রিভার্স সুইংয়ের আবিষ্কর্তা সরফরাজ নওয়াজ
প্রশ্ন: ভারতীয় পেস বোলিংয়ের উত্থান দেখে কী বলবেন?
সরফরাজ নওয়াজ: আমার মনে হচ্ছে, ভারতের হাতে এখন পেস বোলিং নিয়ে অনেক পছন্দ এসে গিয়েছে। অনেক ভাল পেস বোলার একসঙ্গে এসে গিয়েছে। কোনও বোলার আর তার জায়গা পাকা বলে ধরে নিতে পারছে না। প্রত্যেককে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ব্যর্থ হলেই তার জায়গা নেওয়ার জন্য আরও দশ জন ভাল পেসার দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সময়ে ভারতীয় বোলিং বলতে ছিল স্পিন আর তার সঙ্গে এক জন বা দু’জন ভাল জোরে বোলার। তারাই শুধু খেলে যেত। এখনকার ভারতীয় পেসারেরা ইংল্যান্ডে এসে ইংল্যান্ডের পেসারদের চেয়েও বেশি জোরে বল করছে। ওদের চেয়ে বেশি সুইং করাচ্ছে।
প্র: ভারতের এই স্পিন থেকে পেস-নির্ভর বোলিং আক্রমণে রূপান্তরের কারণ কী মনে হয়?
সরফরাজ: রিভার্স সুইংয়ের আবিষ্কার। আগে ক্যাপ্টেন বা কোচ বা নির্বাচক কারও এই অস্ত্রটার কথা জানা ছিল না। নতুন বলেই শুধু বল সুইং করত আর পুরনো বলের উপরে একচেটিয়া অধিকার ছিল স্পিনারদেরই। যবে থেকে রিভার্স সুইং আবিষ্কার হল, পুরনো বলেও জোরে বোলারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এখন পুরনো বলে জোরে বোলাররাও অনেক উইকেট তোলে। পাকিস্তানে ওয়াসিম আক্রম-ওয়াকার ইউনিসরা যখন খেলত, অনেক ম্যাচে প্রতিপক্ষের স্কোর হয়তো শুরুতে ১০০-২। সেখান থেকে বল রিভার্স সুইংয়ে তারা ২০০ অলআউট!
প্র: অধিনায়ক এখন পুরনো বলে স্পিনের সঙ্গে রিভার্স সুইংও খোঁজেন?
সরফরাজ: একদমই তাই। ভারত, পাকিস্তান বা উপমহাদেশে যে স্পিনাররা এত দিন ধরে রাজ করেছে, সেখানে ঘাসহীন, এবড়োখেবড়ো মাঠে আরও বেশি করে রিভার্স সুইং হয়। তাই স্পিনারের মতোই ম্যাচ জেতাতে পারে রিভার্স সুইং হাতে থাকা ভাল পেসার। আমার মনে হয়, ভারতেও এই বদলের প্রভাব পড়েছে। পুরনো বল এখন আর ফাস্ট বোলারের আতঙ্ক নয়, সেটা হাতে পেয়ে সে আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে।
বুমরার হুঙ্কার। ছবি: রয়টার্স।
প্র: ভারতীয় পেসারদের নিয়ে আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে হলে কী বলবেন? প্রথমে যশপ্রীত বুমরা।
সরফরাজ: বুমরা বেশ তফাত করে দিচ্ছে এই সিরিজে। কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে শুধু বলতে চাই। বুমরাকে দেখছিলাম অফস্টাম্পের অনেক বাইরে বাইরে করছে। আরও বেশি করে ব্যাটসম্যানকে খেলানোর চেষ্টা করলে চাপ বাড়তে পারত ইংল্যান্ডের উপরে। সুইং কী রকম পাচ্ছি, সেটা বুঝে এক জন পেসারকে ক্রিজটাকেও ব্যবহার করতে জানতে হয়। বুমরাকে সেটা শিখতে হবে। শুধু ক্রিজের কোণ থেকে বল করলেই হবে না, স্টাম্প ঘেঁষে বল করাটাও শিখতে হবে। সুইং কতটা পাচ্ছি, সেটা বুঝে ঠিক করতে হয়, ওভার দ্য উইকেট যাব না রাউন্ড দ্য উইকেট। আমি বলব, আরও বেশি গভীরে গিয়ে ভাবুক বোলিং নিয়ে।
প্র: এ বার ইশান্ত শর্মা...
সরফরাজ: শর্মাকে তো আমি দিল্লিতে কোচিং করিয়েছি। আমি তখন দিল্লিতে কোচিং করতে গিয়েছিলাম। ও অনূর্ধ্ব উনিশ বিভাগে ছিল। তখন দিল্লিতে ছিল না। বাইরে কোথাও ছিল। সেখান থেকে ডেকে আনা হয় ক্যাম্পে। আমি রান-আপ আর ক্রিজের ব্যবহার নিয়েই ওকে বেশি বুঝিয়েছিলাম। তবে একটা কথা বলব। শর্মা অনেক উন্নতি করেছে।
প্র: হার্দিক পাণ্ড্য...
সরফরাজ: ট্রেন্ট ব্রিজে খুব ভাল বল করেছে। ওর সেই ভিডিয়োটা বার বার দেখা উচিত। বোঝা দরকার কেন ট্রেন্ট ব্রিজে প্রথম ইনিংসে ও পাঁচ উইকেট পেয়েছিল? কারণ, ও উপরে বল করেছিল। ইংল্যান্ডে বেশি জোর লাগিয়ে বল করার চেয়েও দরকার হচ্ছে বলটাকে যতটা সম্ভব বেশি বাতাস দেওয়া। জোর লাগিয়ে বল করার চেয়েও ঠিক জায়গায় রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাতে ব্যাটসম্যান সুইংটা খেলতে বাধ্য হয় আর ভুলটা করে। বলের গতিকে আমি কমিয়ে ফেলতে বলছি না, সেটা থাকুক। কিন্তু ট্রেন্ট ব্রিজে যে ছেলেটা এত সুন্দর সুইং করাল, সে যদি সুইংটাকে ব্যবহার করে, আরও ফল পাবে।
দাপট: শেষ মুহূর্তে রশিদকে ফিরিয়ে লড়াইয়ে রাখলেন শামি। ছবি: এএফপি।
প্র: মহম্মদ শামি...
সরফরাজ: খুব ভাল বোলার। গতি আছে, সিমের অবস্থান দারুণ। যে কোনও জায়গায় সুইং পেতে পারে। দারুণ সব ডেলিভারি বেরোয় ওর হাত থেকে। তবে শামি যদি ফিটনেস নিয়ে খাটে, আরও উন্নতি হবে ওর বোলিংয়ে। আমার মনে হয়েছে, ওর শরীরটা একটু ভারী। সেটা ঠিক করতে পারলে কোমরটা আরও বাঁকাতে পারবে। আরও তীক্ষ্ণ হতে পারে ওর গতি আর সুইং।
প্র: আপনার সময় ভারতের কোনও পেসারকে দেখেছেন, যাঁর বলে ভাল গতি ছিল?
সরফরাজ: আমার সময় তো কপিল দেবই ছিল। দিল্লিতে এক বার বেনিফিট ম্যাচ খেলেছিলাম, সেখানে একটা ছেলে বেশ জোরে বল করছিল। নামটা ভুলে গিয়েছি। তবে কপিল দেবকে প্রথম দেখেই আমি বলে দিয়েছিলাম, এক দিন ভারতের সেরা বোলার হবে। এখন তো দেখছি আপনাদের দলে পেসারই বেশি খেলছে, স্পিনার এক জন। আগে বেশি স্পিনারই থাকত টিমে। এটা একটা বড় পরিবর্তন। তবে এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে আমি ভেবেছিলাম, ভারতই জিতবে। দু’টো ক্যাচ ফেলার বড় মূল্য চোকাতে হল।
প্র: রিভার্স সুইংয়ের আবিষ্কর্তা আপনি। এখনকার বোলারদের রিভার্স সুইং দেখে কী মনে হয়?
সরফরাজ: এখন তো সব দেশের পেসারই রিভার্স সুইং করানো শুরু করেছে। ইংল্যান্ডের বোলারেরাও করাচ্ছে দেখছি। ভারতের পেসাররাও ভাল রিভার্স সুইং করাতে পারে। ইংল্যান্ডে এই সিরিজে অনেক দিনই আকাশ মেঘলা ছিল। বৃষ্টিও হয়েছে। সেই কারণে বল পুরনো হতে সময় লেগেছে। খুব বেশি রিভার্স সুইং দেখা যায়নি। তবে সিরিজের শেষ ম্যাচ ওভালে। ওখানে কিন্তু বৃষ্টি না হলে বল তাড়াতাড়ি পুরনো হবে। ওভালে রিভার্স সুইং অস্ত্র হতে পারে।
প্র: আপনার সেই রিভার্স সুইং আবিষ্কারের কাহিনি শোনান...
সরফরাজ: ভারত আর পাকিস্তানের মাঠে অত ঘাস থাকে না। আমাদের সময়ে অনেক জায়গায় ম্যাটিং উইকেটও হত। বলের পালিশ তাড়াতাড়ি উঠে যেত। আমি হঠাৎই দেখেছিলাম, পুরনো বলে আউটসুইংয়ের মতো পালিশ রেখে দারুণ ইনকাটার হচ্ছে। তার পর নেটে ঢুকে ওই ভাবে এক দিকে পালিশ করে প্র্যাক্টিস করতে থাকি। দেখলাম, দারুণ মুভমেন্ট পাচ্ছি। তবে কাহিনি যা-ই হোক, খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বলটার এক দিকে চকচকে পালিশ রাখা। অন্য দিকটা ‘রাফ’ রাখতে হয়। সকলকে বলের যত্ন নিতে হয়। রিভার্স সুইং করতে গেলে টিমওয়ার্ক লাগে।
বিরাটের আর এক অস্ত্র ইশান্ত। ছবি: রয়টার্স।
প্র: ভারতীয় বোলিং কি এখন সব দেশে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে?
সরফরাজ: অবশ্যই পারবে। ইংল্যান্ডে আবহাওয়ার কারণে ওরা সুইং পাচ্ছে। যেখানে পাবে না, সেখানে রিভার্স করাতে পারে। আমি দেখেছি, ওরা রিভার্স করাতে পারে। প্রত্যেকের বলে গতিও আছে ভাল, তাই রিভার্স করিয়ে ফলও পাবে। স্পিনার হিসেবে অশ্বিন আছে। ভারতীয় বোলিংকে খেলা সহজ হবে না। তবে একটাই কথা মাথায় রেখো— বোলিংয়ে ধৈর্যই সেরা অস্ত্র।