নিয়মিত ডুডু-র্যান্টি জুটির খেলার ভিডিও দেখাই ডার্বিতে সাফল্যের রসায়ন দেবজিত্ মজুমদারের। ছিয়ানব্বই মিনিট মোহনবাগান গোলকে অক্ষত রেখে দেওয়ার অতন্দ্রপ্রহরী নিজেই ফাঁস করলেন রহস্য!
শনিবারের বড় ম্যাচের আগে বাগান কিপার দেবজিতের রোজকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্র্যাকটিস থেকে বাড়ি ফিরে এ মরসুমে ইস্টবেঙ্গলের আই লিগের ম্যাচগুলোর ভিডিও দেখা। এ দিক-ও দিক থেকে অনেক চেষ্টা করে র্যান্টি-ডুডুদের খেলার ভিডিও জোগাড় করেছিলেন তিনি। সফল ডার্বি শেষে সতীর্থ কিংশুক দেবনাথের গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে দেবজিত্ বলছিলেন, “ইস্টবেঙ্গলের আগের আই লিগ ম্যাচগুলোর ভিডিও দেখেছি রোজ। সেটা কাজে লেগেছে আজ।”
শুধু ইস্টবেঙ্গলেরই নয়, নিজের টিম মোহনবাগানের বেশ কিছু ম্যাচের ভিডিও দেবজিত্ সংগ্রহ করে নিজের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন নাগাড়ে। আই লিগের প্রথম ডার্বির ভিডিও দেখেছেন। যে ভুলগুলো সে বার করেছিলেন, সেগুলো এ বার শুধরে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। নিট ফল, বাগানের ‘লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স’-এর চার-চারটে অসাধারণ সেভের জন্যও শনিবার যুবভারতীর রং সবুজ-মেরুন। ম্যাচ উইনার বলবন্ত নয়, তাঁকে ঘিরে ধরেই জয়ধ্বনী দিয়েছে বাগান জনতা।
চারটে সেভের কোনটাকে সেরা বলবেন? একটুও না ভেবে বছর চব্বিশের কিপার বলে দিলেন, “ডুডুর যে শটটা প্রথম বাঁচালাম সেটাই আমার কাছে সেরা। কারণ ওই গোলটা বাঁচানোর পরই আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছিল।”
কৈশোরে বাবা মারা গেছেন। তাই অনেক লড়াই করে টিকে ছিলেন দেবজিত্। অভাবের সংসারেও কিন্তু ছেলের ফুটবলের প্রতি ভালবাসাকে হারিয়ে যেতে দেননি বিধবা মা।। উত্তরপাড়ার নেতাজি ব্রিগেডে ফুটবলে হাতেখড়ি। ছেলেবেলার কোচ সঞ্জয় চক্রবর্তী তাঁকে এফসিআইয়ে ট্রায়াল দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আর সর্বভারতীয় ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন আর এক সঞ্জয়ের হাত ধরে। মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন ভরসা রেখেছিলেন দেবজিতের উপর। আর সেটার মর্যাদা রাখতে নিজের একশো শতাংশ উজাড় করে দিয়েছেন তিনি। মাঝে কালীঘাট এমএস, সিকিম ইউনাইটেড (দু’মাসের জন্য লিয়েনে), ইস্টবেঙ্গল, ভবানীপুরে খেললেও সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি দেবজিত্। সুযোগও পাননি নিয়মিত।
মোহনবাগানেও সুযোগ আসে টিমের এক নম্বর কিপার শিল্টন পাল চোট পাওয়ায়। প্রথম একাদশে ঢোকার পরে প্রায় প্রতি ম্যাচেই ধারাবাহিক ভাল খেলে চলেছেন। শেষ দু’ম্যাচে হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। তা হলে এখন কি নিজের জায়গা হারানোর টেনশনে পড়ে গেলেন শিল্টন-ই? “কোনও টেনশন নেই আমার। দেবজিত্ দারুণ খেলছে। এখন ওরই খেলা উচিত। এটাই তো ফুটবলের নিয়ম। আমাকে আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন খেলব,” সটান বলে দিচ্ছেন অধিনায়ক শিল্টন।
অতীতে মোহনবাগানকে নিজের দস্তানায় বহু ম্যাচে বাঁচানো, অধুনা ক্লাবের টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় আবার জানালেন, কী টোটকা দিয়েছিলেন তিনি উত্তরসূরিকে! “দেবজিত্কে শুধু দু’টো কথা বলেছিলাম বড় ম্যাচ নিয়ে। বলের থেকে কখনও চোখ সরাবি না এক সেকেন্ডের জন্যও। আর বাইরের কোনও কথায় কান দিবি না,” বললেন প্রাক্তন বাগান কিপার।
যাঁকে নিয়ে এত প্রশংসা, সেই দেবজিত্ অবশ্য নির্বিকার। এমনকী ম্যাচের পর তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের হুড়োহুড়ি, সমর্থকদের উচ্ছ্বাস কিছুই যেন স্পর্শ করছিল না তাঁকে। হয়তো জীবনের সেই সারসত্যটা জানেন আজ যে রাজা, কাল সে ফকির! সেই কথাটাই মনে করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “লিগের অর্ধেক ম্যাচও হয়নি। ডার্বি জেতার জন্য আনন্দ হচ্ছে। কোচের ভরসার দাম দিতে পেরেছি বলে তৃপ্ত। তবে পরের ম্যাচটাই যদি ভাল না খেলতে পারি টিম থেকে ছিটকে যেতে হবে।”