আইসিসি-র ছাড়পত্র রহস্য স্পিনারকে

অন্য এক ক্রো খুঁজে এনে নারিন-মুক্তি

সুনীল নারিনের কাছে কেকেআর মহাকর্তার সুখবরের ফোনটা যখন যায়, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নাকি মিশ্র ছিল। ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনার খুশি অবশ্যই হয়েছেন। দীর্ঘ দিন ক্রিকেট-কারাগারে আটকে থাকার পর আচমকা যদি বেকসুর খালাসের অর্ডার আসে, কোন ক্রিকেটার অখুশি হবে? নারিন কোনও ব্যতিক্রম নন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪২
Share:

অালোচনা।নাইটদের প্র্যাকটিসে কোচ ও মেন্টর কালিস-আক্রম। শুক্রবার ইডেনে।—নিজস্ব চিত্র

সুনীল নারিনের কাছে কেকেআর মহাকর্তার সুখবরের ফোনটা যখন যায়, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নাকি মিশ্র ছিল। ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনার খুশি অবশ্যই হয়েছেন। দীর্ঘ দিন ক্রিকেট-কারাগারে আটকে থাকার পর আচমকা যদি বেকসুর খালাসের অর্ডার আসে, কোন ক্রিকেটার অখুশি হবে? নারিন কোনও ব্যতিক্রম নন। শুধু শোনা গেল, সদ্য পিতৃহারা হওয়ার শোকতাপ তাঁর মুক্তির উল্লাসকে কিছুটা চাপা দিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

‘‘আসলে সুনীল ওর বাবার খুব কাছের ছিল। ভেরি ক্লোজ,’’ এ দিন সন্ধেয় কেকেআর ড্রেসিংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন কেকেআর সিইও বেঙ্কি মাইসোর। সুনীল নারিনকে যিনি এ দিন ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন। ‘‘খুশি হয়েছে তো অবশ্যই। কিন্তু ওর সময়টাও খুব খারাপ চলছে। অনূভূতিটা তাই একটু মিশ্র। আমি নিশ্চিত যে সুনীলের বাবা বেঁচে থাকলে আজ সবচেয়ে খুশি হতেন। উনি সব সময় গর্ব করতেন ছেলের পারফরম্যান্স নিয়ে।’’ একটু থেমে কেকেআর সিইও আবার যোগ করলেন, ‘‘যাই হোক, সময়ই সব করবে। সব সামলাবে। আমরা সুনীলের উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে নেই। দ্বিতীয় ম্যাচেও যদি না পারে, অসুবিধে নেই। তার চেয়ে আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সঠিক মন নিয়ে সুনীলের ফেরা। কালিসও সেটা বলছিল।’’

সুনীল নারিন যে দিনই দেশ থেকে ফিরুন, সুনীল নারিন যে ম্যাচ থেকে মাঠে নামুন, ইডেনে কেকেআরের উদ্বোধনী ম্যাচের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে উৎসবের আবির খেলা তো শুরু হয়ে গেল। আবার মাঠে তিনি, আবার তাঁকে দেখে প্রতিপক্ষের বাঘা ব্যাটসম্যানদের হাঁটু কাঁপাকাঁপি, আবার কেকেআরের জয়-সম্ভাবনার সেনসেক্স এক ধাক্কায় মগডালে উঠে যাওয়া, আবার তাঁকে ঘিরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখা— সব তো এক ঝটকায় শহরে শুরু হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার মাঝরাতে আইসিসি প্রেরিত এক ই-মেলে। যেখানে তাঁর অ্যাকশনকে ক্লিনচিট দিয়ে দেওয়া হল।

Advertisement

কেকেআর কর্তারা যার পর উল্লসিত। কেকেআর সিইও বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমি যতটুকু জানি, সুনীল আরও বেশি এফেক্টিভ হতে যাচ্ছে। লোকে কিন্তু বলাবলি করছে যে, ওকে আগে যা ভয়ঙ্কর লাগত, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি দেখাতে পারে।’’ ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনারের সতীর্থকুল— তাঁদেরও দেখলে মনে হবে যেন মাঠে নামার আগেই ব্রেথওয়েটের বিকট ছক্কাগুলো হাঁকিয়ে বসেছেন! সাকিব আল হাসান যেমন। নারিনের প্রত্যাবর্তনে কেকেআর কতটা বলশালী হল, এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। সাকিব পরিষ্কার বলে দিলেন, শুধু তাঁর কাছে নয়। গোটা টিমের কাছে খবরটা কড়া মনোবল-বর্ধক ইঞ্জেকশনের কাজ করবে। টিমের কারও কারও কাছে আগাম খবর ছিল যে, অ্যাকশন-জনিত সমস্যা থেকে অব্যহতি পেতে চলেছেন। আইসিসি তাঁকে ক্লিনচিট দিতে চলেছে। অপেক্ষা ছিল শুধু সরকারি ঘোষণার। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে যা এল।

কিন্তু ঘটনা হল, নারিনের ক্রিকেট-কারাগার থেকে মুক্তির প্রক্রিয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। গত এক বছর ধরে টানা অ্যাকশন-সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে নারিনকে। নিরন্তর বসতে হয়েছে একের পর এক অ্যাকশন-পরীক্ষায়। বারবার ঢুকতে হয়েছে অ্যাকশন-সংশোধনাগারে। এবং ক্লিনচিট নিয়ে বেরিয়ে কিছু দিনের মধ্যে ফের শুনতে হয়েছে তোমার অমুকটা এখনও ঠিক নয়, যাও ঠিক করে এসো! নারিন কেন, ইস্পাত-সৃষ্ট কোনও ক্রিকেটার এ জগতে বিচরণ করলে তাঁকেও মানসিক ভাবে চুরচুর করে দেওয়ার জন্য এগুলো যথেষ্ট।

নারিন বেঁচে গিয়েছেন দু’টো কারণে। এক, কেকেআর। আরও ভাল করে বললে কেকেআর সিইও বেঙ্কি মাইসোর। যাঁর দর্শন হল, কেকেআর কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম নয়। ফ্যামিলির নাম। পরিবারের নাম। যিনি অকাতর সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন সেরা প্লেয়ারের দুঃসময়ে, ব্যবসায়িক মুনাফার কথা ভেবে নারিনকে রিলিজ না করে। আর দ্বিতীয় ভদ্রলোক— ক্রো। মার্টিন বা জেফ নন, কার্ল ক্রো। পেশায় অতি উন্নতমানের এক ইংরেজ বায়োমেকানিস্ট। নারিনকে নিয়ে যিনি পড়ে থেকেছেন অ্যাকশনের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধের সময়।

এক আন্তর্জাতিক ম্যাচে নারিনের অ্যাকশন আবার রিপোর্ট হওয়ার পর, যাঁকে খুঁজে নিয়ে আসেন মাইসোর। ‘‘আমাদের মনে হয়েছিল, এ বার আরও বড় কোনও স্পেশ্যালিস্ট আনা দরকার। ব্যাপারটা আইসিসি ইস্যু হয়ে গিয়েছিল,’’ বলছিলেন কেকেআর সিইও। শোনা গেল, ত্রিনিদাদে পনেরো-কুড়ি দিন ধরে নারিনকে নিয়ে পড়ে ছিলেন তুখোড় এই বায়োমেকানিস্ট। নারিন নিজেও এতটাই খাটতে শুরু করে দেন যে অনেকেরই মনে হয়েছে, এতটা রগড়ানির মধ্যে নিজেকে ফেলতে তাঁকে কখনও দেখা যায়নি।

গত ২৮ মার্চ চেন্নাইয়ে অ্যাকশন পরীক্ষার দিন ধার্য হয় নারিনের। কেকেআর ঠিক করে, নারিন একা শুধু চেন্নাইয়ে যাবেন না। সঙ্গে ক্রো-ও যাবেন। শুধু পরীক্ষার জন্য নয়। নারিনকে মানসিক ভাবেও ভরসা দিতে। পরে তাঁকে বলা হয়, আপনি কলকাতাতেও আসুন। আইপিএলের আগে প্র্যাকটিসের সময় থাকুন নারিনের সঙ্গে। এবং নারিনকে এ হেন সমর্থন প্রদান নতুন নয়। কেকেআর প্রথম দিন থেকে করে আসছে। একদম প্রথমে যখন ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনারের অ্যাকশন নিয়ে দুঃসংবাদ আসে, সে দিন থেকে। প্রত্যেকটা ব্যাপার ধরে ধরে এগোনো হয়েছে। প্রথমে মানসিক শক্তি প্রদান। তার পর বিভিন্ন স্পেশ্যালিস্ট আমদানি। উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত সব জায়গায় পাঠিয়ে খুঁজতে চাওয়া যে, সমস্যা কোথায়? কতটা সমস্যা? তার পর ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনারের পাশে দাঁড়িয়ে বারবার বিরূপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়ে চলা। নারিনের বিরুদ্ধে অবিচারের প্রতিবাদে আইপিএল থেকে নাম তুলে নেওয়ার কথাও একবার ঘোষণা করে দিয়েছিল কেকেআর! অ্যাকশন নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের পরেও ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেনি। উল্টে সবাইকে আশ্চর্য করে ধরে রেখে দিয়েছে।

‘‘ব্যবসায়িক ভাবে তো ভাবাই যায়। কিন্তু কেকেআর সে ভাবে দেখে না। কারও কারও হয়তো মনে হত যে, এর অ্যাকশন নিয়ে এত সমস্যা চলছে রিলিজ করে দেওয়াই তো ভাল। কিন্তু একটা পরিবারে তো সেটা করা যায় না,’’ বলে দিচ্ছেন মাইসোর। এবং নিজে কোনও কৃতিত্ব নিচ্ছেন না। ‘‘আমি নই, আমাদের টিমের দর্শনই এটা। আমি হয়তো টিমটাকে ড্রাইভ করি। কিন্তু মালিকের দর্শন যদি অন্য হত, আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হত না।’’ বরং মনে করিয়ে দিচ্ছেন কলকাতার সমর্থনকে। তুলে আনছেন, অভিশাপের সময়কার এক মুহূর্ত। এক-এক বার তখন নারিনের অ্যাকশন ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে, এবং ফের ধরা হচ্ছে। অ্যাকশন-ফাঁদে নারিন তখন টিম হোটেলে বসে থাকতেন। প্র্যাকটিসে আসতেন না। পরে ও রকম এক ছাড়পত্র পেয়ে নারিন ইডেনে নেমে দেখেন, শ’তিনেক লোক বাইরে দাঁড়িয়ে। টিমবাস থেকে নামা মাত্র যারা জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে। অনাবেগী নারিনকেও নাকি সে দিন দেখা গিয়েছিল, আবেগতাড়িত হয়ে পড়তে। জনতাকে স্যালুট করতে।

খোঁজ না নিয়েও লিখে দেওয়া যায়, দৃশ্যপট এ বারও একই থাকবে। বদলাবে না। ক্যারিবিয়ান অফ স্পিনার টিমবাস থেকে ইডেনে যে দিনই নামুন, দেখবেন তাঁর জন্য আবারও কয়েকশো দাঁড়িয়ে। সে দিনের মতো। যারা আবার তাঁর নামে জয়োধ্বনি দেবে। শব্দব্রহ্মের ডেসিবেলও হয়তো বাড়বে। আর বাড়বে না-ই বা কেন? বাড়াই তো উচিত।

সুনীল নারিন ইজ ব্যাক! হয়তো বরাবরের মতো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন