শ্রদ্ধা ফেরাতে বিপক্ষকে মাঠে কাঁদাতে হবে ‘ক্রাই বেবি’-কে

দৃষ্টি আনমনে হেঁটে যায় যত দূর, নীল শুধু নীল। সাদা প্রমোদতরণী নীলের উপর ভেসে বেড়ায় নিজের ইচ্ছেমতো, খেয়ালি অ্যালবাট্রসের মতো।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

মার্সেই শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০৪:১৯
Share:

দৃষ্টি আনমনে হেঁটে যায় যত দূর, নীল শুধু নীল। সাদা প্রমোদতরণী নীলের উপর ভেসে বেড়ায় নিজের ইচ্ছেমতো, খেয়ালি অ্যালবাট্রসের মতো। বাঁ দিকে তাকালে বিবশ লাগে, পাহাড় না? খুব উঁচু নয়, তবু তো পাহাড়, আলগোছে ধরে আছে শহরটাকে, কোলে নিয়ে বসে স্তাদ ভেলোড্রোম। কত দেশ, কত প্রজাতির মানুষ শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে সমুদ্রতটে। আমাদের দেশের মতো গরম বালিতে নয়, নুড়ি পাথরে মোড়া এখানে। কয়েক পা হাঁটলে চোখে পড়ে এক-একটা শ্যাক, ছোট্ট বার, একটা বিয়ার নিয়ে অনায়াসে বিচ চেয়ারে গা এলিয়ে থাকা যায়। পরম শান্তিতে উপভোগ করা যায় সামনের ভূমধ্যসাগর, তার ঢেউয়ের পায়ে আদর করে চলে যাওয়া।

Advertisement

মেদেইরার সমুদ্র কি এমনই নীল? তার ঢেউও কি এ ভাবে পা ছুঁয়ে চলে যেত ‘ক্রাই বেবির’?

তটভূমির পিছনটাও বড় বেশি সুন্দর, ফুটবল-পূজারীর যোগ্য আরাধনার জায়গা। অত বড় জায়ান্টস্ক্রিনও হয়? একটা ফুটবল ম্যাচ ঘিরে এত আগে থাকতে পাগলামি দেখাতে পারে মানুষ? কত লোক ধরে এখানে? প্রশংসা শুনে নিরাপত্তারক্ষীর মুখ মুহূর্তে প্রসন্ন, টুকরো ইংরেজিতে সে বলে চলে, “বিগ...এইট্টি থাউজেন্ড...সি বিউটি...লুক স্কাই..।’ ঠিক, সুন্দর বটে। উপরের নীল আকাশের সঙ্গে মিশে যাওয়া নীল সমুদ্র, যুগ-যুগ ধরে খয়েরি রংয়ের গিরিশ্রেণীর দাঁড়িয়ে থাকা, ফুটবল-সৌন্দর্য ছাড়াও মুগ্ধতার দাবি রাখে। তার উপর ফুটবল, ফুটবল ফ্যান জোন। বিশাল এক চত্বর। যার গেম জোন আলাদা, ভিলেজ জোন আলাদা। গেম জোনে যেতে হলে ঢুকে ডান দিকে, ভিলেজ জোনে ঢুকতে গেলে বাঁ দিক। কত কিছু যে চলে ওখানে। অ্যানিমেশন প্লে। বিচ সকার। কনসার্ট। গত রাতে ন’টা নাগাদ তো এখানে ক্রিস্তোফ মে-র কনসার্ট ছিল। শোনা গেল, লোকও হয়েছিল প্রচুর।

Advertisement

বৃহস্পতিবার তাঁর আছে। রাত ন’টা থেকেই। শুধু হাতে গিটারের বদলে পায়ে ফুটবল। কিন্তু শো হিট হবে তো? রাতের আশি হাজার ফুটবল-পুণ্যস্নান করে যাবে তো এখানে, তাঁর অনন্য প্রতিভার বিচ্ছুরণে?

মেদেইরার যে অঞ্চলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো জন্মেছিলেন, তার সঙ্গে ফ্রান্সের বন্দর শহরের কতটা মিল, না দেখে বলা খুব মুশকিল। বিত্তে হবে না হয়তো, কিন্তু অপরূপ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে হলেও হতে পারে। অন্তত এখানকার প্রাডোর মতো মেদেইরার ফুচাল অঞ্চলেও সমুদ্র আছে, আছে শ্যাক। যার অজানা একটায় জন্মেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো। গরীব ছিলেন খুব, কিন্তু খাবারের কথা মনে পড়ত না একটা চর্মগোলক দেখলে। কত দিন যে খাবার ফেলে ঘরের জানালা দিয়ে পালিয়েছেন ছোট্ট ক্রিশ্চিয়ানো! লোকে ডাকত, ক্রাই বেবি। ফুটবল খেলতে না দিলে, সতীর্থরা তাঁর পাস থেকে গোল না করতে পারলে নাকি এতটাই কান্নাকাটি জুড়ে দিতেন।

আজ, মার্সেইয়ের স্তাদ ভেলোড্রোমে ফুটবল খেলার জন্য কান্নাকাটি করার কথা নয় রোনাল্ডোর। টিমের অধিনায়ক তিনি, ফুটবলও কেউ তাঁর পা থেকে কেড়ে নিচ্ছে না। কিন্তু কোনও কোনও মহল আশঙ্কা করছে যে, ক্রিশ্চিয়ানোকে হারের কান্না কাঁদতে হবে কি না? তারকাদের অভিশাপ-সপ্তাহ তো এখনও শেষ হয়নি। মেসি-অবসরের ধাক্কায় আর্জেন্তিনায় গণ-অবসর নিয়ে তোলপাড় চলছে। আগেরো, দি’মারিয়া, মাসচেরানো কেউ নাকি আর খেলবেন না। ইংল্যান্ডে বিদ্রূপের এক নম্বর চাঁদমারি হিসেবে ওয়েন রুনি গণ্য হচ্ছেন শুধু নয়। স্তাদ ভেলোড্রোমের বাইরে এক ইংরেজ সাংবাদিক বলে গেলেন যে, তাঁর দেশ এমন বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে এখন গর্বের ইপিএলকে দেখছে। জেমি কারাঘার নাকি বলে দিয়েছেন আমরা ভেবেছিলাম আমাদের দেশে পুরুষমানুষরা ফুটবলটা খেলে। এখন তো দেখছি শিশুরা খেলে!

পর্তুগালের ডিফেন্ডার জোসে ফন্তেকে এ দিন বিলেতের এক কাগজ ধরেছিল। ফন্তে যা বলেছেন, শুনলে পৃথিবীর সিআর-প্রেমীদের আশাবাদের পুনর্জাগরণ ঘটার কথা। আজ থেকে নয়, সেই তেরো বছর বয়স থেকে রোনাল্ডোকে দেখছেন ফন্তে। স্পোর্টিং লিসবনের সময় থেকে। “রোনাল্ডো সবাইকে বলত, ট্রেনিংয়ের পর স্নানের সময় তোমাদের থেকে আমি বেশি পুশ-আপ করব, দেখে নিও। আর ও সেটা করেও দেখাত,” বলে ফেলেছেন ফন্তে। ফন্তের মনে আছে, সতীর্থরা সবাই যখন বাড়ি চলে যেত, তখনও কী ভাবে নিজেকে ফিটনেস-শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তীব্র রগড়ানিতে ডুবিয়ে রাখতেন রোনাল্ডো। অগাধ ভরসায় ফন্তে তাই অক্লেশে বলে দিতে পারেন, রোনাল্ডোর উপর তিনি বিশ্বাস রাখেন। পর্তুগাল বিশ্বাস রাখে। পর্তুগাল ও তিনি স্বপ্ন দেখেন, রোনাল্ডো তাঁদের ইউরো দিচ্ছেন।

বলছেন বটে, কিন্তু পর্তুগাল সত্যি রাখে তো?

ভেলোড্রোমের বাইরে ইংরেজ সাংবাদিকের কথা আগেই লেখা হয়েছে। ভদ্রলোকের নাম স্যামি সাহমদ, বিয়েন স্পোর্টসের হয়ে কাজ করেন। ইউরো কভার করতে এসে পর্তুগালের বেশ কয়েকটা ম্যাচ করেছেন, ও দেশের সমর্থকদের সঙ্গেও কথা-টথা হয়েছে। বাইট-পর্ব মিটিয়ে বলছিলেন, “আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা যে একশো শতাংশ এই টিমটার উপর বিশ্বাস রাখে, তা নয়। বরং বলব অনেকেই মনে করে, এটা পর্তুগালের সেরা ফুটবল-প্রজন্ম নয়!”

শুনলে অবাক লাগতে পারে। ভাষা এক হলেও পর্তুগাল কোনও দিন অতীতের ব্রাজিল ছিল না। প্রজন্ম পিছু কখনও একটা মহাতারকা এসেছে, কখনও তা-ও নয়। একটা ইউসেবিও। একটা লুইস ফিগো। একটা রোনাল্ডো। কিন্তু ইউরোর এই টিমটা অতীতের অনেক পর্তুগালের চেয়ে ভাল, তাই তো এত দিন শোনানো হয়েছে। লেখালেখি হয়েছে। কোয়ারেসমা, জোয়াও মারিও, পেপে, রেনাতো স্যাঞ্চেজ, জোয়াও মুটিনহো, রোনাল্ডো, নানি এত প্রতিভা একসঙ্গে কখনও তো দেখা যায়নি। তার পরেও নয়? “বললাম তো। আসলে নানি বা রোনাল্ডো কেউ ওদের সেরা খেলাটা এখনও খেলতে পারেনি। তার উপর ডিফেন্স ভাল না, গোল খেয়ে যাচ্ছে। ভরসা লোকে রাখবে কী করে,” বলতে থাকেন ওই সাংবাদিক।

তাঁর থেকেই শুনলাম, রুনির ইংল্যান্ডে এখন নাকি ফুটবল-শুদ্ধকরণের ডাক দেওয়া হচ্ছে। ক্ষিপ্ত ভাবে বলা হচ্ছে, সব পাল্টাও। কোচ পাল্টাও। প্লেয়ার নির্বাচন পদ্ধতি পাল্টাও। সর্বাগ্রে পাল্টাও ইপিএল নিয়ে ইংল্যান্ড প্লেয়ারদের পড়ে থাকা। দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলা বন্ধ করো ওদের, দেশের প্লেয়ারদের ইপিএল খেলা বন্ধ করো। ওয়েন রুনিরা থাক শুধু দেশের জন্য, ক্লাবের জন্য নয়!

শুনলে আতঙ্ক লাগে। ভয় হয়, অভিশাপের সপ্তাহে পড়ে থাকা শেষ মহাতারকা নিয়ে। পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে, একই রকম অবাস্তব গর্জন ইংরেজির মতো পর্তুগিজেও উঠবে না তো? লোকে বলবে না তো, সব পাল্টাও, সিআরের দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলা বন্ধ করো? বলবে না তো যে, থামাও ওর রিয়াল মাদ্রিদে পড়ে থাকা। দেশের জার্সি পরছে, আবার ক্লাব খেলবে কী?

ফুটবল, শুধু ফুটবলের স্বার্থে আজ বোধহয় ভূমধ্যসাগরের নীলে পর্তুগালের লাল-মেরুনের মিশে যাওয়া দরকার। শুধু ফুটবলের স্বার্থে আজ জিনেদিন জিদানের শহরে পোলিশদের কাঁদিয়ে বেরনো দরকার পর্তুগালের ‘ক্রাই বেবি’-র!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন