‘গডফাদার’ না থেকেও বিরাট রাজা

মহম্মদ আজহারউদ্দিন থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। রাহুল দ্রাবিড় থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আধুনিক ক্রিকেট যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষমতাশালী অধিনায়ক মানে বোর্ডের মধ্যে তাঁর কোনও না কোনও ‘গডফাদার’ থাকবেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৭ ০৪:৫৫
Share:

অধিনায়ক কোহালির পছন্দের রবি শাস্ত্রীকে কোচ নির্বাচন করল বোর্ড।

শুধু ব্যাট হাতেই নানা রকম সব মাইলসস্টোন উপড়ে ফেলা নয়। অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহালি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুলে দিয়ে যাচ্ছেন এক নতুন দিগন্তও।

Advertisement

মহম্মদ আজহারউদ্দিন থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। রাহুল দ্রাবিড় থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আধুনিক ক্রিকেট যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষমতাশালী অধিনায়ক মানে বোর্ডের মধ্যে তাঁর কোনও না কোনও ‘গডফাদার’ থাকবেই। আজহারের ছিলেন রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর। সৌরভের ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। ধোনির শ্রীনিবাসন। সব রকম ফর্ম্যাটে অধিনায়ক হয়ে গেলেও কোহালির কিন্তু এখনও তেমন কোনও ‘গডফাদার’ নেই।

তার পরেও অপছন্দের অনিল কুম্বলেকে সরিয়ে প্রিয় রবি শাস্ত্রীকে কোচ হিসেবে ফিরিয়ে আনার ‘মাস্টারস্ট্রোক’ নিয়ে ফেলতে পারছেন। হালফিলে শোনা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষকের দল কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিওএ)-এর জোরাল সমর্থন পাচ্ছেন কোহালি। বোর্ড সূত্রে খবর, কোচ নিয়ে বিতর্কে সিওএ-র প্রচ্ছন্ন সমর্থন কোহালি পেয়েছেন। তবু বলা যাবে না ভারতীয় ক্রিকেট এখন চালাচ্ছেন দুই ‘বি’। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রশাসকদের প্রধান বিনোদ রাই এবং অধিনায়ক বিরাট কোহালি।

Advertisement

অধিনায়কদের ক্ষমতা প্রদর্শনের এমন সব টুকরো টুকরো কাহিনি আছে ভারতীয় ক্রিকেটে, যা দিয়ে নিঃসন্দেহে ঠাকুরমার ঝুলি হয়ে যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ডিসেম্বর, ২০০৪। চট্টগ্রামের টিম হোটেল। রাঁচির মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামের এক লম্বা চুলের প্রতিভার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটতে চলেছে।

আরও পড়ুন: পুনর্মিলনের কথা ভেবেই উত্তেজিত, লন্ডন থেকে ফোনে বললেন শাস্ত্রী

কিন্তু আর্জেন্তিনীয় ফুটবলারের মতো দেখতে ধোনিকে নিয়ে নয়, হোটেলে ভারতীয় দলের অন্দরমহলে ঝড় চলছে অন্য এক ক্রিকেটারকে নিয়ে। সেই তারকা স্পিনারকে আবিষ্কার করা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ক্যাপ্টেনের ঘর থেকে বেরিয়েছেন এবং দেখে মনেই হবে না, বিন্দুমাত্র উদ্বেগে রয়েছেন। তারকা স্পিনারের নাম হরভজন সিংহ। ম্যাচ রেফারি তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। মারাত্মক ব্যাপার। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে হরভজনের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তার পরেও তাঁকে চিন্তামুক্ত দেখাচ্ছে!

পাওয়ারহাউস

আজহার-রাজ সিংহ: তরুণ আজ্জুকে অধিনায়কের পদে বসিয়েছিলেন রাজ। সারা জীবন সমর্থন পেয়ে আজ্জু হয়ে উঠেছিলেন শেষ কথা।

সৌরভ-ডালমিয়া: দু’জনে রাজ করেছেন ভারতীয় ক্রিকেট। সৌরভ ছিলেন মাঠের নেতা। পেয়েছেন সর্বময় শাসকের সমর্থন।

ধোনি-শ্রীনি: একের পর এক সিরিজ হারলেও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি অধিনায়ক ধোনিকে নিয়ে। বোর্ডের মসনদে যে শ্রীনিবাসন!

এত দিন পরে রিওয়াইন্ড করতে বসেও পরিষ্কার মনে পড়ছে হরভজনের নির্লিপ্ত সেই বাক্য— ‘‘দাদি কথা বলছে মিস্টার ডালমিয়ার সঙ্গে। উনি বলেছেন, ব্যাপারটা দেখবেন। আমার সঙ্গে অন্যায় হলে স্যার ছাড়বেন না।’’

‘দাদি’ মানে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বেহালার ভারত অধিনায়কের পাওয়ারহাউস ছিল কলকাতায় থিয়েটার রোডের একটি অফিস। যেখানে বসে জগমোহন ডালমিয়া এক সময় ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই, চালিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটও। এমনও ঘটেছে যে, সৌরভকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে বোর্ডের বিরোধী লবি। ডালমিয়া নির্বাচন লড়ে মসনদে ফিরে এসে সৌরভের সিংহাসন রক্ষা করেছেন। ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড সৌরভকে দু’ম্যাচের জন্য নির্বাসিত করার পরে ডালমিয়া আইনজীবী করে নিয়ে আসেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে। তাঁর অসাধারণ আইনি প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে আইসিসি-র বিরুদ্ধে মামলা জেতে বোর্ড। নির্বাসন উঠে গিয়ে ফের মাঠে নামেন সৌরভ।

প্রভাবশালী বোর্ড প্রশাসকের সমর্থনের জোরে বলশালী হয়েছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিনও। তাঁর অধিনায়কত্ব পাওয়ার সময়ে সেই ঐতিহাসিক সংলাপ— ‘মিঞাঁ কাপ্তান বনোগে?’ যিনি প্রশ্নটা করেছিলেন, সেই প্রয়াত রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর সারা জীবন সমর্থন করে গিয়েছেন প্রিয় আজ্জুকে। এতটাই স্নেহপ্রবণ ছিলেন ‘কাপ্তান’-এর প্রতি যে, ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগও সেই ভালবাসায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। কতটা ক্ষমতাশালী ছিলেন আজহার? একটা উদাহরণই যথেষ্ট। সুনীল গাওস্করকে পর্যন্ত এক বার আক্রমণ করে বলে দিতে পেরেছিলেন, ‘‘উনি আমার সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর।’’

তেমনই আইপিএল যুগে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে ধোনি-শ্রীনি যুগলবন্দি। যদিও তাঁদের জুটি নিয়ে প্রচুর বিতর্কও হয়েছে। শ্রীনির ইন্ডিয়া সিমেন্টসের পদাধিকারী হয়েছেন ধোনি। যা নিয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠেছে। আইপিএলে শ্রীনির চেন্নাই সুপার কিংগসের অধিনায়ক ধোনি। তাঁদের মধুচন্দ্রিমার নমুনা? অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পরে ধোনিকে ছেঁটে ফেললেন জাতীয় নির্বাচকেরা। অধিনায়ক বানিয়ে দিলেন কোহালিকে। ছুটির দিনে গল্ফ খেলছিলেন শ্রীনি। ও দিকে নির্বাচকদের তরফে বার বার ফোন যাচ্ছে তাঁর কাছে কারণ, বোর্ডের নিয়ম হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া দল ঘোষণা করা যাবে না।

খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে মিটিং স্থলে এলেন শ্রীনি। শোনা যায়, দরজা ধড়াস করে খুলে ঘরে ঢুকে সে দিন নির্বাচকদের ওপর ঝড় বইয়ে দেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। উত্তেজিত ভাবে এমনও নাকি বলেন যে, তোমরা আমার গল্ফ ডে নষ্ট করে দিলে। এর পর নির্বাচকদের বাধ্য করেন কোহালির নাম কেটে ফের ধোনিকে অধিনায়ক হিসেবে রেখে দিতে।

প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে যেমন এক জন নারী, তেমন প্রত্যেক সফল অধিনায়কের পিছনে এক জন ক্ষমতাশালী বোর্ড প্রেসিডেন্ট। এই কারণেই অধিনায়ক কোহালি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন, যে হেতু তিনি এই ‘ট্রেন্ড’কে পাল্টে দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। বোর্ডে ‘পাওয়ারহাউস’-এর আশেপাশে না থেকেও তিনি ক্ষমতাশালী। পছন্দ হোক বা না হোক, তাঁর যুক্তি মেনে নিতেই হচ্ছে। ব্যাটের জোর আর জনপ্রিয়তার হাওয়ায় এমনই অবিসংবাদী নায়ক এখন কোহালি।

ব্যাট হাতে নানা রেকর্ড ভাঙতে থাকবেন ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টার বয়। পাশাপাশি, অধিনায়কত্বের নতুন টেমপ্লেটও হয়তো তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন কিংগ কোহালি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন