আমরা, ভারতীয়রা ক্রিকেটটাকে খুব ভালবাসি ঠিকই। কিন্তু নিজেদের দেশের সুপারস্টারদের বাইরে আমরা খুব একটা ভাবি কি? কোনও ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থককে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বাছতে বলুন। অনেকেই কিন্তু সেই তালিকায় জাক কালিসকে রাখবে না। যে কি না আমার মতে কমপ্লিট ক্রিকেটার হিসেবে স্যর গ্যারি সোবার্সের কাছাকাছিই থাকবে। তবে কালিস থাকলেও ওই তালিকায় অন্য একটা নাম রাখতে প্রায় সবাই ভুলে যাবেন। নামটা কুমার সঙ্গকারা।
আমাদের দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলিদের নিয়ে মেতে থাকলে কী হবে, বিদেশি ক্রিকেটমহল কিন্তু সঙ্গকারাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। দেখার কারণও আছে। টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সঙ্গকারা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সদ্যসমাপ্ত টেস্টে দশ নম্বর ডাবল সেঞ্চুরি করে যে এখন স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড তাড়া করছে। সঙ্গা এমন এক জন ব্যাটসম্যান যে বিশ্বের প্রায় সব মাঠে বড় রান পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সব দেশে সফল। আসলে ওর ব্যাটিং স্টাইলটা এমনই যে, বিদেশের পরিবেশের সঙ্গে খুব ভাল মানিয়ে নিতে পারে। দুশোর বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে সঙ্গা। ডারহাম আর ওয়ারউইকশায়ারে কাউন্টি খেলেছে। বিগ ব্যাশ খেলেছে। বিশ্বের সব প্রান্তে খেলার অভিজ্ঞতা ওর আছে।
সোজা কথায়, এক জন কমপ্লিট ক্রিকেটারের দারুণ উদাহরণ হল সঙ্গা। যার প্রতিভা শুধুমাত্র একটা ফর্ম্যাটেই সীমাবদ্ধ নয়। কেরিয়ারের শুরুর দিকে যেমন ওয়ান ডে-তে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল সঙ্গকারা। কিন্তু তার পর যে ভাবে টি-টোয়েন্টির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, ভাবা যায় না! আসলে সঙ্গার ক্রিকেট-মস্তিষ্ক প্রচণ্ড পরিষ্কার আর ঝকঝকে। বছর দুয়েক আগে আইপিএলের একটা মিটিংয়ে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। নো-বল নিয়ম, মানকাডিং নিয়ে সে দিন ও যা যা বলেছিল, সব ভীষণ যুক্তিযুক্ত। আসলে ও শুধু ক্রিকেটটা খেলে না। ক্রিকেট নিয়ে রীতিমতো ভাবনাচিন্তা করে। এমসিসি টেকনিক্যাল কমিটির যোগ্য সদস্য সঙ্গকারা। ওর সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু আমার দারুণ লাগে। খুব বিনয়ী, নম্র, শিক্ষিত মানুষ। ইগো নেই, খুব সহজে ওর সঙ্গে কথা বলা যায়। ম্যাচের পর টিমমেটদের সঙ্গে বসে আড্ডা মারার ট্র্যাডিশনটা এই পেশাদারিত্বের যুগে লোপ পেতে বসেছে। সেই ট্র্যাডিশনটা এখনও ধরে রেখেছে সঙ্গা। ওর সঙ্গে আমাদের রাহুল দ্রাবিড়ের প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাই। দু’জনেই এক রকম জেন্টলম্যান। মাঠ তো বটেই, মাঠের বাইরেও যাকে তুমি সম্মান করতে বাধ্য।
ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান যখন বিদেশ সফরে যায়, তখন আমাদের ওরা একটা সমষ্টির অংশ হিসেবে দেখে। বিদেশি চোখে আমরা সবাই-ই উপমহাদেশের ক্রিকেটার। সমষ্টিগত ভাবে আমাদের নিয়ে ভাবা হয় যে, এরা শর্ট বল খেলতে পারে না। পুল করতে পারে না। কাট করতে পারে না। উপমহাদেশের ক্রিকেটার হিসেবে এই ব্যাপারে আমার সঙ্গাকে নিয়ে গর্ব হয়। বিদেশে ও উপমহাদেশের মান রেখে যাচ্ছে। ক্রিকেটবিশ্বের যাবতীয় সীমান্ত ও জিতে নিয়েছে। টেস্টে ওর ধারাবাহিকতা দেখুন! দশ-দশটা ডাবল সেঞ্চুরি। ১৯০-প্লাস স্কোরের রেকর্ডে ডন ব্র্যাডম্যানকেও ছাপিয়ে গেল। আর বছরের পর বছর ও টেস্টে উইকেটকিপিং করছে, তার পর তিনে ব্যাট করতে নামছে। নিজে কিপিং-ওপেনিং করেছি বলে জানি ব্যাপারটা কত কঠিন। ফিটনেস, কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কোন জায়গায় থাকলে এত দিন ধরে এটা করে যাওয়া সম্ভব।
সঙ্গকারা যে সিস্টেম থেকে উঠে এসেছে, তার সঙ্গে ভারতের ক্রিকেট সিস্টেমের বিশেষ পার্থক্য নেই। তার উপর সঙ্গা যে পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটা দক্ষিণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের বাড়ির পরিবেশের কাছাকাছিই হবে। একই রকম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে সঙ্গা যদি এত সফল হতে পারে, তা হলে ভারতীয় ক্রিকেটাররা পারছে না কেন? হ্যাঁ, ইংল্যান্ড সফরে ভারতের বিপর্যয়ের কথা বলছি। সিরিজে ১-২ পিছিয়ে যাওয়ার পরের দিনই সঙ্গারা বৃষ্টিকে হারিয়ে টেস্ট জিতল, তাই স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপারটা মনে পড়ে যাচ্ছে। আর মনে হচ্ছে, সঙ্গার কাছ থেকে একটু শিখুক না কোহলিরা। এই যে সঙ্গকারা একটা নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন নিয়ে খেলে, সেটা দেখে শিখুক। আর তারও আগে শিখুক ভাল শুরু করলে সেটাকে বড় স্কোরে পাল্টে তবেই ক্রিজ ছাড়তে। সঙ্গকারা কিন্তু ১০৫ বা ১১০-এর স্কোরে থেমে থাকে না। ১৫০, ১৭০, ২০০, ২৩০ এর কমে ওর খিদে মেটে না।
এই খিদেটা যে কবে কোহলিদের মধ্যে দেখব!
কুমার সঙ্গকারা
১২৭ টেস্টে ১১৯০৭ রান
সর্বোচ্চ ৩১৯, গড় ৫৮.৯৪
সেঞ্চুরি ৩৭, ডাবল সেঞ্চুরি ১০
কঠিন জমিতে
অস্ট্রেলিয়ায়
৫ টেস্টে ৫৪৩ রান, সর্বোচ্চ ১৯২, গড় ৬০.৩৩, সেঞ্চুরি ১
ইংল্যান্ডে
১১ ম্যাচে ৮৬২ রান, সর্বোচ্চ ১৪৭, গড় ৪১.০৪, সেঞ্চুরি ২
দক্ষিণ আফ্রিকায়
৮ ম্যাচে ৫৭২ রান, সর্বোচ্চ ১০৮, গড় ৩৫.৭৫, সেঞ্চুরি ১
ওয়েস্ট ইন্ডিজে
৪ ম্যাচে ২৩৮ রান, সর্বোচ্চ ৭৫, গড় ৩৪
• প্রত্যেক ২.৫ ইনিংসে ৫০-প্লাস
• প্রত্যেক সপ্তম ইনিংসে সেঞ্চুরি