আর্জেন্টিনার অনুশীলনে মেসি। বুধবার মস্কোয়। ছবি: রয়টার্স
আর্জেন্টিনার মতো মহাশক্তির বিরুদ্ধে যখন কোনও দুর্বল দল খেলতে নামে, তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে। যত পারব রক্ষণাত্মক থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাব আর সুযোগ পেলে তবেই কাউন্টার অ্যাটাকে ছোবল মারার চেষ্টা করব।
আইসল্যান্ড ঠিক সেটাই করছিল আমাদের দেশের বিরুদ্ধে। পঞ্চাশ মিটার মতো জায়গা জুড়ে ওরা ঘোরাফেরা করে যাবে, সুযোগ পেলে প্রতি আক্রমণে যাবে। এটাই ছোট দলগুলির নিয়ম। হামেশাই বিশ্ব ফুটবলে এই রণনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। বড় দলগুলির কাছে মাঝেমধ্যে সত্যিই কিন্তু খুব কঠিন হতে পারে এই রক্ষণাত্মক নকশাকে উপড়ে ফেলে ম্যাচ জেতা। প্রতিপক্ষ যদি তাদের সব ফুটবলারকে নিয়ে রক্ষণ সামলায়, অনেক বড় বড় দলও সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।
আর্জেন্টিনাকে সে রকমই প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রথম ম্যাচে। প্রথমার্ধটা আইসল্যান্ড পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল আমাদের দলকে। ওরা এমনকি, আরও একটি গোল করে ফেলার সুযোগ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে দেখলাম, ওদের ফরোয়ার্ডরাও সমানে পিছনে দৌড়ে এসে রক্ষণ সামলাচ্ছে। বলতেই হবে, আইসল্যান্ডের রণনীতি সফল হয়েছে।
ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে অন্য রকম খেলা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর্জেন্টিনার সামনের দিকে যারা খেলবে, তারা বেশি জায়গা পেতে পারে। কারণ, ক্রোয়েশিয়া নিশ্চয়ই আইসল্যান্ডের মতো সারাক্ষণ রক্ষণ সামলানোর চেষ্টা করে যাবে না। তবে সবার আগে একটা কথা বলে দিতে চাই। যদি আজও আর্জেন্টিনা পেনাল্টি পায়, তা হলে লিয়োনেল মেসিরই সেটা মারা উচিত। যদি না ও নিজে জানায় যে, পেনাল্টি মারতে চায় না। ফুটবল খেলতে নেমে চাপকে যদি এত গুরুত্ব দিয়ে ফেলি, তা হলে কী করে হবে? চাপের সামনে অন্য জগতের মানুষরা কাঁপতে পারেন। যিনি কারখানায় যাচ্ছেন প্রত্যেক দিন গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ করতে, তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে চাপ। কিন্তু ফুটবলাররা তো কোটিপতি। তারা মাঠে খেলতে নামার জন্য প্রচুর অর্থ পাচ্ছে। তাই তাদের দায়িত্ব চাপটাকে পারফরম্যান্সে পরিণত করা। কে কত সফল ভাবে সেটা পারে, সেটাই প্রমাণ করে মানসিক ভাবে কে কতটা শক্তিশালী। আমি জানি, এক-এক জন ফুটবলারের চাপ এক-এক রকম। কিন্তু সেটা সামলাতে জানতে হবে।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর হ্যাটট্রিক কি মেসির উপর প্রভাব ফেলেছিল? আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মেসি এবং রোনাল্ডো একে অপরকে তাতায়। দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই দু’জনকে সেরা করেছে। লিয়োনেল নিশ্চয়ই রোনাল্ডোর গোল করা দেখে বিরক্ত হবে না। আবার এটাও ঠিক যে প্রতিদ্বন্দ্বীর গোলগুলো ওকে খুব শান্তিও দেবে না। আমি এখন কোচিং করাই। কিন্তু কোচ হিসেবে নয়, এই কথাটা আমি বলতে পারছি প্রাক্তন এক গোল স্কোরার হিসেবে। যখন খেলতাম, গোল স্কোরারের টেবলে সব সময় এক নম্বরে থাকার চেষ্টা করে গিয়েছি। আর যখনই দেখতাম টেবলে থাকা দু’নম্বর গোল করেছে, উদ্বেগ তৈরি হত আমার মধ্যে। তাই আমার মনে হয়, রোনাল্ডো প্রথম ম্যাচেই তিন গোল করে দেওয়ার পরে মেসি চাপ অনুভব করছিল।
আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের মিডফিল্ডকে খুব মন্থর দেখিয়েছে। ওরা সব সময় মাঝখান দিয়ে উঠে মেসিকে বল বাড়িয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু সেটা করতে পারছিল না। মেসি দারুণ ফুটবলার কিন্তু আর্জেন্টিনা দল ঠিক মতো ওকে সাহায্য করতে পারছে না। সারাক্ষণ দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে লিয়োনেল মেসির তুলনাটাও বন্ধ হওয়া উচিত। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে এখনও আমাদের দেশের মানুষ গর্ব করে। সেই দলের নেতৃত্বে ছিল দিয়েগো মারাদোনা।
যাকে ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা মনে করা হয়। যে-ই আসুক না কেন, মারাদোনা মারাদোনাই। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মারাদোনা খেলা ছেড়ে দিয়েছে। মেসি এখন খেলছে এবং আমাদের আনন্দও দিচ্ছে। দু’জন দুই যুগের ফুটবলার, দু’টো আলাদা দলে খেলেছে, আলাদা সতীর্থ পাশে পেয়েছে। তাই তুলনা করাটা ঠিক নয়। এই তুলনাটাও মেসির উপর অনর্থক চাপ সৃষ্টি করছে।
’৮৬ বিশ্বকাপ জেতার সময় ভাগ্য সহায় হয়েছিল মারাদোনার। সেটা হয়তো মেসির কপালে এখনও জোটেনি। আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ দেখে আমার মনে হয়েছে, দিবালাকে খেলানো উচিত। মাসচেরানো সব চেয়ে বেশি বল ধরছে, এটা মোটেও ভাল খবর নয়। ওকে খেলা তৈরি করার ভূমিকায় ব্যবহার করলে ভুল হবে। বরং অল্প কিছু সময় যা দেখলাম, পাভনকে ভাল লাগল। রোহোর চেয়ে ফাজিও ভাল পছন্দ হতে পারত বলেও আমার মনে হয়। আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে দশটি কর্নার পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। মাত্র একটিতে ওতামেন্দি মাথা ছোঁয়াতে পেরেছিল। এটা নিয়েও ভাবা দরকার। হিগুয়াইনকে বেঞ্চেই বসিয়ে রাখা হবে নাকি নামানো হবে, সেটা আর একটা ফয়সালার জায়গা।
একটা কথা ফুটবল বিশ্বে খুবই বলা হয় যে, লিয়োনেল মেসির ট্রফির আলমারিতে সব আছে, বিশ্বকাপ নেই। তা হলে আর কী করে বড় ফুটবলার বলব! আমি এই যুক্তি মানি না। আলফ্রেদো দি স্তেফানো কখনও বিশ্বকাপ জেতেননি। একা তিনি নন, অনেকেই জেতেননি। বিশ্বকাপ জিতলেই তুমি শ্রেষ্ঠ— এই মতবাদটাই আমার কাছে হাস্যকর!