ট্রফির লড়াইয়ের এক নম্বর চ্যালেঞ্জার সুনীল ছেত্রীদের বেঙ্গালুরুকে তাদের মাঠেই দুরমুশ।
টানা ছয় ম্যাচ অপরাজিত।
সনি, জেজে, কর্নেলরা দুরন্ত ফর্মে।
তবে কি আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গন্ধ পেতে শুরু করে দিল মোহনবাগান?
‘‘দিল্লি বহু দূর। সবে তো বর্ধমান পৌঁছলাম,’’ সনি-শিল্টনদের কোচের কথায় কিন্তু ট্রফি-গন্ধের ছিটেফোঁটা নেই। উল্টে বেঙ্গালুরু জয় করে রবিবার শহরে ফিরে সঞ্জয় সেন আরও যোগ করলেন, ‘‘এখনই এ সব কথা উঠছে কেন? না না, আমি চাই না বেঙ্গালুরু ম্যাচ নিয়ে হইচই হোক। তবে একটাই ভাল দিক বলতে পারেন— আমাদের পয়েন্টের সুবিধেটা আরও বাড়ল।’’
সত্যিই তাই। বেঙ্গালুরুর চেয়ে দু’ম্যাচ কম খেলে বাগান মাত্র এক পয়েন্ট পিছনে। আর ইস্টবেঙ্গলের সমান পয়েন্ট সঞ্জয় ব্রিগেডের, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে।
গত বার আই লিগ ট্রফিটা যাঁর হাতে উঠেছিল সেই মোহনবাগান অধিনায়ক শিল্টন পালও মনে করেন, গত বারের মতোই ঠিকঠাক এগোচ্ছেন তাঁরা। ‘‘পরের দু’টো ম্যাচ যদি আমরা জিততে পারি তা হলে বলতে পারব ফের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে ষাট ভাগ এগোলাম।’’
গত দশ বছর বাগানে খেলা টিমের সবচেয়ে সিনিয়র ফুটবলার ভুল বলেননি। লিগ টেবলে সঞ্জয় সেনের বাগান এই মুহূর্তে সবচেয়ে সুবিধেজনক জায়গায় আছে। সোমবার থেকেই তাই আরও জোরকদমে পরের প্রস্তুতি শুরু করে দিতে চান সঞ্জয়। পরিবারের এক ঘনিষ্ঠের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাগান কোচ রবিবার সকালেই ফিরে এসেছিলেন কলকাতা। সনিকে নিয়ে। বিকেলে ফেরেন কাতসুমি, দেবজিৎ-সহ দলের বাকি ফুটবলাররা। রাত পর্যন্ত বাগান কোচ ফোন বন্ধ রেখেছিলেন এ দিন। গভীর রাতে তাঁকে ধরা হলে বললেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে যত বেশি সম্ভব পয়েন্ট পাওয়া দরকার। সেখানে এখনও আমরা তিন ম্যাচে সাত পয়েন্ট পেয়েছি। বেঙ্গালুরু কিন্তু এ পর্যন্ত তিনটে অ্যাওয়ে ম্যাচই জিতেছে। এই জায়গাটায় আমরা পিছিয়ে আছি। শনিবারের জয়টা তাই আরও বেশি দরকার ছিল আমাদের। এখন বারাসতে পরের দু’টো ম্যাচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ন’দলের লিগে একটা ম্যাচে খারাপ কিছু হলেই সমস্যায় পড়তে হবে। আমাদের তাই প্রতিটা ম্যাচে সতর্ক থাকতে হবে।’’
কোচের সঙ্গে একমত অধিনায়কও। গত বারের মতো ‘এস’-এ শুরু নামের অধিনায়কদের সাফল্যের বাগানী-তুকতাক মেনে এ বারও শিল্টনকেই ক্যাপ্টেন রেখে দিয়েছেন সবুজ-মেরুন কর্তারা। শৈলেন মান্না-চুনী (সুবিমল) গোস্বামী-সুব্রত ভট্টাচার্য-সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সেই উত্তরসূরি শিল্টন পাল বলছিলেন, ‘‘ছয় ম্যাচ আমরা অপরাজিত, ঠিক আছে। কিন্তু এ রকম তো অনেক বার হয়েছে যে, সবার আগে থাকা দলও শেষমেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। টানা ম্যাচ জিতেও আমরা করিম স্যারের (বেঞ্চারিফা) সময় আই লিগ পাইনি। মর্গ্যানের সময়েও ইস্টবেঙ্গলে এ রকম হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এ বার অনেক কম দল। আইএসএলের মতো। ফলে চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার ফয়সালার জন্য সবাইকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয়।’’
ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে সিনিয়র ফুটবলার। গত বার টিমকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছেন। এ বারও তিনিই নেতা। দুই মরসুমের মধ্যে ফারাক ঠিক কোথায়? শিল্টন তিনটে দিক দেখাচ্ছেন। এক) টিমের ড্রেসিংরুম গতবারের মতোই এককাট্টা। কে খেলল, না খেলল সেটা কোনও প্লেয়ার মাথায় রাখছেন না। সবাই একটা টিম হিসেবে খেলছে। আমি-র আগে আমরা। শিল্টন নিজেই যেমন! শেষ কয়েকটা ম্যাচে দেবজিৎ বাগান গোলের নীচে থাকছেন। দুই) কোচ-সহ গত বারের টিমের নব্বই শতাংশ ফুটবলারদের কর্তারা রেখে দেওয়ার সুবিধে পাওয়া যাচ্ছে। তিন) রিজার্ভ বেঞ্চ গত বারের চেয়ে শক্তিশালী।
‘‘দেখলেন না বেঙ্গালুরু ম্যাচে বেঞ্চ থেকে নেমে কেন লুইস কেমন ম্যাচের সেরা হয়ে গেল!’’ বলছিলেন শিল্টন। তাঁর ব্যখ্যা, যে দুটো টিম চ্যাম্পিয়নের দৌড়ে আছে সেই বেঙ্গালুরু আর মুম্বই এফসি-র ঘরের মাঠ থেকে চার পয়েন্ট নিয়ে এল বাগান। এটা ভাল লক্ষণ। ‘‘দু’টোই কঠিন ম্যাচ ছিল। সেখানে চার পয়েন্ট বেশ ভাল ফল,’’ শহরে ফিরে এ দিন বলছিলেন শিল্টন।
বাগান কোচ বা অধিনায়ক সতর্ক হবেন, সেটাই এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। গত বছরও আই লিগ জয় আশি শতাংশ নিশ্চিত হওয়ার পরেও সঞ্জয় বলেছিলেন, ‘‘এখনও শূন্যতে আছি।’’ এ বারও যেন সেখানে তিনি। বললেন, ‘‘এ বারও একই কথা বলছি। এখনও দশটা ম্যাচ বাকি। সঙ্গে এএফসি কাপ খেলতে হবে। আই লিগ ট্রফি নিয়ে ভাবছিই না। কেবল পরের ম্যাচ নিয়ে ভাবছি।’’ কিন্ত বাগানে যে আই লিগ-বসন্তের হাওয়া ঘোরাফেরা শুরু করে দিয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে ফেসবুক, টুইটারে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের পোস্টে! ‘এগেইন’ শব্দটা এখনই ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন তাঁরা। শনিবার বেঙ্গালুরুর প্রবাসী বাগান সমর্থকরা ইংরেজিতে ওই শব্দের পাঁচ অক্ষর লিখে এনেছিলেন বিশাল আকারে পোস্টারে। অ্যাওয়ে ম্যাচের গ্যালারিতেও যা শোভা পাচ্ছিল। যদিও বেঙ্গালুরু কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড যে ভাবে শনিবার কদর্য ভাষায় বাগান বেঞ্চকে গালাগাল করেছেন তাতে ক্ষুব্ধ টিম ম্যানেজার সঞ্জয় ঘোষ। ‘‘অ্যাশলে এমন ভাবে আমাদের গালাগাল করছিলেন যে, মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল। আমাদের কোচকে বারবার বলছিলাম, আপনি শান্ত থাকুন। আমরা দেখছি।’’ বাগানের শীর্ষ কর্তারা অবশ্য এখন এ নিয়ে অভিযোগ জানাতে চাইছেন না। দেবাশিস দত্ত বললেন, ‘‘এখন কোনও ঝামেলা চাইছি না। এতে টিমের ফোকাস নষ্ট হতে পারে।’’
আসলে বাগানে বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে যে! এখন কে আর খুচখাচ ব্যাপারে মাথা ঘামায়!