লেস্টার সিটি সমর্থকদের উৎসব।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তখন বাইশটার মতো ম্যাচ হয়েছে। লেস্টার সিটি পয়েন্ট টেবলে সবার উপরে বসে। আমি ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত পারবে না লেস্টার। মরসুম শেষে হয়তো লিগ টেবলের মাঝামাঝি থাকবে। এক নম্বরে টানা টিকে থাকার অসহ্য চাপটা নিতে পারবে না। তার উপরে আবার লিগটার নাম ইপিএল। যেখানে ছোট দলগুলোর ভাগ্যে বেশির ভাগ সময় অবনমন-যুদ্ধই লেখা থাকে। কারণ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মানে ইদানীং বিদেশি মালিকানার দাপট। বিলিয়ন পাউন্ড থাকলেই তুমি রাজা।
কিন্তু কী ভুলটাই না ভেবেছিলাম! লেস্টার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল— সেরা হতে সব সময় টাকা লাগে না। সব সময় কোনও মেসি বা রোনাল্ডো লাগে না জিততে। নিখুঁত প্ল্যানিং, প্রচণ্ড দৃঢ়তা আর ফুটবলাররা সারাক্ষণ সংঘবদ্ধ থাকলেও চূড়ান্ত স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়।
অনেকেই হয়তো বলবেন, ধুর লেস্টার জিতেছে তো কী! এটা একটা ‘ফ্লুক’। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, চেলসি, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতো দলগুলো ঘুমিয়ে ছিল বলেই লেস্টার জিতে গিয়েছে। কিন্তু তাই কী? কুড়ি দলের হোম-অ্যাওয়ে, দীর্ঘ ন’মাসের একটা ম্যারাথন ফুটবল লিগ কি শুধু ভাগ্যের জোরেই জেতা যায়। বিশ্বাস করি না। বরং আমার মতে, লেস্টারের রূপকথার পিছনে সবচেয়ে বড় মাথা ছিলেন ক্লদিও র্যানিয়েরি। বিশ্বে কয়েক জন কোচ আছেন যাঁরা কোনও দলের দায়িত্ব নিলে সেই টিমের বেশির ভাগ ফুটবলার পাল্টে ফেলেন। কয়েক জন আবার আছেন, যাঁরা দলের কোর-গ্রুপকে রেখে দিয়ে দু’একটা নতুন মুখ যোগ করেন। র্যানিয়েরি এ বার যেটা লেস্টারে করেছেন। গতবারের জেইমি ভার্দি, ক্যাসপার স্কিমিচেলের সঙ্গে রিয়াদ মাহরেজ, এন’গোলো কাঁতের মতো নতুন মুখ। তাতেই কেল্লা ফতে। র্যানিয়েরি অভিজ্ঞ কোচ। আগেও ইপিএলে চেলসিকে কোচিং করিয়েছেন। ভাল রকমই জানেন এই হাইভোল্টেজ লিগটার সম্পর্কে। মাথাটাও দারুণ ঠান্ডা। ৪-৪-২ ফর্মেশন ভালবাসেন। তাই গোটা মরসুম মাহরেজ, কাঁতে, ভার্দির মতো ফুটবলারদের গতিকে খুব ভাল ব্যবহার করেছেন। বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে বল পজেশন বেশি পাবেন না জানতেন লেস্টারের ইতালিয়ান কোচ। তাই প্রতিআক্রমণকে প্রধান হাতিয়ার করেছিলেন।
চ্যাম্পিয়ন করার দুই কারিগর স্ট্রাইকার জেইমি ভার্দি ও কোচ ক্লদিও র্যানিয়েরি।
এ বার আসি র্যানিয়েরির যোদ্ধাদের কথায়। এখনকার ফুটবলে ট্রফি জিততে সব সময় খুব ভাল একটা ফরোয়ার্ড লাইনের দরকার পড়ে। গত মরসুমে বার্সেলোনার ‘এমএসএন’ তার প্রমাণ। জেইমি ভার্দির দুরন্ত ফর্ম লেস্টারকে ভাল শুরু করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু দলের আসল কারিগর ছিল রিয়াদ মাহরেজ। কী দুর্দান্ত ফুটবলার। একদম বার্সেলোনা ঘরানার। বলের উপর ব্যালান্স, ড্রিবলিং ক্ষমতা দারুণ। গোলটাও ভাল চেনে। পুরো প্যাকেজ বলতে যা বোঝায় তাই। লেস্টার ডিফেন্সও খুব ধারাবাহিক ছিল। হুথ-মর্গ্যান জুটি টিপিক্যাল প্রিমিয়ার লিগ ডিফেন্ডারদের মতো। সবশেষে বলব কাঁতে-র কথা। হোল্ডিং মিডিও বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। হাফওয়ে লাইনের নীচে যা দেখব, সেটাই ট্যাকল করব— এটাই কাঁতের ব্রত।
জানি কোনও তুলনাই হয় না, কিন্তু লেস্টারের এই অসাধারণ অনুভূতিটা একটু হলেও আমি বুঝতে পারছি। আমিও কোচিং কেরিয়ারে টালিগঞ্জ অগ্রগামী, ইউনাইটেড স্পোর্টসের মতো দলের দায়িত্ব নিয়েছি। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো দলের বিরুদ্ধে তখন স্ট্র্যাটেজি কষতে হত। ফুটবলারদের বলতাম, তোমরা বিপক্ষের মতো শক্তিশালী না হতে পারো কিন্তু ফুটবলে সব কিছুই সম্ভব।
আসলে মাঝেমাঝে ‘আন্ডারডগ’ হওয়ারও আলাদা মজা! লেস্টার সিটি সেই মজাটাই উপভোগ করল।
ছবি: এএফপি