শাস্ত্রীর নট ব্যাড-এ সিলমোহর চ্যাপেলেরও

আইরিশরা পরীক্ষা না নিলেও দমকা হাওয়া নেবে

তাই রেস্তোরাঁর সামনে বিশাল জটলা দেখে অবাক লাগল! এটা কি হ্যামিলটনের সবচেয়ে বিখ্যাত তাই রেস্তোরাঁ নাকি যে উইক ডে-র দিন রাত্তির দশটায় লোকে এমন বাইরে লাইন দিয়েছে? ভ্রম ভাঙতে কয়েক মিনিটের বেশি যাওয়া উচিত নয়। দ্রুতই আবিষ্কার করা যাবে রেস্তোরাঁর সামনে এই স্পটটাই আপাতত হ্যামিলটনে সবচেয়ে লোভনীয় লোকেশন! নৈসর্গিক দৃশ্যটৃশ্য নয়। ওটা তো নিউজিল্যান্ডে সীমাহীন। যেমন অ্যাডভেঞ্চারের সব স্পটও।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

হ্যামিলটন শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

এ বার পরীক্ষা হ্যাডলির দেশে। জন্মদিনে হ্যামিলটনে শামি। ছবি: এএফপি।

তাই রেস্তোরাঁর সামনে বিশাল জটলা দেখে অবাক লাগল! এটা কি হ্যামিলটনের সবচেয়ে বিখ্যাত তাই রেস্তোরাঁ নাকি যে উইক ডে-র দিন রাত্তির দশটায় লোকে এমন বাইরে লাইন দিয়েছে?

Advertisement

ভ্রম ভাঙতে কয়েক মিনিটের বেশি যাওয়া উচিত নয়। দ্রুতই আবিষ্কার করা যাবে রেস্তোরাঁর সামনে এই স্পটটাই আপাতত হ্যামিলটনে সবচেয়ে লোভনীয় লোকেশন! নৈসর্গিক দৃশ্যটৃশ্য নয়। ওটা তো নিউজিল্যান্ডে সীমাহীন। যেমন অ্যাডভেঞ্চারের সব স্পটও। এই মুহূর্তে হ্যামিলটনের এই লোকেশনটা হল সবচেয়ে কাছ থেকে ধোনির টিমকে দেখে নেওয়ার।

ফুটপাথের ওপারেই যে নভোটেল হোটেল। ভারতীয় ক্রিকেট দলের আস্তানা। রাতে টিমের প্লেয়াররা কাছাকাছি হণ্টনে ডিনার খেতে বেরোচ্ছেন। কেউ কেউ এই ফুটপাথেও আসছেন। তখন তাঁদের সঙ্গে সেলফি তোলা, অটোগ্রাফ নেওয়া এই সব। অস্ট্রেলিয়ার মতো গত দশ বছরে ভারতীয় জনসংখ্যা প্রচুর বেড়েছে নিউজিল্যান্ডে। এদের বেশির ভাগই অকল্যান্ডবাসী। কিন্তু তাতে কী? অকল্যান্ড তো মাত্র একশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে দেড় ঘণ্টা। মঙ্গলবার ছুটির দিন নয় তো কী! সে ভাবেই শুনলাম, কয়েক হাজার ভারতীয় সমর্থক হ্যামিলটন মাঠ ভরাতে আসছেন।

Advertisement

টিম ইন্ডিয়া কোয়ার্টার ফাইনালে শুধু উঠেই যায়নি। মোটামুটি মেলবোর্নে বাংলাদেশ যে তাদের প্রতিপক্ষ সেটাও পাকা হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। তবু কোহলিদের নিয়ে কৌতূহল লেগেই থাকছে যে পরপর জিতে চলার এই পৌনঃপুনিকতা কী ভাবে রাখতে পারছে টিম? মঙ্গলবার জিতলে তো পাঁচে পাঁচ হবে। এ বারের টুর্নামেন্টে ম্যাকালামরা ছাড়া যে কৃতিত্ব আর কারও নেই!

নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া প্রতিবেশী দেশ হয়ে— নিয়মিত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখেও অনেক ব্যাপারে প্রভূত আলাদা। অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপ ট্যুরিস্টকে এ বার নিউজিল্যান্ড সরকার বিনা ভিসায় দেশে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সিম কার্ড এখানে একেবারেই চলে না। অস্ট্রেলিয়ান উইকেটের লাইন আর লেংথও এখানে ওদেশের সিম কার্ডের মতোই ব্রাত্য। সিডনি থেকে আসার সময় প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় পেসার পিটার ক্লার্কের সঙ্গে দেখা। ক্লার্ক বিশ্বকাপের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। কিন্তু আজ থেকে অস্ট্রেলীয় রাগবি ইউনিয়ন লিগে প্রশাসক হিসেবে যোগ দিলেন। তাঁর এই বদলটা যেমন চমকপ্রদ, ততটাই চমকপ্রদ ক্লার্কের কাছে লাগছে ভারতীয় বোলিং। বলছিলেন, “অবশেষে আমি ভারতীয় পেসারদের অস্ট্রেলিয়ান লেংথে বল করতে দেখলাম। একটু ফুল। উপমহাদেশ থেকে এসেই যেমন শর্ট বোলিং শুরু হয়, তেমন নয়।”

কিন্তু মঙ্গলবার তো আর অস্ট্রেলিয়ান লেংথে চলবে না। নিউজিল্যান্ড লেংথে বল করতে হবে। ম্যাকালামের দেশের উইকেটে সিম করে অনেক বেশি। তেমনই সাইড বাউন্ডারিগুলো ছোট। আরও একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট এর পরেও বাকি থাকে। তা হল, দমকা হাওয়ার অ্যাডজাস্টমেন্ট। গত সিরিজে রবীন্দ্র জাডেজাকে যা ব্যাপক সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। সিডনি থেকে দিনভর যাঁর সঙ্গে জার্নি করে হ্যামিলটন পৌঁছলাম তিনি তো সবচেয়ে ভুক্তভোগী। তেইশ বছর পরেও ক্যাচটা ফেলার কথা ভুলতে পারেন না।

সিডনি থেকে অকল্যান্ড হয়ে হ্যামিলটন আসতে হয়। এটা ভূতের রাজার দেওয়া আধুনিক ক্রিকেট ব্যাট নয় যে মারলাম আর উড়ে গেল। প্লেনে বসলাম আর হ্যামিলটন পৌঁছে গেলাম। ছোট একটা অ্যাডভেঞ্চারও তার মধ্যে পড়ে। অকল্যান্ড থেকে উড়তে হয় উনিশ সিটারের একটা প্লেনে। সেটা এত সরু যে কেবিন ব্যাগেজ রাখার পর্যন্ত জায়গা নেই। কোনও বিমানসেবিকা নেই। আট হাজার ফিটের ওপর উড়তে পারে না। কিন্তু যখন মাঝআকাশে দমকা হাওয়া দেয়, প্লেনটা দেশলাই বক্সের মতো পলকা আকার নেয়। ওটা দেখামাত্র এ দিন সঞ্জয় মঞ্জরেকর বললেন, “এই রে, এই ছোট প্লেনগুলোর ভয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে কমেন্ট্রি করতে যাব না ঠিক করে ফেলেছি। ঠিক সেটাই আবার এখানে হাজির হল।”

কথা বলে পরে অবশ্য মনে হল, মঞ্জরেকরের আতঙ্ক এখনও তেইশ বছর আগে ডানেডিনের সেই ক্যাচ ফেলা। ওটা ছিল মার্ক গ্রেটব্যাচের। বোলার কপিল। ধরতে না পারা এত বড় টার্নিং পয়েন্ট হয়েছিল যে ভারত ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপের বাইরে চলে যায়! এখানকার মাঠে আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও কোনও মাঠের মতো হাওয়ার জন্য আলাদা অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয় যে বল হাওয়ায় ঠিক কতটা কাটবে! সেই অনুযায়ী আমার ফুটওয়ার্ক হবে। ধোনির টিমে পনেরো জনের মধ্যে এগারো জন প্রথম বিশ্বকাপ খেলছেন। নিউজিল্যান্ডে এক-আধ বার খেললেও মঙ্গলবার প্রতিপক্ষ আইরিশরা পরীক্ষা নিক বা না নিক— নতুন পরিবেশ নেবেই।

রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, “যে চারটে টিমকে হারিয়েছি তার মধ্যে তিনটেই বড় টিম। নট ব্যাড কী বলেন?” কথার মধ্যে মৃদু ব্যঙ্গ মিশ্রিত। অবশ্যই ভারতীয় মিডিয়া এবং বিশেষ কিছু বিশেষজ্ঞকে উদ্দেশ্য করে বলা।

আইরিশ-বধ হলে ধোনি বিশ্বকাপে ভারত অধিনায়ক হিসেবে টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতার রেকর্ড করবেন। চেন্নাইয়ে দু’হাজার এগারোতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে হ্যামিলটনে আয়ারল্যান্ড— এই হবে গাঙ্গুলিকে ছাপিয়ে ধোনির রেকর্ড, এমনটা গোটা দিন ক্রিকেটমিডিয়ায় চলল। ধোনিকে যতটুকু চিনি মনে হয় না রেকর্ডটায় তাঁর সামান্যতম উদ্ভাস থাকবে বলে! পুরনো ব্যালেন্স ক্যারি ফরোয়ার্ড করেই রেকর্ড গড়ায় তিনি কোনও দিন বিশ্বাসী নন। চাইবেন রেকর্ড যদি করতে হয়, এ বার টানা জিতে করতে!

আর সেই সম্ভাবনা তো হালফিলের সবচেয়ে বড় দুর্মুখরাও বিশ্বকাপের নতুন ভারত দেখে করছেন। ইয়ান চ্যাপেল লিখেছেন, ‘খুব কম সময়ের মধ্যে ভারত তাদের সম্পর্কে মূল্যায়নটা বদলে ফেলতে পেরেছে যে কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি ওদের দৌড় নয়। সেটা বদলে এখন দাঁড়াচ্ছে শেষ ফিনিশিং লাইন পর্যন্ত চলে যাওয়া। ধোনি যদি পরপর দু’বার করে দেখাতে পারে তা হলে ওর কৃতিত্ব পন্টিং বা লয়েডের চেয়ে অনেক বেশি হবে। ওদের দু’জনের হাতে থাকা বোলিং অনেক শক্তিশালী ছিল।’

গ্রুপ লিগের নিউজিল্যান্ড-অর্ধ শুরু হওয়ার আগেই পন্টিং আর লয়েডের পাশে বসিয়ে দেওয়া। তা-ও ইয়ান চ্যাপেল? যাঁকে তেন্ডুলকর মুখের ওপর আপনি একটি হাওয়া-মোরগ বলে দিলেও বাকি বিশ্ব তাঁর ক্রিকেটবোধকে সম্মান করে। শাস্ত্রীই তো করেন।

তা হলে তো সত্যিই নট ব্যাড?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন