ফিটনেস মন্ত্রে দলকে পাল্টেই দিচ্ছেন বিরাট

অ্যান্ডারসনের  গোল দেখে তাঁর সতীর্থরা হাততালি দিয়ে উঠলেন। কেউ কেউ এমনকি, ঠাট্টা করে বলে ফেললেন, ইপিএলে সই করে ফেলো, জিমি।

Advertisement

সুমিত ঘোষ 

সাউদাম্পটন শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৮ ০৬:৩৯
Share:

লক্ষ্য: ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চতুর্থ টেস্ট শুরুর আগে অনুশীলনে বিরাট কোহালি। মঙ্গলবার সাউদাম্পটনে। রয়টার্স

সিরিজে প্রত্যাবর্তন ঘটাতে যাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে ইংল্যান্ড, সেই জেমস অ্যান্ডারসনকে ফুটবলে মেতে উঠতে দেখা গেল মঙ্গলবার দুপুরে। হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির মাঠে ডান হাতের সুইং নয়, বাঁ পায়ের দুর্দান্ত ভলিতে গোল করে সকলকে চমকে দিলেন ইংল্যান্ডের ‘সুইং কিং’। পোর্টেবল গোলপোস্ট বসিয়ে ফুটবল খেলছিল ইংল্যান্ড দল। অ্যান্ডারসনের গোল দেখে তাঁর সতীর্থরা হাততালি দিয়ে উঠলেন। কেউ কেউ এমনকি, ঠাট্টা করে বলে ফেললেন, ইপিএলে সই করে ফেলো, জিমি।

Advertisement

সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে সকালে হওয়া ভারতীয় অনুশীলনের কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কাউকে কি ফুটবল খেলতে দেখা গিয়েছিল? না, সত্যিই দেখা যায়নি। মনে পড়ছে না কবে সেটা শেষ দেখা গিয়েছে। ক্রিকেট অনুশীলনে বহু কাল ধরে ওয়ার্ম-আপের জন্য অন্যান্য নানা খেলার চল রয়েছে। কোনও দল ফুটবল খেলে, কোনও দল রাগবি। শুধু ক্রিকেট কেন, অন্য খেলাতেও এই রীতি রয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ইংল্যান্ডের হ্যারি কেনরা কবাডি খেলে ওয়ার্ম-আপ করতেন।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেট দল ওয়ার্ম-আপের ধারণাটাকেই পাল্টে দিচ্ছে। গা গরম করার জন্য শুরুতে বেশি এনার্জি ক্ষয় করার প্রথা বিসর্জন দেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এই সফরে। তার জায়গায় অধিনায়ক বিরাট কোহালির নেতৃত্বে, তাঁরই ব্যবহৃত হাইওয়ে অনুসরণ করছেন বেশির ভাগ ক্রিকেটার। শুরুতে হাল্কা গা গরম করে নাও, তার পরে নিংড়ে দাও নেট প্র্যাক্টিসে। শেষে গিয়ে ঢুকে পড়ো জিমে। এই কোহালি-নকশাই এখন ভারতীয় দলে সুপারহিট। এমনকি, ইংল্যান্ডের ক্রিকেট মহলেও প্রশংসিত হচ্ছে পাল্টে যাওয়া ভারতীয় প্রক্রিয়া। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, এত ফিট, এত শক্তিশালী ভারতীয় দল তাঁরা আগে কখনও দেখেননি।

Advertisement

আরও পড়ুন: সুইং খেলতে ভারতীয়দের নেটে বিশেষ বল

বছর পাঁচেক আগেও কোহালি ছিলেন করুণ নায়ারের মতো ফোলা গালের এক ক্রিকেটার। আইপিএল খেলতে খেলতে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আয়নায় দেখে তাঁর মধ্যে প্রথম বোধোদয় হয়েছিল, এ ভাবে চলতে দিলে ক্রিকেটকে ঘিরে দেখা কোনও স্বপ্নই পূরণ হবে না। সে দিনই তিনি শপথ নেন, জিমে পড়ে থেকে শক্তিশালী শরীর তৈরি করবেন। মেদ পুরো ঝরিয়ে ফেলে সিক্স প্যাক বানাবেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের ট্রেনার শঙ্কর বাসুর কাছে নিজেকে সঁপে দেন কোহালি। সাধনা নিয়ে তাঁর ফিটনেস গুরুর কাছে এখনও পড়ে আছেন তিনি। গুরু যা বলেন, তিনি সেটাই শোনেন। কখনও ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যান না। কোহালি এক বার এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘‘অফ ডে বলে কিছু হয় না। কোনও না কোনও পরিশ্রম করতেই হবে। এই বাড়তি পরিশ্রমটা ফল দেবে যখন আমার বয়স হয়ে যাবে, যখন পেশি কমজোরি হয়ে যাবে।’’

কোহালির জীবনে বাসুর সব চেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, তাঁকে দিয়ে ওজন তোলা শুরু করানো। এখনকার নিংড়ে নেওয়া সূচিতে প্রায় প্রত্যেক দিন খেলতে হচ্ছে। বিশ্রামের সুযোগ কম। তার উপর ক্রিকেট অনেক পাল্টে গিয়েছে। টি-টোয়েন্টি জমানায় স্কিলকে সরিয়ে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে শক্তি। পাওয়ারহিটিং অনেক বেড়ে গিয়েছে। নব্য যুগের ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে নরমসরম খেলোয়াড় হলে চলবে না। কোহালির হাতে যে দুর্দান্ত সব শট রয়েছে, সেটা অবশ্যই স্কিল। কিন্তু এখনকার দিনে শুধু স্কিল থাকলেই সব ধরনের ক্রিকেটে সফল হওয়া আর সম্ভব নয়। দরকার শক্তিও। সেটা বুঝতে পেরেই জিমে সময় দেওয়া শুরু করেছিলেন কোহালি। তাঁর শটে অসম্ভব জোর বেড়েছে জিমে গিয়ে ওজন তোলায়। ভারতে যখন ইংল্যান্ড সফর করছিল, একটি ওয়ান ডে ম্যাচে ক্রিস ওক্‌সকে ব্যাকফুটে ক্রিজের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা ছয় মেরেছিলেন কোহালি। ইউটিউবে গেলে এখনও দেখা যাবে সেই শট। দেখে ধারাভাষ্যকারেরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যানের হাতে এত শক্তি কী করে থাকতে পারে!

মহেন্দ্র সিংহ ধোনির থেকে অধিনায়কত্বের ব্যাটন হাতে তুলে নেওয়ার পরে কোহালি সব চেয়ে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন ফিটনেসের উপরে। আরসিবি থেকে বাসুকে তিনিই নিয়ে এসেছেন ভারতীয় দলে। আর কোহালির ফিটনেস নকশা এখন অন্যদের হাতেও তুলে দিতে শুরু করেছেন বাসু। তাঁর প্রেসক্রিপশন মেনেই চার-পাঁচ জন ভারতীয় পেসার ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে বল করছেন এখন। অন্য যে কোনও দেশের ব্যাটসম্যানদের মতো ভারতীয় ব্যাটসম্যানরাও এখন জোরে বল মারেন, ভারতীয় ফাস্ট বোলাররা গতি আর বাউন্সে টেক্কা দিতে পারেন যে কোনও দেশের ফাস্ট বোলারদের।

গত চার বছরের পরিসংখ্যান মেলালেই দেখা যাবে কোহালি কতটা পাল্টে যাওয়া ক্রিকেটার। টেস্টে তাঁর সেঞ্চুরি সংখ্যা এখন ২৩। তার মধ্যে শেষ চার বছরেই এসেছে ১৭টি সেঞ্চুরি। এমনিতে টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় এখন ৫৪.৪৯। শেষ চার বছরে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬৫.৬৯। এক দিনের ক্রিকেটে ৩৫ সেঞ্চুরির ১৬টি গত চার বছরে করা। এই সময়ে ওয়ান ডে-তে তাঁর ব্যাটিং গড় অবিশ্বাস্য, ৭০.২৫।

মঙ্গলবার সকালেও ভারতীয় দলের অনুশীলনে দেখা গেল, শুরুতে সকলে খুব বেশি হলে দু’পাক করে দৌড়লেন। সেটাই ওয়ার্ম-আপ। এখনকার সূচিতে সংক্ষিপ্ততম। তার পর মূল মাঠে এক প্রস্ত ব্যাটিং বা বোলিং অনুশীলন। তার পরে চলে যাও লাগোয়া অন্য মাঠে। সেখানে সঞ্জয় বাঙ্গার বিশেষ ধরনের ব্যাটিং অনুশীলন করাচ্ছেন। ওই মাঠেরই মাঝখানে আর একটা নেট তৈরি রাখা হয়েছে। বাঙ্গারের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ক্রিকেটারেরা সেখানে ঢুকে বল ছুড়ে ছুড়ে আরও কিছুক্ষণ ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করে আসছেন।

তার মানে মাথা পিছু তিন বার ব্যাটিং অনুশীলন করার প্রক্রিয়া। দেখা গেল শুধু ব্যাটসম্যানরাই নয়, বোলাররাও অনেকে এই ত্রিস্তর ব্যাটিং প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেলেন। কিন্তু সব চেয়ে বড় তফাত হচ্ছে, আগেকার মতো ব্যাটিং-বোলিং শেষ হলেই কিটব্যাগ গুছিয়ে কেউ ড্রেসিংরুমের আরাম কেদারায় চলে যেতে পারবেন না। প্রত্যেককে কোনও না কোনও শারীরিক কসরতের ক্লাস করতে হচ্ছে। এক দিকে ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধর ক্যাচ দিচ্ছেন। ফিল্ডিং প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন। সেগুলো তো বাধ্যতামূলক বটেই। তিনি শেষ করলেই অপেক্ষায় আছেন ট্রেনার শঙ্কর বাসু। ধরে ধরে এক-এক জনকে ইয়ো ইয়ো টেস্ট করাবেন।

ভারতীয় দলের দুই নবাগত তরুণ পৃথ্বী শ এবং হনুমা বিহারী নিশ্চয়ই দু’দিনের মধ্যেই টের পেয়ে গিয়েছেন ভারতীয় ‘এ’ আর ভারতীয় সিনিয়র দলে কত তফাত। দু’দিনই ব্যাটিং হয়ে যাওয়ার পরে দুই নতুন মুখকে আলাদা করে ছোটালেন বাসু। ছোটানো না বলে হয়তো বলা উচিত দম বার করিয়ে দিলেন। করুণ নায়ার একটু বেশি ভারিক্কি বলে তাঁকে আরও বেশি খাটতে হচ্ছে। ও দিকে, পৃথ্বীরা যখন মাঠে ইয়ো ইয়ো পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের অধিনায়ক রয়েছেন জিমে। তাঁর দেখাদেখি ব্যাট করে উঠে জিমে ছুটলেন কে এল রাহুল, শিখর ধওয়ন, অজিঙ্ক রাহানেরা। বোলারদের মধ্যেও শক্তিশালী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহীর সংখ্যাও কম নয়। উমেশ যাদব, ইশান্ত শর্মা, যশপ্রীত বুমরা ফাঁকি দেবেন না কখনও। ওয়েট ট্রেনিংয়ের সব চেয়ে সুফল পাচ্ছেন ভুবনেশ্বর কুমার এবং হার্দিক পাণ্ড্য। দু’জনেরই বলের গতি অনেক কম ছিল। এখন তাঁরাও গতিতে চমকে দিতে পারেন। ভারতীয় ক্রিকেটের এত কালের ইতিহাস ছিল স্কিল নির্ভর। এমনকি, তাঁদের সোনার প্রজন্মের দল অর্থাৎ সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভি ভি এস লক্ষ্ণণ, বীরেন্দ্র সহবাগ, অনিল কুম্বলে, হরভজন সিংহদেরও হাতিয়ার ছিল ক্রিকেটীয় নৈপুণ্য। কোহালির নেতৃত্বে বর্তমান ভারতীয় দল সেই ইতিহাস পাল্টে দিতে শুরু করেছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন