলে অবশ্য ম্যাচ খেলতে খেলতেই এই সব সমস্যা সাধারণত ঠিক হয়ে যায়। তবে আমার ছেলেদের ভেতর যে আগ্রাসী মানসিকতা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, সেটা প্রথম ম্যাচেই তাদের মধ্যে দেখতে পেয়ে বেশ ভাল লাগছে।

একটা উদাহরণ দিই এখানে। যে র‌্যান্টি দু’দিন আগেও পুরো ফিট নয় বলে লিগের প্রথম ম্যাচের আঠারো জনের টিমেও থাকতে রাজি ছিল না, শনিবার বেঞ্চে তাকেই দেখলাম ইস্টবেঙ্গল যখন গোল পাচ্ছে না, মাঠে নামার জন্য ছটফট করছে। আমি কিছু বলাটলার আগেই বুট পরে তৈরি! প্রথমে ঠিক করেছিলাম, শেষ পঁচিশ মিনিট র‌্যান্টিকে খেলাব। কিন্তু সেকেন্ড হাফে ওর ছটফটানি দেখে পঁয়ত্রিশ মিনিট আগেই নামিয়ে দিই।

র‌্যান্টির এই ছটফটানিই আমার টিমের কেমিস্ট্রি। ফুটবলার জীবনে আমরাও তো এ রকমই ছটফট করতাম দলকে জেতানোর জন্য। তাই র‌্যান্টিদের এই মানসিকতা বুঝতে আমার এতটুকু সমস্যা হয়নি।

বেলোকে প্রথম ম্যাচে কেন নামালাম না? টালিগঞ্জ ম্যাচের পর এই প্রশ্ন আমাকে অনেকে করেছেন। আসলে আমার মনে হয়েছিল, দীপক আর অর্ণবের মধ্যে একটা ভাল বোঝাপড়া আছে। সেখানে বেলো সবে ইস্টবেঙ্গলে এসেছে। কয়েক দিন মাত্র টিমের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছে। আমার দলের খেলার টাইপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ওর আরও একটু সময় লাগবে। তা ছাড়া শনিবারের ম্যাচে টালিগঞ্জ এমন কিছু অ্যাটাকও করেনি, যার জন্য আমাকে বেলোকে নামাতেই হত।

বরং আমার দেখার ইচ্ছে ছিল উল্টো দিকের ডিফেন্সে উগা ওপারাকে— চোট সারিয়ে কতটা ফিট হয়ে উঠতে পেরেছে। এক জন ফুটবলারের জীবনে চোট যে কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে সেটা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে! তবে বলতেই হচ্ছে, আগের উগাকে কিন্তু খুঁজে পেলাম না।

আমাদের পরের ম্যাচ এরিয়ানের সঙ্গে। আরও একটা কঠিন ম্যাচ হবে মঙ্গলবার। ময়দানে এরিয়ানের মতো বড় গাঁট খুব কমই আছে। তা ছাড়া ওরাও তো ইস্টবেঙ্গল মাঠে খেলেই অভ্যস্ত। তবে মনে হচ্ছে, এ বার লিগের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে মহমেডান।

রবিবার দশ জন হয়ে যাওয়ার পরেও ওরা যে ভাবে মোহনবাগানের মতো আই লিগ চ্যাম্পিয়নকে আটকে দিল, তাতে অন্য দলগুলো ওদের সমীহ করতে বাধ্য। আমি তো বলব মৃদুল (মহমেডান কোচ) খুব সুন্দর ভাবে সঞ্জয়ের সব স্ট্র্যাটেজি ঘেঁটে দিয়েছে। তবে মোহনবাগান অনেক গোলের সুযোগও নষ্ট করেছে। কিন্তু ফুটবলে এই অজুহাত চলে না। দিনের শেষে স্কোরলাইনটাই আসল।

নিজের টিমের কথায় আবার ফিরে আসি। জানি না টানা ছ’বার লিগ জিতে সত্তরের দশকের সেই মহাগৌরব ছুঁতে পারব কি না! যদি পারি তবে আমার আঠাশ বছর আগের যন্ত্রণায় কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়বে। জীবনদা-পল্টুদা আমার জন্য যা করেছিলেন তার প্রতিদানে সামান্য কিছু হলেও ফিরিয়ে দিতে পারব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন