অ্যাজ়ার এবং এক টুকরো বার্লিন ওয়াল

ফার্মহাউসটা আর ফার্মহাউস নেই। আজ তার পরিচিত নাম দোমেইনন দ্য লুশিঁ। ফরাসি ফুটবলের এক প্রাচীন ক্লাব লিল-এর ট্রেনিং সেন্টার, অ্যাকাডেমি এবং প্র্যাক্টিস মাঠ।

Advertisement

কৌশিক দাশ

লিল (ফ্রান্স) শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:২১
Share:

অভিনব: বার্লিন ওয়ালের ভাঙা টুকরোয় অ্যাজ়ারের ছবি। নিজস্ব চিত্র

দু’পাশের সবুজ মাঠ চিরে যে হাইওয়েটা চলে গিয়েছে, তার পাশেই ফার্মহাউসটা। প্যারিস থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে এই লিল শহর। যার কেন্দ্রস্থল থেকে আরও মিনিট পঁচিশেক গাড়ি চালিয়ে এলে দেখা মিলবে এই ফার্মহাউসের।

Advertisement

যেখানে রয়েছে এক টুকরো ইতিহাস। রয়েছে সেই ঠান্ডা যুদ্ধের এক ফালি স্মৃতি। যেখানে আপনাকে স্বাগত জানাবে ‘দ্য ওয়াল অফ অ্যাজ়ার’!

ফার্মহাউসটা আর ফার্মহাউস নেই। আজ তার পরিচিত নাম দোমেইনন দ্য লুশিঁ। ফরাসি ফুটবলের এক প্রাচীন ক্লাব লিল-এর ট্রেনিং সেন্টার, অ্যাকাডেমি এবং প্র্যাক্টিস মাঠ। কিন্তু ট্রেনিং সেন্টারে পা দিয়ে ফুটবলে নয়, আপনি ডুবে যাবেন ইতিহাসে। ছুঁয়ে দেখতেও পারেন সেই ইতিহাসকে। যে ইতিহাসের নাম ‘বার্লিন ওয়াল’। যে পাথরের চাঙড় এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাকস্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক।

Advertisement

যে চার মিটার উঁচু ও এক মিটার চওড়া পাথরের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে লিল অলিম্পিক স্পোর্টিং ক্লাবের (এলওএসসি) সব চেয়ে নামী ফুটবলারের ছবি। যে ফুটবলার ৫৬ বছর পরে, সেই ২০১১ সালে ক্লাবকে এনে দিয়েছিলেন লিগ চ্যাম্পিয়নের ট্রফি।

এডেন অ্যাজ়ারের ছবি কেন, তা বোঝা গেল। কিন্তু কেন বার্লিন ওয়ালের এই টুকরো? জানা যাচ্ছে, এর পিছনে রয়েছেন ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মিশেল সেদো। শিল্প-কলা এবং ইতিহাসপ্রিয় সেদো বছর চারেক আগে বার্লিন ওয়ালের বেশ কিছু টুকরো কিনে নিয়েছিলেন এক শিল্প সংগ্রাহকের কাছ থেকে। কারণ তাঁর কাছে বার্লিন ওয়ালের ভেঙে পড়ার সেই মুহূর্তটা ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের জ্বলে ওঠার লড়াই। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেওয়ার কাহিনি। যে কাহিনির সঙ্গে লিল নিজেদের মিল খুঁজে পেয়েছিল অ্যাজ়ার যুগের সময়। প্যারিস সাঁ জাঁরমা, মোনাকো, লিয়ঁর মতো ক্লাবকে পিছনে ফেলে অ্যাজ়ার তাদের মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।

ক্লাব গাইডের কথায় জানা গেল, যে, বার্লিন ওয়ালের এই টুকরোর বয়স অর্ধ শতাব্দীরও বেশি। বেশ কিছু এ রকম টুকরো কিনে নেওয়া হয়। তার পরে দুই ফরাসি পথশিল্পীকে দিয়ে আঁকানো হয় নানা বিখ্যাত ব্যক্তি বা ঘটনার ছবি।

অ্যাজ়ার ক্লাব ছেড়ে চলে গিয়েছেন অনেক দিন। লিলও ক্রমশ পিছলে গিয়েছে সাফল্যের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। এই বছরে তারা অবশ্য ফরাসি লিগ ওয়ান তালিকায় দু’নম্বরে রয়েছে। কিন্তু পিএসজির চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে কুড়ি পয়েন্ট পিছিয়ে!

অ্যাজ়ার কি কোনও দিন ফিরে আসতে পারেন তাঁর পুরনো ক্লাবে? আবার কি লিলের জার্সিতে দেখা যেতে পারে চেলসি ফুটবলার এবং বেলজিয়াম অধিনায়ককে? প্রশ্নটা শুনে একটু বিষণ্ণ হাসি হাসেন ক্লাবের বর্তমান কোচ ক্রিস্তোফ গাল্তিয়ে। ‘‘অ্যাজ়ারকে দলে কে না চায়? কিন্তু কী ভাবে ওকে ফিরিয়ে আনা যাবে বলুন তো?’’

অ্যাজ়ার আর কোনও দিন ফিরবেন না, মহাতারকা ফুটবলার কেনার মতো জায়গায় তারা পৌঁছতে পারবে কি না, ঠিক নেই। তাই এখন এই ক্লাবের মন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইকেল জর্ডানের একটি উক্তি।

ফুটবলারদের ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে দেওয়ালে লেখা আছে শব্দ ক’টা— ‘প্রতিভা আপনাকে ম্যাচ জেতাতে পারে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপ জেতায় টিমওয়ার্ক আর বুদ্ধিমত্তা।’ নীচে বক্তার নাম। মাইকেল জর্ডান। এক ক্লাবকর্তা বলছিলেন, ‘‘এই কথাটাই আমরা ফুটবলারদের মনে করিয়ে দিতে চাই। শুধু প্রতিভা দিয়ে ট্রফি জেতা যায় না।’’

লিলের ফুটবলারদের আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক দিন, প্রতিনিয়ত। তোমরা ফুটবলই খেলছ, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। মাঠের জয়-পরাজয় কখনও জীবনের জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে না।

ফুটবলারদের ড্রেসিংরুমের দরজার ঠিক সামনে রয়েছে কতকগুলি হাতে আঁকা ছবির কোলাজ। যে তরুণী এই ছবির শ্রষ্টা, তিনি আজ বেঁচে নেই। লিলের অন্ধ সমর্থক মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্মৃতিকে অমলিন রাখতে মেয়েটির আঁকা বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে তৈরি হয়েছে এই কোলাজ। যা বার্তা দিচ্ছে, জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নয়।

গাড়ি আবার সেই ফার্মহাউসের গেট ছাড়িয়ে হাইওয়েতে পড়েছে। পিছনে মিলিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্সের একটি প্রাচীন ক্লাবের ট্রেনিং সেন্টার।

প্রশ্নটা মনে ভেসে উঠল তখনই। সত্যিই কি জীবনের চেয়ে বড় কিছু হয় না? ফুটবল কি কখনও কখনও হারিয়ে দিয়ে যায় না জীবনকেও?

না হলে কেন ইতিহাসের বার্লিন ওয়ালে জায়গা পেয়ে এক নশ্বর ফুটবলার হয়ে উঠবেন অবিনশ্বর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন