শহরে শশাঙ্ক। শুক্রবার গভীর রাতে। ছবি: উৎপল সরকার।
কথা ছিল একেবারে গোপন বৈঠক হবে। যে বৈঠকের কথা ভারতীয় ক্রিকেটে জানবে হাতেগোণা লোক। অথচ শুক্রবার রাতে নাগপুর থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে শশাঙ্ক মনোহর আবিষ্কার করলেন যে, একাধিক টেলিভিশন ক্যামেরা তাঁর দিকে তাক করে রয়েছে। অনেক রাতে যখন জগমোহন ডালমিয়ার আলিপুরের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখনও তাই। দ্রুত বোঝা গেল এই তথাকথিত গোপন সাক্ষাৎকার আসলে ছিল ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনে সাম্প্রতিক কালের ওয়ার্স্ট কেপ্ট ওপেন সিক্রেট! যে গোপন খবরটা আসলে সবার কাছেই কী ভাবে ফাঁস হয়ে গিয়েছে!
রোববারের আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল মিটিংয়ের আগে এই বৈঠক অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ। কিন্তু যাঁদের এটা মনে হচ্ছিল, তাঁরা জানেন না এর বাইরেও বৈঠকের একটা বড় তাৎপর্য ছিল। আরও বেশি করে এটা ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের শক্তির মহড়া। এমন একটা সময়, যখন মনে করা হচ্ছে ভোটব্যাঙ্ক নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের দিকে আবার ঢলে পড়েছে। অত্যন্ত প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে শ্রীনি বোর্ডে ক্রমশ দীপ্যমান হচ্ছেন, এমন সময় এই বৈঠক বোর্ডের শক্তির মেরুকরণটা স্পষ্ট ভাবে দেখাল, এটাই তাৎপর্যের। নাগপুর থেকে উড়ে এসে যেন শশাঙ্ক বোঝালেন যে, এখনও তিনি ডালমিয়ার পাশে আছেন। ডালমিয়াও যেন দেখাতে পারলেন যে বোর্ডে তাঁর ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা ও শরীর নিয়ে যতই ব্যঙ্গবিদ্রুপ হোক, এখনও তাঁর ডাকে হেভিওয়েটরা কলকাতায় উড়ে আসেন। দু’দিন আগে রাজীব শুক্ল, আজ শশাঙ্ক মনোহর।
তা মাঝরাত পর্যন্ত চলা দু’ঘণ্টার বৈঠকে শশাঙ্ক বোর্ড প্রেসিডেন্টকে বলে গেলেন যে, কঠোর হন। এত অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। আমি কিন্তু ললিত মোদীকে সাসপেন্ড করার সময় এত কিছু ভাবিনি। কমিটি বৈঠক না ডেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্টের সেই ক্ষমতা আছে। আপনি শ্রীনির ব্যাপারে বড় বেশি ভাবছেন।
বোর্ডে কেউ কেউ চাইছিলেন যে রোববারের আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল বৈঠকে শশাঙ্ককে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে আনা হোক। শশাঙ্ক নিজে যে ধারণাকে পাত্তা দিতেই রাজি নন। আনন্দবাজারকে রাতে বললেন, ‘‘আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল তো আদতে সাব কমিটি। তারা এত বড় ব্যাপার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার কী ভাবে পেতে পারে?’’ ডালমিয়াকে শশাঙ্ক বললেন, ‘‘আপনি রোববারের বৈঠক করার অনুমতি দিলেন কী করে? এই বৈঠকে যারা বলতে পারত সেই অজয় শিরকে থাকবে না। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থাকবে না। তা হলে বলবেটা কে? আপনি এদের ছাড়া বৈঠক হতে দিচ্ছেন কেন?’’
শশাঙ্ক একাধিক বার ডালমিয়াকে মনে করিয়ে দেন যে, তিনি মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করেন না। শ্রীনির বিরুদ্ধে যা বলার বরাবর খোলাখুলি বলেছেন। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছেন না যে, কলকাতায় মধ্য এপ্রিলে যখন ঠিক হয়েছিল মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকায় সিএসকের শেয়ার ট্রান্সফার করা নিয়ে আইনজীবীদের বক্তব্য চাওয়া হবে, সেই আইনজীবীদের রিপোর্ট আসার পরেও সেটা পেশ করা হল না কেন? (সূত্রের খবর, এই রিপোর্ট তীব্র ভাবে শ্রীনির বিরুদ্ধে। শশাঙ্কের সন্দেহ, বিরুদ্ধে বলেই তা পেশ করা হচ্ছে না।)
বোর্ডের অন্য সদস্যদের পিছনে গোয়েন্দা লাগানো ও তাঁদের ফোন ট্যাপ করার জন্য শ্রীনি প্রচুর টাকা খরচ করেছিলেন। সেটা নিয়েও অনুসন্ধান করার কথা ছিল। কিন্তু ডালমিয়ার বোর্ড কিছুই করেনি। সেটা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন শশাঙ্ক। তিনি মনে করেন, প্রয়োজনে সরকারি সাহায্য নিয়ে বোর্ডের নিজস্ব গোয়েন্দা সেল গঠন করা উচিত। যাদের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা থাকবে। সে ক্ষেত্রে আইপিএল ম্যাচ ঘিরে দুর্নীতির এই অপদৃশ্য আর তখন তৈরি হবে না।
বোর্ড দুটো ফ্র্যাঞ্চাইজি চালাবে, এই ব্যাপারে তিনি রাজীব শুক্লর সঙ্গে একেবারেই একমত নন। মনে করেন, এটা হাস্যকর প্রস্তাব। ডালমিয়াকে মনে করিয়ে দেন, আইপিএলের নিয়মে আছে টিমগুলো চালাবে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা। বোর্ড কখনও ফ্র্যাঞ্চাইজি নয়। তা ছাড়া নির্বাসনের দ্বিতীয় বছরে নিলাম আছে। নিলামে কি তা হলে অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সিএসকে আর রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে প্লেয়ার কিনবে বোর্ডের সচিব? এটা কি কখনও হতে পারে?
শশাঙ্ক মনে করেন, শ্রীনির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনতে বোর্ড অত্যন্ত বেশি গড়িমসি করছে। অনেক দেরি করে ফেলছেন ডালমিয়া। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে তাঁর এ বার স্টেপ-আউট করা উচিত।