ছোটদের কান্না।
কাপ আর ঠোঁটের দূরত্বটা সেই থেকেই গেল।
ক্রিকেটজীবনে একটা অদৃশ্য ট্যাগ তাঁর গায়ে বরাবর সেঁটে থাকত। তিনি পারফর্ম করতেন, ব্যাটসম্যানশিপের নতুন নতুন শৃঙ্গ আরোহণ করতেন, কিন্তু তার পরেও প্রচারের প্রাচুর্য নিয়ে চলে যেত অন্য কেউ। যা দেখে ক্রিকেটমহলে বলাবলি চলত, সেরা হয়েও শ্রেষ্ঠত্বের জয়তিলক তাঁর ভাগ্যে নেই। তিনি বরাবরের মেঘে ঢাকা তারা।
রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের কোচিং জীবনের প্রথম ধাপেও ট্যাগটা পাল্টাল না। রবিবার পর্যন্ত তা একই থেকে গেল। অবিসংবাদী ফেভারিট হয়েও বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে গেল দ্রাবিড়ের টিম। হেরে গেল, পাঁচ উইকেটে। কাপ ছোঁয়াও হল না দ্রাবিড়ের। ২০০৩-এ ক্রিকেটার হিসেবে পারেননি, এ বার কোচ হয়েও পারলেন না।
সন্ধেয় মীরপুরে ফোন করে শোনা গেল, ম্যাচের পর নাকি অনেকক্ষণ মাঠে দেখা যায়নি ভারতের জুনিয়র টিমের ‘দ্রোণাচার্য’কে। ড্রেসিংরুমে অদৃশ্য ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ, পরে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কয়েকটা বিমর্ষ ঝলক নাকি দেখা গিয়েছে। প্রেস কনফারেন্সে বলেও যান, ‘‘টিমের ছেলেদের কথা ভেবে খুব হতাশ লাগছে। ওদের পক্ষে ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কঠিন হবে। টিম হিসেবে আমরা কম সাফল্য পাইনি। এই প্রথম হারলাম। দুর্ভাগ্য, হারলাম সবচেয়ে বড় ম্যাচে।’’
ঠিকই। দ্রাবিড়ের যুব ভারত একটা নয়, দু’টো নয়, টানা তেরোটা ম্যাচে অপরাজিত ছিল। সরফরাজ খান, ময়ঙ্ক দাগরদের দুর্ভাগ্য যে আগে এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেলেও আসল ম্যাচটাতেই সেটা হল না। গোটা টুর্নামেন্ট দাপিয়ে খেলেও অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে গেল ভারত। এটা ঘটনা যে, ভারতের ‘ছোট’রা রবিবার ভাল খেলেননি। মীরপুরের সবুজ আভা উইকেটে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৪৫ রানে অলআউট হয়ে যান তাঁরা।
কিন্তু এটাও সত্যি যে, অত অল্প রান নিয়েও টিমকে হতোদ্যম হয়ে পড়তে দেননি দ্রাবিড়। শোনা গেল, নিজেই নাকি ইনিংস ব্রেকের সময় কিউটেরের কাছে চলে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ কথা বলে আসেন। টিমকেও লড়িয়ে দিয়েছেন। এক সময় তো মনে হয়েছে, ইশান কিষাণের টিম না ’৮৩-র লর্ডস ফিরিয়ে আনে শের-ই-বাংলায়!
এমনিতে প্রাক্-ফাইনাল পর্বের আলোচনায় ম্যাচটা নিয়ে সেটাই বলাবলি চলছিল। ’৮৩-র পর কোনও বিশ্বকাপ ফাইনালে আবার ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ছবি এ বার উল্টো। ক্লাইভ লয়েডের টিমের মতো এ বার ফেভারিট ইশান কিষাণের ভারত, আর কপিল দেবের ভারতের মতোই যেন আন্ডারডগ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব ১৯। কিন্তু ’৮৩-র পঁচিশে জুন যেমন ভিভ রিচার্ডসের ঝড় সত্ত্বেও শেষরক্ষা হয়নি ক্যারিবিয়ানদের, ঠিক তেমনই আজ কিষাণদেরও হল না। আবেশ খান-ময়ঙ্ক দাগরদের দুরন্ত বোলিং সত্ত্বেও। আশি রানের মধ্যে বিপক্ষের পাঁচ উইকেট ফেলে দিয়েও তাঁরা পারলেন না মাত্র একটা জুটি ভাঙতে। কেসি কার্টি আর কিমো পলের ৬৯ রানের পার্টনারশিপ। কার্টি ১২৫ বলে অপরাজিত ৫২-র অনবদ্য ইনিংস খেলে গেলেন। ভারতের কাজ আরও মুশকিল করে দিল ফিল্ডিং। গোটা দু’য়েক ক্যাচ পড়ল চাপের ফাইনালে।
বিমর্ষ দ্রাবিড় দেখলেন ক্যারিবিয়ান উচ্ছ্বাস।
সাংবাদিক সম্মেলনে দ্রাবিড়কে জিজ্ঞেস করা হয়, ক্যারিবিয়ান পেস খেলতে ভারতীয়দের অসুবিধে হল কি না। সরফরাজ খান (৫১) বাদে তো কেউ দাঁড়াতেই পারলেন না। একটা সময় ৫০ রানে পাঁচ উইকেট চলে যায় ভারতের। দ্রাবিড় বলে দিলেন, ‘‘মনে হয় ক্যারিবিয়ানদের তাদের প্রাপ্য কৃতিত্বটা দেওয়া উচিত। ওরা আজ অসাধারণ বল করেছে। এই উইকেটে ১৪৬ রান যথেষ্ট ছিল না।’’
কিন্তু তার পরেও দ্রাবিড় যথেষ্ট আশাবাদী তাঁর দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গর্বিত, ক্রিকেটারদের লড়াই নিয়ে। ক্রিকেটমহল আবার গর্বিত দ্রাবিড়কে নিয়ে। অনেকেই মনে করেন, অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ কোচ দ্রাবিড়ের সিভি আরও মজবুত করে দিয়ে গেল। উল্টো দিকে অবাক করা ব্যাপার হল, ক্যারিবিয়ান কৃতিত্বের পরেও কেউ কেউ আশঙ্কায় ডুবে। অনূর্ধ্ব উনিশ টিম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও কার্টিদের বাধা নাকি হতে পারে দেশের ক্রিকেট পরিকাঠামো। যেখানে বোর্ড বনাম ক্রিকেটারদের মধ্যে তীব্র ডামাডোল চলছে।
রবিবারের মীরপুর ফাইনাল সত্যিই বোধহয় সব দিক থেকে অন্য রকম। পরাজিতের কাছে এর পরেও সোনার ভবিষ্যৎ আর জয়ীর সামনে অনিশ্চয়তার সরণি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত - ১৪৫ (সরফরাজ ৫১, জোসেফ ৩-৩৯)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ - ১৪৬-৫ (কার্টি ৫২ ন:আ:, পল ৪০ ন:আ:, দাগর ৩-২৫)