এক মুঠো স্বপ্ন নিয়ে ফুটবলে বিশ বীরাঙ্গনা

গীতা গোল করতে চান। কিন্তু গোল রুখবেন যিনি সেই মিনি রায়ের বাড়ির খড়ের ছাদও তো উড়ে গিয়েছিল কয়েক মাস আগের শিলা-ঝড়ে।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:১৫
Share:

চাণক্য: মহিলা দলের কোচ সুজাতা কর। নিজস্ব চিত্র

বাবা মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন সমুদ্রে। সুনামির ঝড়ে সুন্দরবন সংলগ্ন বাড়িও মিশে গিয়েছিল মাটিতে। সর্বস্বান্ত হয়ে মামা-র বাড়ি সোদপুরে চলে এসেছিলেন মা-র সঙ্গে। মা মালতী দাস পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। তবুও গীতা দাসের স্বপ্ন থেমে থাকেনি।

Advertisement

আজ শুক্রবার মেয়েদের আই লিগ খেলতে কোলাপুরে যাচ্ছেন গীতা। চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। কলকাতা লিগে ছয় ম্যাচে ছয় গোল করা স্ট্রাইকার বুধবার বিকেলে মহমেডান মাঠে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘আমরা তো খুব গরিব। চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে একটা চাকরি জুটে যাবে নিশ্চয়ই। ’’

গীতা গোল করতে চান। কিন্তু গোল রুখবেন যিনি সেই মিনি রায়ের বাড়ির খড়ের ছাদও তো উড়ে গিয়েছিল কয়েক মাস আগের শিলা-ঝড়ে। কালিয়াগঞ্জের কুশমুন্ডির মেয়ে তখন খেলছেন কলকাতায়। রাতে ঘুমোতে পারতেন না, বাবা-মার কথা ভেবে। খেতমজুর বাবা কী ভাবে কোথায় থাকবেন বা বাঁচবেন, সেই ভাবনায় ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড কাটত তাঁর। বলছিলেন, ‘‘লিগের খেলা চলছিল তখন। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই না কোনও খারাপ খবর আসে।’’ মগরার দেবমিতা রায়ের বাবাও খেত মজুর। বছর কুড়ির এই ফুটবলার নিজেকে সেরা স্ট্রাইকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন কলকাতা লিগে। ছয় ম্যাচে এগারো গোল করে।

Advertisement

এক সময় জমি-যুদ্ধে উত্তাল সিঙ্গুর সংলগ্ন দিয়ারা গ্রামের মেয়ে বর্ণালী কাঁড়ার। বাবা কলা বিক্রি করেন গ্রাম ঘুরে ঘুরে। শীর্ণ চেহারার এই মিড হাফের গলাতেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জেদ। মনে, আশার সলতে।

অভিযান: এই প্রথম মহিলাদের আই লিগে খেলবে কলকাতার কোনও দল। মহমেডান স্পোর্টিং মাঠে শেষ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত চাঁদনি স্পোর্টিংয়ের মেয়েরা। নানা প্রতিকূলতা আর আর্থিক চ্যালেঞ্জ সামলে ভারত সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই ফুটবলাররা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

গীতা, মিনি, দেবমিতা, বর্ণালীদের চেনার কথা নয় কারও। গ্রাম-গঞ্জের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই বেড়ে ওঠা ওঁদের। তবুও ওঁরা একটা ইতিহাস তৈরি করতে চলেছেন। বাংলা থেকে প্রথম দল হিসাবে মেয়েদের আই লিগ খেলতে যাচ্ছে যে ক্লাব, সেই চাঁদনি স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার ওঁরা।

রবি কিন বা সনি নর্দেদের মতো ওঁদের উপর আলো নেই। কোটি কোটি টাকাও পান না। ওঁরা সব অর্থেই তাই ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা। ছেলেদের আড়ম্বরের আইএসএল বা আই লিগের পাশে ওঁদের অবস্থাটা কেমন? খাওয়া-যাতায়াতের জন্য নামমাত্র খরচ পেয়েছেন বেশির ভাগ ফুটবলার। ফ্ল্যাটে বা আত্মীয়ের বাড়িতে মেস করে থেকেছেন। বুট, কিট জোটে না। ওঁদের জন্য মাঠ দিতে রাজি হয়নি কোনও ক্লাব। রেড রোডের ধারে অনুশীলন হত টিমের। মহমেডান এগিয়ে না এলে শেষ দশ দিনের শিবিরও হত না চাঁদনির ফুটবলারদের।

আর রেজিনা খাতুন-প্রিয়াঙ্কা বাগদের এক জায়গায় এনে যিনি সাফল্যের স্বপ্ন দেখছেন, তিনি কোচ সুজাতা কর। বাংলা ও ভারতের জার্সিতে যাঁর অসংখ্য গোল আছে। অধিনায়কত্বও করেছেন বহুবার। বেমবেমদেবীদের সতীর্থ স্ট্রাইকার সুজাতা শেষ অনুশীলনের পর এ দিন বলছিলেন,‘‘কলকাতা লিগ থেকে বেছে বেছে ওদের নিয়েছি। সব গরিব ঘরের মেয়ে। আমার বাড়িতে থাকে অনেকেই।’’

এ বার তালতলা দীপ্তি সংঘকে কলকাতা অপরাজিত লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছেন সুজাতা। তাঁর উদ্যোগেই আই লিগে টিম নামাতে রাজি হন চাঁদনি স্পোর্টিং ক্লাবের সচিব নজরুল ইসলাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নজরুল টিম গড়তে খরচ করছেন প্রায় বারো লাখ টাকা। বলছিলেন, ‘‘বাংলার মেয়েদের ফুটবলকে প্রচারের আলোয় আনার জন্যই আই লিগে খেলছি। কোনও স্পনসর না থাকা সত্ত্বেও।’’

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই টিম বানিয়েছেন সুজাতা। মেয়েদের আই লিগে বিদেশি ফুটবলার খেলানোর নিয়ম নেই। তাই গীতা-মিনিদের মতো বাংলার জার্সি গায়ে জাতীয় ফুটবলে খেলে ফেলা ১৩ ফুটবলারের পাশাপাশি ওড়িশার পাঁচ জন এবং হরিয়ানার দু’জনকে নিয়ে এসেছেন সুজাতা। যাঁরা প্রায় সবাই দেশের জার্সিতে খেলেন এখন। এই বিশজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন সুজাতা।

চাঁদনি আই লিগে চাঁদমারি বিঁধতে পারে কি না সময় বলবে। পারলে গীতা-মিনিদের জীবনে অন্ধকার ঘুচবে হয়তো। ফিরতে পারে পূর্ণিমার আলোও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন