নির্বাসিত তবে আইলিগ লক্ষ্যভ্রষ্ট নন। শুক্রবার বাগান প্র্যাকটিসে সঞ্জয় সেন। ছবি: উৎপল সরকার।
ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসে কোনও কোচ যে শাস্তি কখনও পাননি, তাই দেশের ফুটবল ফেডারেশন দিয়েছে মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেনকে।
দেশের এক নম্বর কোচের নজিরবিহীন শাস্তি কেন? তিনি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু মন্তব্য করেছিলেন বলে।
আটলেটিকো কলকাতার কোচ আন্তোনিও হাবাসের মতো কাউকে ঘুসি মারেননি সঞ্জয়। বেঙ্গালুরু এফসি কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডের মতো বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যও করেননি সঞ্জয়। রেফারিকে বা বিপক্ষ বেঞ্চে থাকা কোচকে গালাগাল দেননি। জাতীয় দলের কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন যে ভাবে ফেডারেশন কর্তাদের লাগাতার তুলোধনা করেন মিডিয়ার সামনে, সে রকম চাঁচাছোলা ভাষাতেও আক্রমণ করেননি সঞ্জয়।
শুধু আবেগের বশে সারসত্যটা সামনে এনে দিয়েছিলেন। যে ‘অপরাধে’ দশ লাখ টাকা জরিমানা এবং আট ম্যাচ সাসপেন্ড! অ্যাশলে বা স্টিভন কিন্তু আরও বড় অন্যায় করে পার পেয়ে গিয়েছেন। বিদেশি বলেই কি ছাড়!
বাগানের খবর, অ্যাপিল কমিটির কাছে আবেদন করতে চলেছেন সঞ্জয়। তাতে হয়তো তাঁর শাস্তির পরিমাণ কিছুটা কমবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সঞ্জয়ের না হয় শাস্তি হল। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলকে অধঃপতনে পাঠানোর জন্য প্রফুল্ল পটেল-সহ ফেডারেশন কর্তাদের শাস্তি দেবে কে?
এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ট্যাম্পাইন্স রোভার্স ম্যাচ জেতার পর সঞ্জয় প্রশ্ন তুলছিলেন, ওই টুর্নামেন্টে তার আগে কোনও ভারতীয় ক্লাব কখনও জিততে পারেনি। বাগান ইতিহাস গড়েছে। তার পরেও কেন তার দু’দিন পরেই বাগানের আই লিগ ম্যাচ বন্ধ রাখছে না ফেডারেশন? দেশের স্বার্থেই তো মাত্র দু’দিন আগে খেলেছে বাগান। আর কী বলেছিলেন সঞ্জয়? না ফেডারেশন স্পনসরদের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কোন কথাটা ভুল বলেছিলেন বাগান কোচ?
একটাও না।
এএফসি-র ম্যাচ খেলা মানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। কলকাতায় ট্যাম্পইন্স ম্যাচের ছয় দিনের মধ্যে মোহনবাগানের পরের লড়াই ছিল চিনের শক্তিশালী শেনডংয়ের সঙ্গে তাদের শহরে মাইনাস ৩-৪ ডিগ্রির ভয়ঙ্কর ঠান্ডায়। এই অবস্থায় বিশ্বের যে কোনও কোচই তাঁর ফুটবলারদের জন্য বিশ্রাম দাবি করতে পারেন। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘরোয়া লিগের ম্যাচ না খেলার অনুরোধ জানাতে পারেন। এর ভেতর অন্যায় কোথায়? আর ফেডারেশন যে তার অন্যতম স্পনসর আইএমজি রিলায়্যান্সের কাছে মাথা বিক্রি করে বসে আছে সেটা তো কর্তাদের কাজকর্মেই স্পষ্ট। না হলে আই লিগকে ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলে কেন আইএসএলের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন প্রফুল্ল পটেল-সুব্রত দত্তরা। নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে দু’টো লিগ মিশিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠবেন? সরকারি জিনিস কেউ ব্যক্তি মালিকানার হাতে তুলে দেয়!
দেশের এক নম্বর নক আউট টুনার্মেন্ট ফেড কাপও তো তুলে দিয়েছিলেন ওঁরা। পরে এএফসি-র নিয়মের যাঁতাকলে পরে সেটা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। সুযোগ পেলেই হয়তো আবার বন্ধ করে দেবেন। আর এ সবেরই পিছনে আইএসএলের রমরমা আরও বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়াই একমাত্র টার্গেট।
কী অবস্থা আই লিগের? কুড়ি বছরের টুর্নামেন্টে দল ১৪ থেকে কমতে কমতে ৯-তে ঠেকেছে। তা-ও নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি শিবাজিয়ান্সকে নেওয়ার পর। কলকাতা আর শিলং ছাড়া কোথাও গ্যালারি ভরে না। একের পর এক ক্লাব দল তুলে নিচ্ছে। এএফসি-নিয়মের জুজু দেখিয়ে চার্চিল ব্রাদার্স, রাংদাজিদ, মহমেডানের মতো ক্লাবকে মেরে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। গোয়ার ফুটবলমহলে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি বার আই লিগ চ্যাম্পিয়ন ডেম্পোও টিম তুলে দিতে পারে যে কোনও সময়। কই, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তো এ রকম হয়নি? তারই হাতে তৈরি জাতীয় লিগের কী রমরমা ছিল তখন! ফেড কাপও হত জমজমাট। আর তাঁর উত্তরসূরিরা সব তুলে দিচ্ছেন। যাঁরা দেশের দু’টো সেরা টুর্নামেন্ট আই লিগ আর ফেড কাপ-ই ঠিক ভাবে চালাতে পারেন না। যাঁদের আমলে স্যাগের মতো নাম কা ওয়াস্তে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টও চ্যাম্পিয়ন হয় না ভারত, প্রাক-বিশ্বকাপে গোলের মালা পরে জাতীয় দল, তাঁদের শাস্তি দেবে কে? আসলে প্রফুল্ল-সুব্রতদের মতো সর্বভারতীয় কর্তাদের ফুটবলের প্রতিই কোনও ভালবাসা, দায়বদ্ধতা নেই। রাজনীতি করে নিজেদের পদ টিকিয়ে রেখে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো আর ক্ষমতা জাহির করাই এখন ফেডারেশন কর্তাদের কাজ।
প্রেসিডন্ট প্রফুল্ল পটেল তো মাঠেই আসেন না। আই লিগ ট্রফি বিজয়ী দলের হাতে তুলে দেওয়ারও সময় নেই তাঁর। অথচ এই রাজনীতিবিদকে প্রায় নিয়মিত দেখা যায় ক্রিকেট মাঠে। আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। প্রফুল্লর রাজ্যের সবচেয়ে বড় ফুটবল টুনার্মেন্ট রোভার্স কাপ বন্ধ বহু দিন। মহীন্দ্রার মতো ক্লাব দল তুলে নিয়েছে। সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্তের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। বাংলার ফুটবলের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত তিনি। কখনও কোনও বড় স্পনসর এনেছেন আইএফএ-তে? অথচ তিনি-ই রাজ্য সংস্থার প্রেসিডেন্ট হয়ে ফেডারেশনের পদে। বাগান কোচের উপর এত বড় অবিচারের পরেও নির্লিপ্ত সুব্রত। তাঁর আমলে ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড মৃত্যুর দরজায়। অনূর্ধ্ব ১৯-এর হাস্যকর টুর্নামেন্টে পর্যবসিত। কলকাতা লিগেরও দফারফা। ফেডারেশনের আর যাঁরা পদাধিকারী তাঁদের বেশির ভাগ আই লিগে ক’টা দল এবং সেগুলো কোন কোন রাজ্যের জানতে চাইলে ঢোক গিলবেন! অথচ এঁরাই দেশের ফুটবল চালাচ্ছেন!
সঞ্জয় সেনকে যে কমিটি শাস্তি দিয়েছে তার অবস্থা আরও করুণ। চেয়ারম্যান যিনি সেই এন এ খানের রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে ফুটবলই হয় না। কমিটির বাকিদের মধ্যে দু’জন ছাড়া কারও রাজ্যে ফুটবল লিগ নেই। এঁদের কাউকে কখনও মাঠে দেখা যায় না। বাগান-কোচের লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল কি না জানতে গিয়ে আরও মজার অভিজ্ঞতা হল। শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির তিন জন জানেনই না সঞ্জয় গত বার বাগানকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছেন। দেশের সেরা কোচ হয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, সঞ্জয় নিজে সভায় এসে কথা বললে এত শাস্তি হত না। প্রশ্ন করা হল, অসুস্থ কোচ তো ফেডারেশন সচিব কুশল দাশের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেছিলেন। পরে যে কোনও দিন সময় দিলে দিল্লি যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির অন্তত দু’জন সদস্যের দাবি, তাঁদের সেই কথা জানানো হয়নি। সচিব কুশল এবং আই লিগের সিইও সুনন্দ ধর ফেডারেশনের বেতনভুক কর্মী। প্রফুল্ল-সুব্রত এবং তাঁদের সাকরেদরা যা বলেন তাই করতে হয় সুনন্দদের।
আসলে অকর্মণ্য-অক্ষম ফেডারেশন কর্তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সঞ্জয়কে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়েছেন। তাঁদের ভয়, আজ বাগান কোচ বলছেন, কাল যদি সব কোচ একযোগে শাস্তির দাবি তোলেন শাসকদের! বলেন, নীতা অম্বানীকেই প্রেসিডেন্ট করে দিন না! দেশের ফুটবলটা চালাচ্ছেন তো উনিই।